আমরা পৃথিবী বলতে বুঝি যেখানে আমরা বাস করি। পৃথিবী অনেক বড় একটি গোলক, একটু এবড়োখেবড়ো। শূন্যে ভেসে আছে। এখানে আছে মাটি, পানি, বাতাস, গাছপালা, বায়ুমণ্ডল, আর মাথার ওপরে আছে আকাশ। আকাশে রাতের বেলা অনেক তারা দেখা যায়। আমাদের দৃষ্টিতে পৃথিবীকে অনেক বড় মনে হয়। কারণ আমাদের তুলনায় পৃথিবী অনেক বড়। আবার সূর্যের তুলনায় পৃথিবী অনেক ছোট। পৃথিবী কতটা ছোট বা কতটা বড় এবং মহাবিশ্বে এর অবস্থান কোথায় এগুলো বলতে গেলে একটু মাপজোখ সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার।
মাপজোখ সম্পর্কে ধারণা পেতে প্রথমেই শুরু করি দৈর্ঘ্য নিয়ে। আমরা আমাদের উচ্চতা মাপি ফুটে, যেমন কারও উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। রাস্তা মাপি কিলোমিটারে, ১ কিলোমিটার মানে ১ হাজার মিটার। আবার বিল্ডিংয়ের উচ্চতা মাপি তলা দিয়ে, আমরা সাধারণত বলি না একটি বিল্ডিংয়ের উচ্চতা ৪০ ফুট বা ১৩ মিটার। আমরা বলি চারতলা বা দশতলা বিল্ডিং। দেশের সব বিল্ডিংয়ের প্রতিটি তলার উচ্চতা কিন্তু সমান নয়। তারপরও বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে তলা শব্দটি যথেষ্ট অর্থ বহন করে।
দৈর্ঘ্য মাপের একক হলো ১ মিটার, অন্য একটি একক হলো ফুট। এখানে শুধু মিটার নিয়েই কথা বলব। ১ মিটার মানে কত দৈর্ঘ্য, তা ঠিক করার জন্য প্রথমে আলোর বেগ ঠিক করা হয়েছে, শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ হলো ২৯৯৭৯২৪৫৮ মিটার/সেকেন্ড (প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার/সেকেন্ড, এখানে ৩ লাখ কিলোমিটার/সেকেন্ড বলব)। অর্থাৎ শূন্য মাধ্যমে আলো ১ সেকেন্ডে ২৯৯৭৯২৪৫৮ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। ১ মিটার দৈর্ঘ্যের মানে হলো যে দূরত্ব আলো শূন্য মাধ্যমে ১/২৯৯৭৯২৪৫৮ সেকেন্ডে অতিক্রম করে, যা কিনা আমাদের দুই হাতের কাছাকাছি। কারও উচ্চতা যদি ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি হয়, তাহলে তার উচ্চতা মিটারে হবে ১.৭৩-এর কাছাকাছি। মিটারকে ১ হাজার দিয়ে গুণ করে বলা হয় কিলোমিটার। রাস্তা, কাপড়...ইত্যাদি মাপতে মিটার ব্যবহার করা হলেও মানুষের উচ্চতার ক্ষেত্রে ফুট ব্যবহার করা হয়। এগুলো সবই অভ্যস্ততার ব্যাপার, যেমন বিল্ডিংয়ের উচ্চতা বোঝানো হয় তলার হিসাবে।
দূরত্বের একক আমরা বুঝে ফেলেছি। এখন ফিরে যাই আগের কথায়। সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। পৃথিবীর নিজের আকার (আকার বলতে ব্যাস বোঝানো হয়েছে। ব্যাস হলো গোলকের এক প্রান্ত থেকে কেন্দ্র দিয়ে অন্য প্রান্তের দূরত্ব) হলো প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার। আপাতদৃষ্টিতে পৃথিবীকে এবড়োখেবড়ো মনে হলেও অনেক দূর থেকে পৃথিবী দেখতে গোল। যেমন চাঁদ ও সূর্যকেও দেখতে গোল লাগে। ১৫ কোটি কিলোমিটারের তুলনায় ১৩ হাজার কিলোমিটার কিছুই নয় (অন্যভাবে বলি, কেউ যদি কারও কাছে ১৫ কোটি টাকা