ডার্ক ম্যাটারে তৈরি নক্ষত্র আবিষ্কার?

সম্প্রতি দুই জ্যোতির্বিদ ডার্ক ম্যাটারে তৈরি বোসন নক্ষত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। এটি এখনো প্রমাণিত নয়। তবে গায়া স্যাটেলাইটের পর্যবেক্ষণকৃত তথ্য সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। এই সম্ভাবনা কি সত্যি হতে পারে?

ছবি: নাসা
সম্ভাবনা আছে, এটি একটি ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর হতে পারে। তবে আলেক্সান্দ্রে এম পোম্বো এবং ইপোক্রেটিস ডি সল্টাস নামে দুই জ্যোতির্বিদ দাবি করেছেন, এটি বোসন নক্ষত্র হতে পারে। এ ধরনের কোনো নক্ষত্র আগে দেখা যায়নি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই বোসন নক্ষত্রটি ডার্ক ম্যাটারে তৈরি

সম্প্রতি দুই জ্যোতির্বিদ ডার্ক ম্যাটারে তৈরি নক্ষত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। এ ধরনের অতিদুর্লভ নক্ষত্রদের বলা হয় ‘বোসন নক্ষত্র’। গত ১৮ এপ্রিল এক প্রি-প্রিন্ট সার্ভারে তাঁরা একটি গবেষণাপত্রে এ দাবি করেছেন।

ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা বা ইসার গায়া স্যাটেলাইট অদ্ভুত একধরনের যুগ্ম নক্ষত্র ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছে। এই দুটি নক্ষত্রের একট সূর্যের মতো। আরেকটি নক্ষত্র কী, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। তবে সম্ভাবনা আছে, এটি একটি ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর হতে পারে। তবে আলেক্সান্দ্রে এম পোম্বো এবং ইপোক্রেটিস ডি সল্টাস নামে দুই জ্যোতির্বিদ দাবি করেছেন, এটি বোসন নক্ষত্র হতে পারে। এ ধরনের কোনো নক্ষত্র আগে দেখা যায়নি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই বোসন নক্ষত্রটি ডার্ক ম্যাটারে তৈরি।

যুগ্ম নক্ষত্র ব্যবস্থার সূর্যের মতো নক্ষত্রটির ভর সূর্য থেকে খানিকটা কম। ০.৯৩ সৌরভরের সমান। এর রাসায়নিক গঠনও সূর্যের মতো। তবে এর অদেখা সঙ্গীর ভর প্রায় ১১ সৌরভরের মতো। নক্ষত্র দুটি একে অন্যকে ১.৪ এইউ দূর থেকে প্রদক্ষিণ করছে। ১ এইউ বা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট মানে ১.৫৮৩×১০-৫ আলোকবর্ষ বা ১.৫ ১০১১ মিটার। এ হিসেবে নক্ষত্র দুটোর দূরত্ব মঙ্গল থেকে সূর্যের দূরত্বের সমান।

অদেখা এই সঙ্গী আসলে কী? আগেই বলেছি, এটি কৃষ্ণগহ্বর হতে পারে। তবে এই হাইপোথিসিসের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। অনেক ভারী কোনো নক্ষত্রের মৃত্যুর ফলে সৃষ্টি হয় কৃষ্ণগহ্বর। তার মানে, সূর্যের মতো এই নক্ষত্রটিকে অমন ভারী কোনো নক্ষত্রের সঙ্গে জোড় বাঁধতে হবে। সেটা অসম্ভব নয়, তবে খুবই অস্বাভাবিক। অনেকখানি ফাইন টিউনিং, অনেক অদ্ভুত ঘটনা একসঙ্গে ঘটলেই কেবল এমনটা হওয়া সম্ভব। তার ওপর নক্ষত্রদুটি এখন যেভাবে একে অন্যকে প্রদক্ষিণ করছে, সেভাবে তাদের এত লাখো কোটি বছর ধরে সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে ধরে রাখার বিষয়টিও অনেক জটিল। সেজন্যই এই দুই জ্যোতির্বিদ দাবি করছেন, এটি ডার্ক ম্যাটার কণা দিয়ে গঠিত নক্ষত্র হতে পারে।

আমরা জানি, প্রতিটি গ্যালাক্সির ভরের একটা বড় অংশ গড়ে উঠেছে ডার্ক ম্যাটার দিয়ে। অদেখা এই বস্তুগুলোর পরিচয় আমাদের আজও অজানা। কারণ, এরা আলো বা আর কিছুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে না। বেশির ভাগ তাত্ত্বিক মডেল অনুযায়ী, প্রতিটি গ্যালাক্সির নানা প্রান্তে সুষমভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ডার্ক ম্যাটার। তবে প্রান্তীয় অংশেই এদের পরিমাণ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা এ ধরনের প্রান্তীয় অংশকে বলেন ডার্ক ম্যাটার হ্যালো। তবে কিছু কিছু মডেল বলে, ডার্ক ম্যাটার এরকম একসঙ্গে মিলে বড় বস্তুও গঠন করতে পারে।

এ ধরনের একটি মডেল বলে, ডার্ক ম্যাটার আসলে নতুন একধরনের বোসন। এমনিতে বোসন হলো বলের কণা। যেমন ফোটন একধরনের বোসন। এটি তড়িৎচুম্বক বলের বাহক। বর্তমান কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত মডেল শুধু অল্প কিছু বোসনের কথা বলে। তবে তাত্ত্বিকভাবে, এর বাইরে অন্য ধরনের বোসন থাকতেই পারে। এ সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেওয়ার কোনো উপায় নেই।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

সে হিসেবে ডার্ক ম্যাটারে তৈরি বোসন নক্ষত্রেরাও হবে অদৃশ্য। শুধু মহাকর্ষীয় প্রভাব ছাড়া আর কোনোভাবে এদের অস্তিত্ব শনাক্ত করা সম্ভব নয়। সে হিসেবে সাধারণ কোনো নক্ষত্র এ ধরনের বোসন নক্ষত্রের সঙ্গে মিলে যুগ্ম ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই পারে। সেক্ষেত্রে বোসন নক্ষত্রটিকে স্পিন-০ বা স্পিন-১ বোসন কণা দিয়ে তৈরি হতে হবে। তা ছাড়া, এই দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, এর মাধ্যমে গায়া স্যাটেলাইটের পর্যবেক্ষণকৃত ডেটাকে ব্যাখ্যাও করা যায় সফলভাবে।

অবশ্যই, এটি এখনো কেবলই হাইপোথিসিস। আমাদের হাতে তথ্য আছে, সেই তথ্যকে ব্যাখ্যা করার মতো একাধিক হাইপোথিসিসও আছে। একটি বলছে, এই অদেখা বস্তুটি কৃষ্ণগহ্বর হতে পারে। অন্যটি বলছে বোসন নক্ষত্রের কথা। কোনোটিকে বেশি সঠিক দাবি করার উপায় নেই, অন্তত এখনো। তবে বোসন নক্ষত্র হবেই, এমনটা আশা করছেন না বিজ্ঞানীরা। এটি এখনো কেবলই দূর সম্ভাবনা।

সে যাই হোক, এই অদ্ভুতুড়ে নক্ষত্রজোড় কিন্তু বিজ্ঞানীদের বেশ রোমাঞ্চিত করছে। কারণ, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে আরও একবার পরীক্ষার মুখে ফেলেছে এটি। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে এ নিয়ে গবেষণা করছেন। দেখছেন, এ তত্ত্ব এই নক্ষত্র ব্যবস্থাটির কক্ষীয় গতিসহ অন্যান্য বিষয় ব্যাখ্যা করতে পারে কি না। সেই সঙ্গে এটি কৃষ্ণগহ্বর হোক বা নতুন ধরনের ডার্ক ম্যাটার নক্ষত্র—ভবিষ্যতে মহাকাশ গবেষণায় এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলেই বিজ্ঞানীদের আশা।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, উইকিপিডিয়া, এআরএক্সআইভি ডট অর্গ