সৌরজগতের সবচেয়ে পুরানো আর বড় গ্রহ বৃহস্পতি। একে বলা হয় গ্রহরাজ। পৃথিবীকে যদি একটা আঙুরের সমান হয়, তাহলে বৃহস্পতি হবে একটা বাস্কেটবলের মতো। কিন্তু সম্প্রতি নতুন এক গবেষণাইয় দেখা গেছে, গ্রহরাজ একসময় বর্তমানের চেয়েও দ্বিগুণ বড় ছিল। সূর্য আর গ্রহগুলো যখন গ্যাস আর ধুলোর মেঘ থেকে তৈরি হয়েছিল, তখন বৃহস্পতির এই বড় রুপ ছিল। নতুন এই তথ্য গত ২০ মে নেচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নাল-এ প্রকাশিত হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে বৃহস্পতির ব্যাসার্ধ আজকের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। মানে তখন বৃহস্পতির আকার যা ছিল, তাতে ২ হাজার পৃথিবীর সমান গ্রহ ঢুকে যেত অনায়েসে। কিন্তু বর্তমানে এই গ্রহে প্রায় ১ হাজার ৩০০ পৃথিবীর সমান গ্রহ ধরবে।
৮৮ হাজার ৮০০ মাইলেরও বেশি ব্যাসের এই গ্রহটি পৃথিবীর চেয়ে ১১ গুণ চওড়া। সৌরজগতের আর ৭টি গ্রহের মোট ভরের চেয়ে বৃহস্পতির ভর দ্বিগুণ। কিন্তু এই গ্যাসদানবের উপগ্রহগুলোর হিসাব করে জ্যোতির্বিদরা এখন বলছেন, বৃহস্পতি একসময় বর্তমানের দ্বিগুণেরও বেশি বড় ছিল। আর গ্রহটির চৌম্বকক্ষেত্র ছিল ৫০ গুণ শক্তিশালী।
বৃহস্পতির আদিম অবস্থা বুঝতে গবেষকরা এর ৯২টি পরিচিত উপগ্রহের মধ্যে সবচেয়ে ছোটগুলোর দিকে নজর দিয়েছেন। আলমাথিয়া আর থিবি নামে দুটি উপগ্রহ বৃহস্পতিকে কিছুটা কাত হয়ে প্রদক্ষিণ করে। এরা যথাক্রমে বৃহস্পতি গ্রহের মেঘের ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯০ এবং ২ লাখ ২২ হাজার ৮৯ কিলোমিটার ওপরে থেকে বৃহস্পতির চারপাশে ঘোরে।
এই কক্ষপথের অসামঞ্জস্য আর গ্রহটির কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণ নিয়ে বিশ্লেষণ করে দলটি অনুমান করতে পেরেছে, সৌরজগতে প্রথম কঠিন পদার্থ গঠনের প্রায় ৩৮ লাখ বছর পর বৃহস্পতির ব্যাসার্ধ আর ভেতরের অবস্থা কেমন ছিল। সেই সময় সূর্যের চারপাশে প্রোটোপ্ল্যানেটারি নেবুলা নামে উপাদানের একটি চাকতি ছিল। সেই চাকতি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গিয়ে আজকের পরিচিত গ্রহগুলো তৈরি করেছে।
নতুন এই আবিষ্কার আমাদের সৌরজগতের ইতিহাস সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। বৃহস্পতির এই প্রাচীন বিশাল রূপ হয়তো অন্যান্য গ্রহের কক্ষপথ আর গঠনে প্রভাব ফেলেছিল।
বৃহস্পতির উপগ্রহগুলো থেকে পাওয়া সরাসরি পরিমাপযোগ্য তথ্য আর এর কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণের ওপর মনোযোগ দিয়ে দলটি গ্রহ গঠনের মডেলে থাকা অনেক সাধারণ অনিশ্চয়তা এড়িয়ে যেতে পেরেছে। এই মডেলগুলোতে সাধারণত জ্যোতির্বিদদের গ্যাসের স্বচ্ছতা, সংযোজনের হার আর ভারী মৌলের কেন্দ্রের ভরের মতো বিষয়ে অনুমান করতে হয়।
গবেষকদের মতে, তাঁদের এই নতুন হিসাব শুধু বৃহস্পতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের বোঝাপড়া বাড়ায় না। এই বিষয়গুলো অন্যান্য নক্ষত্রের চারপাশে ঘোরা বিশাল গ্রহগুলোর বিবর্তনেও প্রয়োগ করা যায়। এটাও বোঝায় যে গ্যাসদানবরা সাধারণত কেন্দ্র সংযোজনের মাধ্যমে তৈরি হয়। মানে বরফ আর পাথরের কেন্দ্রের চারপাশে দ্রুত গ্যাস জমা হয়।
ক্যালটেকের গ্রহ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আর এই গবেষণার সহলেখক কনস্ট্যান্টিন ব্যাটিগিন বলেন, ‘আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এটা বোঝা যে আমরা কোথা থেকে এসেছি। গ্রহ গঠনের প্রাথমিক পর্যায়গুলো নির্ধারণ করা এই ধাঁধার সমাধানের জন্য অপরিহার্য। এটা শুধু বৃহস্পতির ব্যাপার নয়, বরং সম্পূর্ণ সৌরঝগতকে বোঝা যাবে এর সাহায্যে।’
নতুন এই আবিষ্কার আমাদের সৌরজগতের ইতিহাস সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। বৃহস্পতির এই প্রাচীন বিশাল রূপ হয়তো অন্যান্য গ্রহের কক্ষপথ আর গঠনে প্রভাব ফেলেছিল। আর এই গবেষণা প্রমাণ করে, আমাদের মহাকাশীয় পরিবেশ আজকের মতো স্থির নয়। বরং বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে পরিবর্তিত হয়ে আজকের রূপ নিয়েছে।