পায়, সে দেনাদারের কাছে টাকাটা নিতে গেলে দেনাদার বলল, আমার কাছে ১৫ কোটি টাকা নেই, ১৩ হাজার টাকা কম আছে, তাহলে পাওনাদার কী করবে)। সুতরাং সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের তুলনায় পৃথিবীর আকার একেবারেই অল্প। শুধু কি তাই, সৌরজগৎ বলতে যদি সূর্য থেকে প্লুটো পর্যন্ত ধরি, তাহলে পৃথিবী একটি বিন্দুর মতো। আর সূর্য তো একটি নক্ষত্র, যা কিনা মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা নামে একটি গ্যালাক্সিতে (ছায়াপথ) আছে। মিল্কিওয়ের তুলনায় পৃথিবী তাহলে কতটুকু? এটা বুঝতে গেলে দূরত্ব মাপতে হবে অন্যভাবে।
মিটার বা কিলোমিটারে পৃথিবীতে দৈর্ঘ্য মাপা গেলেও মিল্কিওয়ে ছায়াপথের ভেতর পৃথিবীর অবস্থান বোঝানোর ক্ষেত্রে এটা খুবই ছোট একটি একক। আমরা মাপজোখের ক্ষেত্রে ছোট ছোট সংখ্যা ব্যবহার করতে চাই (যেমন ১৫ হাজার মিটার না বলে ১৫ কিলোমিটার বলি)। সে জন্য অন্যান্য কিছু একক ব্যবহার করা হয়ে থাকে, এ রকম একটি একক হলো আলোকবর্ষ। বর্ষ বা বছর হলো সময়ের একক, এর সামনে আলোক শব্দটি ব্যবহার করলে এটা দূরত্বের পরিমাপ হয়ে যায় (বেগকে সময় দিয়ে গুণ করলে দূরত্ব পাওয়া যায়)। একইভাবে মিনিট, সেকেন্ড এগুলো সময়ের একক, কিন্তু আলোক মিনিট বা আলোক সেকেন্ড দিয়ে দূরত্ব বোঝানো হয়। আলো ১ সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার যায়। ১ আলোক সেকেন্ড মানে হলো ৩ লাখ কিলোমিটার। ১ আলোক মিনিট হলো আলো যে দূরত্ব ১ মিনিটে যায়, ৬০x৩ লাখ কিলোমিটার, ১ কোটি ৮০ লাখ কিলোমিটার। ১ আলোকবর্ষ হলো আলো এক বছরে যে দূরত্ব যায়, এক বছরে সেকেন্ডের সংখ্যা হলো ৩৬৫x২৪x৬০x৬০। এখন একে ৩ লাখ কিলোমিটার/সেকেন্ড দিয়ে গুণ করলেই এক আলোকবর্ষ পাওয়া যাবে। এটা প্রায় ৯৪৬০৮০০০০০০০০ কিলোমিটার। আলোকবর্ষ একটি হতচ্ছাড়া নম্বর, একে নিয়ে ভাবার কোনো দরকার নেই। শুধু মনে রাখতে হবে আলোকবর্ষ হলো আলো যে দূরত্ব এক বছরে যায়।
সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় সাড়ে আট আলোক মিনিট। অর্থাত্ সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় নেয় সাড়ে আট মিনিটের মতো। একটু কল্পনা করি। ধরা যাক, সূর্যে একটি আয়না আছে। আমি পৃথিবীতে থেকেই সেই আয়নার সামনে দাঁড়ালাম, তাহলে আয়নায় আমাকে দেখতে পাব ১৭ মিনিট পর। আয়নার সামনে দাঁড়ানো মাত্র আমার গায়ের প্রতিফলিত আলো সূর্যের দিকে যেতে থাকবে। যেতে সময় লাগবে সাড়ে আট মিনিট। আয়না থেকে প্রতিফলিত আলো আমার চোখে ফিরে আসতে আরও সাড়ে আট মিনিট লাগবে। তাহলে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর ১৭ মিনিট পর আমাকে আমি আয়নায় দেখতে পাব। আলোর গতিবেগের সাপেক্ষে পৃথিবীর পৃথিবীর ব্যাস, ১ আলোক সেকেন্ডের ২৩ ভাগের ১ ভাগ। এই পরিমাণ দূরত্ব যেতে আলোর সময় লাগে ১ সেকেন্ডের ২৩ ভাগের ১ ভাগ। এই সময়টা আমরা উপলব্ধি পর্যন্ত করতে পারি না, আমাদের অনুভূতির জন্য এটা এত কম সময়!
