ছবি কীভাবে ডেটায় পরিণত হয়?

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ অবশেষে যাচ্ছে মহাকাশে। যেসব টেলিস্কোপ সরাসরি ছবি তোলে, এগুলোর বৈজ্ঞানিক উপাত্ত নিতে হলে অনেক ছোট ছোট নয়েজ বা ভুল বাদ দিতে হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ক্যালিব্রেশন। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে সরাসরি ছবি তোলা ও স্পেকট্রোস্কপি—মূলত এ দুই কাজ করা হবে। কাজ দুটি করা হবে দুই রেঞ্জের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করে—নিয়ার ইনফ্রারেড ও ইনফ্রারেড। সব মিলিয়ে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে চার ধরনের উপাত্ত গ্রহণকারী যন্ত্রাংশ আছে। নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা (NIRcam), নিয়ার ইনফ্রারেড ইমেজার অ্যান্ড স্লিটলেস স্পেকট্রোগ্রাফ (NIRISS), নিয়ার ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ (NIRSpec) ও মিড ইনফ্রারেড ইনস্ট্রুমেন্ট (MIRI)। সব কটি যন্ত্রাংশের উপাত্তকে তিনটি ধাপে নানা ধরনের ত্রুটির জন্য ক্যালিব্রেশন করা হবে। এই লেখায় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্যালিব্রেশনের ধাপ ও ফটোমেট্রি নিয়ে আলোচনা করব।

তবে তার আগে আমাদের জেনে নিতে হবে টেলিস্কোপের আলোক সেন্সর সম্পর্কে। টেলিস্কোপে পাওয়া আলোকে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সিগন্যালে পরিণত করতে যে সেন্সর ব্যবহার করা হয়, তার নাম সিসিডি। অর্থাৎ চার্জ কাপলড ডিভাইস। সিসিডিকে তুলনা করুন বালতির সঙ্গে, আর আলোর কণাগুলোকে বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে। ধরা যাক, বেশ কিছু বালতি পাশাপাশি রাখা আছে। এর ওপর বৃষ্টি হলে প্রতিটি বালতিতে কতটুকু উচ্চতায় পানি জমা হয়েছে, সেটা মেপে কী পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা জানা যায় সহজেই। সিসিডির কাজও মোটামুটি একই রকম। প্রতি পিক্সেলে কতটুকু আলোর কণা ফোটন এসে পড়েছে, সেগুলো হিসাব করে সিসিডির মাধ্যমে সরাসরি বৈদ্যুতিক সিগন্যালে পরিণত করে সেটা রেকর্ড করা হয়। ফলে সেই উপাত্তে প্রতিটি পিক্সেলের উজ্জ্বলতার মাপ পাওয়া যায়। তখন সহজেই উপাত্তকে ডিজিটাল ছবিতে পরিণত করা যায়।

প্রথম ধাপ

প্রথম ধাপের ক্যালিব্রেশন করা হয় সরাসরি ডিটেক্টর পর্যায়ে। এই ধাপের একটি ক্যালিব্রেশন হলো বায়াস। এটা সাধারণ অর্থে বায়াস নয়। ক্যামেরায় সিসিডিগুলোর সজ্জার রকমভেদের কারণে ছবিতে কিছু ভুল আসে, সেগুলোই হলো বায়াস। বায়াস কেমন হবে, তা ওই ক্যামেরা ও তার ওই সময়ের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। প্রতিবার টেলিস্কোপ চালু করার সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার লেন্সের ওপর কভার লাগিয়ে, অর্থাৎ আলো ঢুকতে না দিয়ে ছবি তোলা হয়। এটাই বায়াসের ছবি তোলা। এ ধরনের ছবি একদম পুরোপুরি কালো আসার কথা। কিন্তু পুরো কালো আসে না, কিছু আকৃতি দেখা যায়। এই আকৃতিগুলো আমাদের তোলা ছবিতেও থাকবে। তাই ক্যালিব্রেশনের প্রথম ধাপ হলো, তোলা ছবি থেকে বায়াসের ছবি, মানে অযথা চলে আসা আকৃতিগুলো বাদ দেওয়া। এটা করা হয় ছবিতে প্রতি পিক্সেলের জন্য বায়াসের ছবির ওই পিক্সেলের মান বিয়োগ করে।

এরপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যালিব্রেশন ধাপ হলো ডার্ক কারেন্ট বাদ দেওয়া। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাশূন্যে পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছিতে অবস্থান করবে। তাই বেশ কিছুক্ষণ টেলিস্কোপ চালু থাকলে এর যন্ত্রাংশগুলো বেশ গরম হয়ে উঠবে। যন্ত্রাংশের এই তাপ সিসিডিতে ইলেকট্রনের প্রবাহ বা বিদ্যুৎ তৈরি করে, একে বলা হয় ডার্ক কারেন্ট। সিসিডির সাধারণ কাজ হলো এর ওপর আলো পড়লে সেগুলোকে বিদ্যুতে পরিণত করা। কিন্তু দেখাই যাচ্ছে, কোনো আলো ছাড়াই সিসিডিতে ডার্ক কারেন্ট প্রবাহিত হচ্ছে। এই ডার্ক কারেন্ট পরে ছবিতে আলো হিসেবে দেখা যায়। তাই বায়াস বাদ দেওয়ার মতোই ডার্ক কারেন্টের কারণে তৈরি হওয়া আলো ছবি থেকে বাদ দিতে হয়।

এই ধাপে আরও পরীক্ষা করা হয় কোনো পিক্সেলের সর্বোচ্চ উজ্জ্বলতার মান পার হয়ে গেছে কি না। একে বলা হয় স্যাচুরেশন। পাশাপাশি পিক্সেলগুলোর কোনোটা হুট করে অল্প সময়ের জন্য উজ্জ্বল হয়ে যেতে পারে। সেটা হতে পারে কসমিক রশ্মি বা অন্য অনেক কারণে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কোনো পিক্সেল কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে সেটা অন্ধকার হয়ে যেতে পারে। এগুলো সংশোধন করা হয় স্যাচুরেশন কন্ট্রোল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

দ্বিতীয় ধাপ

এ ধাপে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যালিব্রেশন করতে হয়। এর নাম ফ্ল্যাট ফিল্ড দিয়ে ভাগ দেওয়া। ইতিমধ্যে আপনারা জেনেছেন যে ক্যামেরায় পৌঁছানোর আগে আলোকে বেশ কয়েকটি আয়না পাড়ি দিতে হয়। পুরো পথে কোনো সমস্যা থাকলে, যেমন কোনো আয়নাতে ধুলা বা অন্য গঠনগত সামান্য ত্রুটি থাকলে, সেটা ছবিতে ধরা পড়বে। আবার আকাশের যেদিকে ছবি তোলা হচ্ছে, কোনো কারণে সেদিকে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত আলো থাকলে, সেটাও ছবিতে সমস্যা তৈরি করবে। ভূপৃষ্ঠের টেলিস্কোপের জন্য ফ্ল্যাট ফিল্ড করা অনেক বেশি জরুরি। বায়ুমণ্ডলের কারণে টেলিস্কোপে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস ঢুকে পড়ে। কিন্তু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে বায়ুমণ্ডলজনিত ঝামেলা হবে না। তাই টেলিস্কোপের ভেতর আলোর পথে কোনো সমস্যা থাকলে সেটা বাদ দিতে হয়। ফ্ল্যাট ফিল্ড বের করতে হলে কোনো সুষম উজ্জ্বল আলোক উৎসের ছবি তুলতে হয়। আর সেই ছবিতে তখন কোনো স্ট্রাকচার দেখা যেতে পারে। এরপর সব ছবিকে ফ্ল্যাট ফিল্ডের ছবি দিয়ে ভাগ করতে হয়। অর্থাৎ ছবির কোনো পিক্সেলের মানকে ফ্ল্যাট ফিল্ডের ওই পিক্সেলের মান দিয়ে ভাগ করলেই সমস্যা মিটে যায়। দ্বিতীয় ধাপে ছবির পিক্সেলের সঙ্গে আকাশের কোন অংশের ছবি, তার কো–অর্ডিনেটের তথ্য যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া কোনো টার্গেট অবজেক্টের ব্যাকগ্রাউন্ড জানা থাকলে সেটাও বাদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ছবি ও স্পেকট্রোস্কপি–ভেদে আরও বিভিন্ন ক্যালিব্রেশনের কাজ করা হয়।

