পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র না থাকলে কী হতো?

পৃথিবীর চারপাশের আছে এক অদৃশ্য প্রতিরক্ষা বলয়। এ বলয় না থাকলে পৃথিবীতে জীব-বৈচিত্র্য কল্পনা করা কঠিন। এই বলয়টি আর কিছু নয়, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র। চৌম্বকক্ষেত্র ঠিক কীভাবে পৃথিবীকে রক্ষা করছে? কী হতো পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র না থাকলে? চৌম্বকক্ষেত্রই-বা কীভাবে তৈরি হয়েছিলো?

পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র প্রতিটা মুহূর্ত মহাজাগতিক ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করছে। চৌম্বকক্ষেত্র ছাড়া সৌরবায়ুর প্রভাবে বিলীন হয়ে যেত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। সূর্যের প্রচণ্ড তেজস্ক্রিয় বিকিরণ আছড়ে পড়তো পৃথিবীর বুকে। মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীর ভূ-ত্বকের নিচে কনক্রিটের আবাসস্থল তৈরি করে সেখানে বসবাস করতে হতো। অর্থাৎ আমাদের জীবনধারণের জন্য এই চৌম্বক্ষেত্রের ভূমিকা অতিগুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই চৌম্বকক্ষেত্র কীভাবে তৈরি হয়?

পৃথিবীর কেন্দ্রে আছে অতি উত্তপ্ত কঠিন লোহার গোলক। এর তাপমাত্রা প্রায় ৫ হাজার ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কেন্দ্রের কঠিন গোলকের চারপাশে আছে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার তরল পদার্থ। তরলের উপাদান মূলত লোহা ও নিকেল। তাপমাত্রা, চাপ এবং গঠনগত পার্থক্যের কারণে গরম ও কম ঘন পদার্থ বাইরের স্তরে বেরিয়ে আসে। একইভাবে বাইরের স্তরের ঘন পদার্থগুলো চলে যায় ভেতরের স্তরে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব সময় এটা ঘটছে। তবে পৃথিবীর উচ্চচাপের কারণে একেবারে কেন্দ্রের গোলকটি তরল হতে পারে না।

পৃথিবীর চারপাশের আছে এক অদৃশ্য প্রতিরক্ষা বলয়। এ বলয় না থাকলে পৃথিবীতে জীব-বৈচিত্র্য কল্পনা করা কঠিন।

পৃথিবী তার নিজ অক্ষের ওপরে ক্রমাগত লাটিমের মতো ঘুরছে। এই ঘূর্ণনের কারণে কেন্দ্রে কোরিওলিস ইফেক্ট তৈরি হয়। এ কারণে কেন্দ্রের তরলে তৈরি হয় এক ধরনের ঘূর্ণিবর্ত। ফলে বৈদ্যুতিক স্রোত তৈরি হয়। আর এই বিদ্যুত প্রবাহের কারণে তৈরি হয় অদৃশ্য চৌম্বকক্ষেত্র। বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত ধাতু কেন্দ্রের তরলের মাঝে ঘোরার সময় চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে তৈরি হয় বিদ্যুৎ প্রবাহ। বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে তৈরি হয় চৌম্বকক্ষেত্র। এ চক্র চলতেই থাকে। মনে হতে পারে, পৃথিবীর কেন্দ্রে বুঝি নিরবিচ্ছিন্নভাবে বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়াই শক্তি তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি আসলে এমন নয়। সূর্যের আকর্ষণে পৃথিবী যে প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে, সেই ঘূর্ণন শক্তি থেকে কেন্দ্রে তৈরি হয় এই বিদ্যুৎ ও চৌম্বক শক্তি। সঙ্গে আছে পরমাণুর অভ্যন্তরীণ শক্তি ও পৃথিবীর অভ্যন্তরে জমা পড়া তাপশক্তির সক্রিয় প্রভাব। তাই, হঠাৎ করে এই পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র বিলীন হওয়ার আশঙ্কা নেই।

এবার আসল প্রশ্নে আসা যাক। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র না থাকলে কী হতো? আমরা কী বেঁচে থাকতে পারতাম?

দুর্যোগের শুরুটা হতো বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় ইন্টারফারেন্স (EMI) অথবা রেডিও-তরঙ্গ ইন্টারফারেন্স (RFI)-এর মাধ্যমে। পৃথিবীর বেতার তরঙ্গ অকার্যকর হয়ে পড়তো। ফলে ভেঙে পড়তো সব ধরনের বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা। পাখিরা দিক হারিয়ে আকাশ থেকে ঝরে পড়তো মাটিতে। উড়োজাহাজ হয়ে পড়তো নিয়ন্ত্রণহারা। তাবৎ পৃথিবীর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো। আগে যেমনটা বলেছি সৌর বায়ুর অবাধ প্রবাহে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতো। শ্বাস নেওয়ার মতো বাতাসও একটা সময় থাকতো না পৃথিবীতে। বর্তমানে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র সূর্য থেকে আসা উচ্চশক্তিসম্পন্ন কণা এবং সৌর বায়ুকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে আটকে দেয়। এ কারণে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে দেখা যায় মেরুজ্যোতি বা আরোরা।

যাহোক, বায়ুমণ্ডলের উপাদান কমে যাওয়ার অর্থ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় চাপ কমে যাওয়া। বায়ুমণ্ডলীয় চাপ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের পানি আরও দ্রুত বাষ্পীভূত হতে থাকবে। একটা সময় বাতাস ও পানি সম্পূর্ণই হারিয়ে যাবে মহাশূন্যে। মঙ্গলের মতো বাতাস ও পানিবিহীন মরুগ্রহে পরিণত হবে পৃথিবী। এ সময় পৃথিবীপৃষ্ঠে কোনো মানুষ বেঁচে থাকলেও সূর্যের তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাবে শরীরে দেখা দেবে ক্যান্সার। বেতার তরঙ্গ না থাকায় একসময় পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলোও আছড়ে পড়া শুরু করবে পৃথিবীতে। এক কথায় চৌম্বক ক্ষেত্র বিলীন হলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবীতে নেমে আসবে চরম বিপর্যয়।

শিল্পীর কল্পনায় পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই আমাদের। পৃথিবী চৌম্বকক্ষেত্র রাতারাতি উধাও হওয়ার আশঙ্কা প্রায় শূন্য। যদিও এ চৌম্বকক্ষেত্র সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়। মোটামুটি ২ লাখ বছরে একবার পৃথিবীর চৌম্বক মেরু উল্টে যায়। এই মেরু পরিবর্তনের সময় পৃথিবীতে কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র পুরোপুরি বিলীন হওয়ার মতো শঙ্কা নেই বলেই প্রমাণিত হয়েছে বিজ্ঞানীদের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায়।

না চাইতেই প্রকৃতি থেকে অনেক কিছু পেয়েছি আমরা। পৃথিবীর এই সুরক্ষা বলয় তার মধ্যে একটি। পৃথিবীতে এমনিতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে প্রতিনিয়ত। মহাজাগতিক বিপদও কম নেই। সবকিছুর মাঝে পৃথিবীর সুন্দর ও বাসযোগ্য রাখতে আমাদেরকেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। মানুষের কারণে প্রকৃতি ও প্রাণের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে সবাইকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াট ইফ শো, উইকিপিডিয়া, লাইভ সায়েন্স