সূর্য থেকে প্লুটোর দূরত্ব পর্যন্ত সৌরজগতের সীমানা ধরলে এর দূরত্ব দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৫ আলোকঘণ্টা। যার তুলনায় আমাদের পৃথিবী কিছুই নয়। রাতের আকাশের দিকে তাকালে তারাগুলোকে খুব কাছাকাছি মনে হয়। আসলে তা নয়। তারারা একটি থেকে আরেকটি অনেক অনেক দূরে আছে। যেমন আমাদের সবচেয়ে কাছের তারা হলো সূর্য। এরপর সবচেয়ে কাছের তারাটি প্রায় ৪ আলোকবর্ষ দূরে আছে। তার মানে সেখানে একটি আয়না কল্পনা করে আমি ওর সামনে দাঁড়ালে ৮ বছর পর সেই আয়নায় নিজেকে দেখতে পাব। চার বছর লাগবে আমার থেকে আলোর আয়নায় যেতে, বাকি চার বছর লাগবে আয়না থেকে আমার চোখে আলো আসতে।
এখন গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের সাপেক্ষে পৃথিবীর অবস্থান ব্যাখ্যা করা যাবে। সূর্য আছে ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে অনেক অনেক দূরে। ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে সূর্যের দূরত্ব হলো প্রায় ২৬ হাজার আলোকবর্ষ। অর্থাৎ আমরা আজ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে যা দেখছি, তা আসলে ২৬ হাজার বছর আগের ঘটনা। গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আলোর যেতে সময় লাগে প্রায় ১ লাখ বছর। একটি ছায়াপথ এত বড়! একটি ছায়াপথের আকারের তুলনায় সৌরজগতের আকার কিছুই না। কোথায় ১ লাখ বছরের হিসাব আর কোথায় সাড়ে ৫ ঘণ্টার হিসাব। দুটো ছায়াপথের মাঝে অনেক ফাঁকা জায়গা থাকে। ছায়াপথরা আবার একত্র হয়ে ছায়াপথপুঞ্জ তৈরি করে। ছায়াপথপুঞ্জে সাধারণত এক শ থেকে এক হাজারটা ছায়াপথ থাকে। ছায়াপথপুঞ্জের আকার প্রায় কোটি আলোকবর্ষের কাছাকাছি। ছায়াপথপুঞ্জরা আবার ছায়াপথ মহাপুঞ্জ তৈরি করে। এদের আপাত সাইজ ১০ কোটি আলোকবর্ষের কাছাকাছি। কোটিখানেক ছায়াপথ মহাপুঞ্জ মিলেই আমাদের এই মহাবিশ্ব। একটি বিশেষ হিসাবে ধারণা করা হয়, এই পুরো মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে আলোর সময় লাগবে ১০ হাজার কোটি বছর। মহাবিশ্ব এত বড়! মহাবিশ্বের তুলনায় একটি ছায়াপথের আকৃতি কিছুই নয়। সেই তুলনায় আমাদের পৃথিবীর আকার মাত্র ১ আলোক সেকেন্ডের ২৩ ভাগের ১ ভাগ। তার মানে মহাবিশ্বে দূরে থাক, আকৃতির দিক থেকে আমাদের ছায়াপথেই পৃথিবীর অবস্থান তিল পরিমাণও নয়।
এখন দেখা যাক ভরের দিক থেকে। এখানেও আমাদের ভরের তুলনায় পৃথিবীকে অনেক ভারী মনে হয়। ভর মাপা হয় কেজিতে। এক কেজি হলো প্লাটিনাম-ইরিডিয়ামের বিশেষ একটি সিলিন্ডারের ভর। সেটার উচ্চতা এবং ব্যাস দুটোই ৩.৯ সেন্টিমিটার (১ মিটারের ১০০ ভাগের ১ ভাগকে ১ সেন্টিমিটার বলে)। এই এককে কারও ভর ৮৪ কেজির মানে হলো ৮৪টি সিলিন্ডারের সম্মিলিত ভর আর তার ভর সমান। পৃথিবীর ভর, সমুদ্র ও বায়ুমণ্ডলসহ প্রায় ৬-এর পর ২৪টি শূন্য দিলে যে সংখ্যা দাঁড়ায় তত কেজি। আর সূর্যের ভর ২-এর পর ৩০টি শূন্য দিলে যে সংখ্যা দাঁড়ায় তত কেজি। এগুলো নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই, অনেক অনেক বড় সংখ্যা এটা বুঝলেই চলবে। কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারি, ভরের দিক থেকে পৃথিবীর তুলনায় সূর্য প্রায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার গুণ। সূর্যের তুলনায় পৃথিবী একেবারেই নগণ্য (৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকার সঙ্গে ১ টাকার তুলনা)! মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ভর কেজিতে মাপতে গেলে কিছুই বোঝা যাবে না। সে ক্ষেত্রে সূর্যের ভরকে একক হিসাবে ধরে হিসাব করা যেতে পারে। সেই হিসাবে মিল্কিওয়ের ভর প্রায় ৬০০ কোটি সূর্যের ভরের সমান। যে ভরের বেশির ভাগই আছে ছায়াপথের কেন্দ্রের দিকে। তার মানে মিল্কিওয়ে ছায়াপথের ভরের তুলনায় সূর্যের ভর একেবারেই কিছুই নয় (৬০০ কোটি টাকার সঙ্গে ১ টাকার তুলনা)। সেখানে পৃথিবী দূরে থাক, সূর্যের ভরের সঙ্গে ছায়াপথের ভরের তুলনা করাও একেবারেই অর্থহীন।
এগুলো বলার মানে হলো আকার ও ভরের দিকে থেকে পৃথিবী আসলে কিছুই না। এখন দেখি অন্যভাবে। বৈচিত্র্যের দিক থেকে। পৃথিবী এমন একটি গ্রহ যেখানে প্রাণ আছে; উদ্ভিদ ও প্রাণী! পৃথিবীতে অনেক ধরনের উদ্ভিদ আছে, অনেক ধরনের প্রাণ আছে। এদের বৈচিত্র্যে পৃথিবী ভরপুর। এক দলা পচা মাটি নিলেও সেখানে অনেক কিছুই আছে, প্রাণের নানা বৈচিত্র্য। মহাবিশ্বের অন্য কোথাও প্রাণ থাকলেও পৃথিবীর একটি বিশেষ অবস্থান থেকেই যায়। আর মহাবিশ্বের অন্য কোথাও প্রাণ না থাকলে পৃথিবীর অস্তিত্বই মহাবিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আকার বা ভরের দিক থেকে যা-ই হোক না কেন। এই প্রাণের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হলো মানুষ। মানুষ অনেক দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ। এর একটি হলো ভাবতে পারা। মানুষ ভাবতে পারে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর লাগে। আকাশের মেঘ, সমুদ্রের ঢেউ, ফুলের রং...এগুলো সবই ভালো লাগে।
আমাদের বাড়ির চারদিকে অনেক ধরনের গাছ থাকে। সবার বাড়িতেই কমবেশি গাছ আছে বলে আমরা অত ভালো করে খেয়াল করি না বা আমরা ভাবতে চাই না। এখন একটু ভাবার চেষ্টা করি। শুরু করি আমগাছ থেকে। আমের আঁটি থেকে আমগাছের জন্ম হয়। প্রথমে দুটো পাতা থেকে শুরু হলো। তারপর কয়েক বছর লাগে গাছটি বড় হতে। গাছটি যথেষ্ট বড় হলে বছরের একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে গাছে মুকুল আসে, আম ধরে, আম পাকে...। এমন করেই গাছটি বড় হতে থাকে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার পর আমগাছ আর বড় হয় না এবং একসময় আমগাছটি মরে যায়। অন্য সবকিছুর বেলায়ও এ রকম একটি নিয়ম দেখা যায়। শুধু কি তাই, একই মাটিতে আমগাছ আছে, পাশেই জামগাছ, লিচুগাছ, কাঁঠালগাছ, মাকাল ফলের গাছ ইত্যাদি আছে। কিন্তু ওদের প্রত্যেকের নিয়মই আলাদা, আমগাছে আম ধরে, জামগাছে জাম ধরে, মাকাল গাছে মাকাল ফল ধরে। এই নিয়মগুলো প্রতিটি গাছই বংশপরম্পরায় মেনে চলে। একইভাবে প্রাণিজগতের দিকে তাকালেও সুন্দর সুন্দর নিয়মে আমাদের বিস্মিত হতে হয়।
প্রাণিজগতের মতো জড়জগত্ও অনেক বৈচিত্র্যময়। পৃথিবীর অবস্থান সূর্য থেকে যে দূরত্বে তাতে এখানে দিনের বেলায় তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়ার কথা, এই তাপমাত্রায় পানি ফুটতে থাকে। এত বেশি তাপমাত্রায় বর্তমান অবস্থায় প্রাণ টিকতে পারবে না। আর রাতের বেলায় থাকতে পারত শূন্যের নিচে দেড় শ ডিগ্রি, যা কিনা ডিপ ফ্রিজের ভেতরের তাপমাত্রার কাছাকাছি। এত কম তাপমাত্রাতেও বর্তমান প্রাণ টিকতে পারবে না। পৃথিবীর চারদিকে আছে বায়ুমণ্ডল, যার কারণে সূর্য থেকে যে আলো আসে, তার বেশির ভাগই