তৃতীয় ধাপ

এটি ক্যালিব্রেশনের শেষ ধাপ এবং এই ধাপে যন্ত্রভেদে আরও কিছু ক্যালিব্রেশন করা হয়। যেমন একসঙ্গে তোলা কয়েকটি ছবির মধ্যে রিলেটিভ কো–অর্ডিনেট সিস্টেম বসাতে হয়। এ ছাড়া দ্রুতগতির কোনো টার্গেটের জন্য কো–অর্ডিনেট সিস্টেম বসানো, আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ড মেলানো, কোনো আউটলায়ার (আগে-পরের ছবিগুলোর তুলনায় অনেক ভিন্ন) ছবি থাকলে সেটা বাদ দেওয়া, সিসিডির এক্সপোজার লেভেলের তথ্য আপডেট করা, একই টার্গেটের অনেকগুলো ছবি তোলা হলে তা অ্যালাইন করা, স্পেকট্রোস্কপির ক্ষেত্রে বর্ণালির আকার বা ফ্রিঞ্জ প্যারামিটার ঠিক করা ও নয়েজ হিসাব করা ইত্যাদি।

সব ঠিকঠাক কাজ করছে কি না, তা নিশ্চিত করতে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ নিয়মিত জানা কিছু টার্গেটের ছবি তুলবে ও স্পেকট্রোস্কপি করবে। সেই ফলাফল আমাদের জানা ফলাফলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে—ঠিকঠাক উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে কি না। এই ধাপগুলো ঠিকঠাক সম্পাদন করা হলে স্পেকট্রোস্কপির জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্ত চলে আসে। সরাসরি ছবি থেকে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের উজ্জ্বলতা মেপে নেওয়া যায়। তবে তখনো ক্যামেরার ছবি থেকে বিন্দু বা বৃত্তাকার তারার উজ্জ্বলতা পাওয়ার ধাপ বাকি।

এরপরের কাজ হলো ছবিতে থাকা বিভিন্ন জিনিসের উজ্জ্বলতা মাপা। আকাশের বেশির ভাগ জিনিসই মোটামুটি গোলাকার। তাই এগুলোকে বৃত্তাকার ধরে উজ্জ্বলতা মাপার কাজ করা হয়। একে বলে ফটোমেট্রি। ফটোমেট্রি করার দুটি উপায় আছে। সহজ উপায়টির নাম অ্যাপারচার ফটোমেট্রি। ছবিতে কোনো উজ্জ্বল টার্গেটের বাইরে একটি গোল রিং এবং আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ড বোঝাতে আরও দুটি রিং (একসঙ্গে বলা হয় অ্যানালাস) বসাতে হয়। এরপর প্রোগ্রাম মূলত গণনা করে যে ব্যাকগ্রাউন্ডের পরিমাণ বাদ দিলে ভেতরের রিংয়ের পিক্সেলে কত ইউনিট আলো এসেছে। এরপর সেটাকে জানা কোনো তারার মানের সঙ্গে তুলনা করে অথবা সরাসরি ফ্লাক্স হিসাব করে উজ্জ্বলতা মাপা হয়। তবে পুরো কাজটি চাইলে প্রোগ্রামিং করে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে করা যায়। অ্যাপারচার ফটোমেট্রি বেশির ভাগ সময়ই বেশ ভালো কাজ করে। তবে যদি কাঙ্ক্ষিত বস্তুর আশপাশে আরও অনেক উজ্জ্বল বস্তু থাকে, যেমন স্টার ক্লাস্টার কিংবা যুগল তারা—এগুলো বৃত্তাকার হয় না। সে ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ভালো কাজ করে না। তখন গাণিতিক মডেলিংয়ের সাহায্যে হিসাব করতে হয়। এর নাম পিএসএফ বা পয়েন্ট স্প্রেড ফটোমেট্রি। তবে পিএসএফ ফটোমেট্রি করতে উচ্চ কম্পিউটিং ক্ষমতার দরকার হয়। ফটোমেট্রি করার পরে অবশেষে বিজ্ঞানীদের কাছে ব্যবহারযোগ্য উপাত্ত চলে আসে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (KAIST), দক্ষিণ কোরিয়া; গবেষক, ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমি, নিকোলাস কোপার্নিকাস ইউনিভার্সিটি, পোল্যান্ড।

সূত্র: জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ - User Documentation

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর ২০২১ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়।