প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায়। আর যে আলোটুকু প্রবেশ করে, সেটুকু ঠিকভাবে ছড়িয়ে যায়। ফলে, পৃথিবীর তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকে (যা আবার অঞ্চলের ও ঋতুর ওপরও নির্ভর করে, বিষুব অঞ্চলে মোটামুটি ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি)। বায়ুমণ্ডল অনেকটা শীতের দিনের লেপের মতো কাজ করে। আবার বায়ুমণ্ডলের তাপ পরিবহনক্ষমতা একটু বেশি হলে পর্বত ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যেত। এতে পৃথিবীর অনেক দেশই তলিয়ে যেতে পারত।
সূর্যের টানে প্রতিনিয়ত উল্কা ছুটে আসছে। বৃহস্পতি ও শনির ভর পৃথিবীর তুলনায় অনেক বেশি এবং এই দুটো গ্রহ আছে সূর্য থেকে পৃথিবীর বাইরের দিকে। ফলে বড় বড় উল্কারা এলে শনি বা বৃহস্পতির সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত ছুটে আসছে আয়ন (চার্জযুক্ত কণিকা), যা পৃথিবীর চুম্বক বলের কারণে আবার প্রতিফলিত হচ্ছে। এত কিছু কেন ঘটছে? কীভাবে ঘটছে, এগুলো ভাবতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলতে হয়।
পৃথিবী আকাশের দিকে কিছুটা হেলে আছে। এ কারণে প্রতিদিন দিন ও রাতের হিসাবে পার্থক্য আসছে, ঋতুর পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিদিন আকাশই ভিন্ন। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, প্রতি সেকেন্ডে যায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার। হাইওয়েতে গাড়ির বেগ সাধারণত ১০০ কিলোমিটার/ঘণ্টা, সেই তুলনায় সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর বেগ হলো প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার কিলোমিটার/ঘণ্টা (এত বেগে প্লেনও চলে না, প্লেনের বেগ প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার/ঘণ্টা। পৃথিবীর মতো এত বেগে প্লেন চললে ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক যেতে সময় লাগবে ১১ মিনিটের মতো। আকাশপথে ঢাকা থেকে নিউইয়র্কের দূরত্ব প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার)। সূর্যও কিন্তু বসে নেই, সূর্য ঘুরছে গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে, প্রায় ৮ লাখ কিলোমিটার/ঘণ্টা বেগে (এই বেগে ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক যেতে সময় লাগবে মাত্র দেড় মিনিটের মতো)।
এত বৈচিত্র্য কি শুধু পৃথিবীতেই? একেবারেই না, পৃথিবীর বাইরেও অনেক বৈচিত্র্য! মহাবিশ্বে আসলে কি আছে? গ্রহ, নক্ষত্র, উপগ্রহ, নিউট্রন স্টার, ব্ল্যাকহোল, নীহারিকা, ছায়াপথ ইত্যাদি। কীভাবে ছায়াপথের জন্ম হচ্ছে, ছায়াপথ ছায়াপথে ধাক্কা লাগলে কী হয়, তারার জন্মকথা, কৃষ্ণগহ্বর কৃষ্ণগহ্বরে ধাক্কা খেলে শক্তিশালী মহাকর্ষ তরঙ্গের জন্ম হয়। এগুলোও অনেক বৈচিত্র্যময় (এসব ঘটনা ঘটে সাধারণত লাখ কোটি বছরে, আমাদের পৃথিবীর ঘটনা ঘটে বছরের হিসাবে, যেমন আমগাছে আম ধরা)। এই বৈচিত্র্যের মূল কথাটাই হলো আমাদের ভাবতে পারার শক্তি। আমরা ভাবতে পারি বলেই আমাদের কাছে মহাবিশ্ব এত বৈচিত্র্যময়। তার মানে বৈচিত্র্যের মূলেই আছে ভাবতে পারা। সে ক্ষেত্রে কি আমরা বলতে পারি না, মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বিষয় হলো আমাদের ভাবতে পারার শক্তি!
লেখক: অধ্যাপক, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা