কেপলার টুটুবি সৌরজগতের গ্রহ হলে কী হতো?

কেপলার-২২বিউইকিপিডিয়া

সৌরজগতে জীবন ধারণের উপযোগী একমাত্র গ্রহ পৃথিবী। অন্তত এখন পর্যন্ত আমরা মহাকাশ সম্পর্কে যা জানি, তাতে এ কথা বলা যায়। আজকে আমরা কল্পনা করার চেষ্টা করব, সৌরজগতে আরেকটি বাসযোগ্য গ্রহ থাকলে কেমন হতো। কী হতো গ্রহটা কেপলার টুটুবি হলে? আর গ্রহটার অবস্থান সৌরজগতের বাসযোগ্য অঞ্চলে হলেই-বা কী হতো? কীভাবে সেখানে যেতাম আমরা? সেখানে কি প্রাণের সন্ধান পেতাম? মহাজাগতিক এক প্রতিবেশি পেলে বিষয়টা আসলে কী দাঁড়াত? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করব এ লেখায়।

পৃথিবী থেকে প্রায় ৬৩৫ আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ কেপলার-২২বি। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনিও আছে এর নামে—কেপলার টুটুবি। এর বিশেষত্ব বলতে, সূর্যের মতো এক নক্ষত্রের বাসযোগ্য অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া প্রথম এক্সোপ্ল্যানেট এটি। হয়তো বুঝতে পারছেন, পৃথিবীর সঙ্গে এর মিল নানাদিক থেকে। পৃথিবীর মতোই গ্রহটির পৃষ্ঠে তরল পানি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যদিও গ্রহটির গঠন পাথুরে, গ্যাসীয় নাকি তরল—তা এখনও আমাদের অজানা। তবে গ্রহটি যে অনেক বড়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীর তুলনায় আকারে প্রায় ২.৫ গুণ বড়, আর ভর পৃথিবীর প্রায় ৯.১ গুণ!

২.

কেপলার-২২বি তার নক্ষত্রকে বেশ কাছ থেকে প্রদক্ষিণ করে। নিজ নক্ষত্র থেকে গ্রহটির গড় দূরত্ব প্রায় সাড়ে ১২ কোটি কিলোমিটার। সৌরজগতের সঙ্গে তুলনা করলে পৃথিবী ও শুক্র গ্রহের মাঝামাঝি জায়গায় হতো কেপলার টুটুবির অবস্থান। রাতের আকাশে পৃথিবী থেকে দেখা যেত অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য। পূর্ণ চাঁদের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি বড় দেখাত গ্রহটি।

আমাদের সূর্য কিছুটা বেশি উষ্ণ হতো গ্রহটির জন্য। এর বর্তমান নক্ষত্রের তাপমাত্রা সূর্যের চেয়ে খানিকটা কম। সূর্যের অতিরিক্ত তাপের কারণে এখানকার বায়ুমণ্ডল এত উষ্ণ হতো যে সেখানে জীবের বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে যেত।

তবে কেপলার টুটুবিকে যে এই কক্ষপথেই থাকতে হবে, তা নয়। কাল্পনিক এই দৃশ্যপটে আমরা চাইলেই এর কক্ষপথ বদলে দিতে পারি। পৃথিবী যেমন সূর্য থেকে সঠিক দুরত্বে আছে। এই গ্রহটিতে বিরাজ করছে জীবনধারণের উপযোগী তাপমাত্রা। পৃথিবীর কক্ষপথে কেপলার-২২বির অবস্থান হলে এটির তাপমাত্রাও হতো পৃথিবীর মতো। ঝামেলা হলো, পৃথিবীর সঙ্গে গ্রহটি কক্ষপথ শেয়ার করতে চাইলে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় থাকতে হতো। এ জায়গাগুলোর নাম ‘ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট’। পৃথিবী আর সূর্যের মহাকর্ষের মাঝে, পৃথিবীর কক্ষপথের ওপরে এ জায়গাগুলো স্থিতিশীল। সূর্য বা পৃথিবীর মহাকর্ষ বল ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টে একে অন্যকে বাতিল করে দেয়। তাই গ্রহগুলো বাড়তি কোনো মোট আকর্ষণ অনুভব করে না এ স্থানগুলোতে। স্থিতিশীল কক্ষপথে থাকতে পারে।

এমন একটি ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টের অবস্থান পৃথিবীর কক্ষপথে, পৃথিবীর ঠিক উল্টোপাশে। একে ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট ‘এল৩’ বলা হয়। অর্থাৎ পৃথিবীর মতোই এই এল৩ও ঘুরতে থাকে সূর্যকে ঘিরে, এবং এটি সবসময় অবস্থান করে পৃথিবীর ঠিক বিপরীত বিন্দুতে। এখানে কেপলার টুটুবি থাকলে মাঝে থাকত সূর্য। সেক্ষেত্রে হয়তো কখনোই আমরা গ্রহটিকে দেখতে পেতাম না। তার চেয়েও বড় কথা, গ্রহটির এ অবস্থানকেও পুরোপুরি স্থিতিশীল বলা যায় না। এখান থেকে কক্ষচ্যুত হয়ে পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যেত।

এমনটা ঘটলে কী হতো, তা তো বুঝতেই পারছেন। ভবলীলা সাঙ্গ হতো দুই গ্রহেরই। এর চেয়ে গ্রহটি এল৪ বা এল৫ ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টে থাকলে সুবিধা হতো বেশি। এল৪ ও এল৫ পৃথিবী থেকে সূর্যের সংযোগ রেখার সঙ্গে ৬০ ডিগ্রি কোণে অবস্থিত। এ দুটি বিন্দু বাকি তিনটির চেয়ে বেশি স্থিতিশীল। সেজন্য বর্তমানে জেমস ওয়েব নভোদুরবিন অবস্থান করছে এল২-তে।

কেপলার টুটুবিতে পৌঁছানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হতো শুক্র গ্রহের মহাকর্ষ ব্যবহার করা। পৃথিবী থেকে মহাকাশযান শুক্রের দিকে রওনা হতো।

এখানে থাকলে কেপলার টুটুবি হয়তো জীবন ধারণের উপযুক্ত গ্রহ হিসেবে টিকে যেত। উল্লেখ্য, গ্রহটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৫০ কোটি বছরের ছোট। সৌরজগতে যদি গ্রহটির জন্ম হতো, তাহলে এর বয়স হতো পৃথিবীর সমান। সেক্ষেত্রে গ্রহটিতে বিচিত্র জীবনব্যবস্থা গড়ে ওঠার ভালো সম্ভাবনা থাকত। মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব থাকলেও অবাক হওয়ার মতো বিষয় হতো না সেটা। সেক্ষেত্রে প্রতিবেশী গ্রহের প্রাণীদের সঙ্গে হয়তো মানুষের যোগাযোগ হতো। সম্পর্কটা কেমন হতো, সেটা নিশ্চিতভাবে বলার সুযোগ নেই। হয়তো বুদ্ধিমত্তার প্রভাব খাটাত এক গ্রহ আরেক গ্রহের ওপর। অথবা দুটি গ্রহের বাসিন্দাই মিলেমিশে আরও উন্নতি করত। কিংবা ধ্বংস হয়ে যেত নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে। সম্ভাবনা-আশঙ্কা সবই আছে। তবে কেপলার টুটুবি এখন যেহেতু পৃথিবী ও সূর্যের ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টে আছে, তাই সেখানে পৌঁছানো হতো বেশ ঝক্কির ব্যাপার।

৩.

সূর্য আমাদের পৃথিবীকে প্রচণ্ড মহাকর্ষ বলের সাহায্য প্রতিনিয়ত টানছে। পৃথিবীও যেন এক বেয়াড়া ছেলে। সূর্যের টান বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘন্টায় প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটে যেতে চাইছে মুক্ত মহাকাশে। ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টে থাকা কেপলার টুটুবিতে ঘুরতে যেতে চাইলে আমাদের গ্রহের এই গতির বিপরীতে স্বাছন্দ্যে চলার দক্ষতা অর্জন করতে হতো। কাজটা সহজ নয়। পৃথিবীর মহাকর্ষ বল কাটিয়ে দূরের কোনো গ্রহে যাওয়ার চেয়ে বেশ কঠিন হতো কেপলার টুটুবিতে যাওয়া। গ্রহটির ভর পৃথিবী থেকে বেশি। ফলে বেশি হতো এর মহাকর্ষ বল। সবমিলিয়ে মহাকাশযানের গতি বেশি হলে কঠিন হতো গ্রহটিতে নিরাপদে নামা। কারণ, প্রচণ্ড দ্রুত ছুটে গিয়ে যথাযথভাবে গতি কমিয়ে নিরাপদে নামার কাজটা এ গ্রহের মহাকর্ষ প্রায় অসম্ভবই করে তুলত মানুষের জন্য। আর গতি কম হলে মহাকাশযান আবার পৃথিবীর মহাকর্ষই পেরোতে পারত না।

তাই কেপলার টুটুবিতে পৌঁছানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হতো শুক্র গ্রহের মহাকর্ষ ব্যবহার করা। পৃথিবী থেকে মহাকাশযান শুক্রের দিকে রওনা হতো। এরপর শুক্রের মহাকর্ষ ব্যবহার করে ফিরে আসত কেপলার টুটুবিতে। অনেকটা বুমেরাং-এর মতো। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ পদ্ধতিকে বলেন স্লিংশট। স্লিংশটের মাধ্যমে মহাকাশযানের গতি প্রয়োজন মতো কমানো কিংবা বাড়ানো যায়। শুক্রের মহাকর্ষ ব্যবহার করে সহজেই মহাকাশযানের গতি কমিয়ে যাত্রা করা যেত কেপলার টুটুবির দিকে। তবে এজন্য জ্বালানী ও সময়—দুটোই খরচ হতো বেশি।

বর্তমান প্রযুক্তিতে পৃথিবী থেকে শুক্রে যেতে সময় লাগে প্রায় ৪ মাস। শুক্রের পাশে গিয়ে মহাকাশযানের গতি যেহেতু আমাদের কমাতে হচ্ছে, তাই কেপলার টুটুবিতে পৌঁছাতে সময় লাগত দ্বিগুণেরও বেশি। ধরা যাক, লম্বা এক মহাকাশযাত্রা শেষে আপনি পৌঁছালেন গ্রহটিতে। একটু খেয়াল করলেই লক্ষ্য করবেন, গ্রহটি পৃথিবীর মতো মেরু বরাবর ঝুঁকে ঘুরছে না। ঘুরছে ইউরেনাসের মতো করে। পৃথিবীর দুই মেরু এর ঘূর্ণন অক্ষ থেকে প্রায় ২৩ ডিগ্রি ঝুঁকে থাকে। অন্যদিকে ইউরেনাসের এ ঝুঁকে থাকার পরিমাণ প্রায় ৯৮ ডিগ্রি। ফলে দূর থেকে দেখে মনে হয় গ্রহটি বুঝে সূর্যকে ঘিরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

যাহোক, কেপলারের ঘূর্ণন এমন অদ্ভুত হওয়ার কারণে একেক মেরুতে ছয় মাস রাত এবং ছয় মাস ভরদুপুরের আবহাওয়া বিরাজ করত। এই আবহাওয়াকে খুব একটা সুবিধার বলা যায় না। বলা ভালো, রাতের অংশে থাকত হাড় জমাট করা ঠান্ডা। দিনের অংশ হতো আগুনের মতো তপ্ত।

তবে আশা হারালে চলবে না। একটা বড় সম্ভাবনা হলো, কেপলার টুটুবির পুরো পৃষ্ঠ অতি মহাসাগরে ঢাকা থাকতে পারে। এই অতি মহাসাগরের গভীরতা সর্বনিম্ন ৫০ মিটার হলেও এটা হয়তো গ্রহটির চরম আবহাওয়া মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। সেক্ষেত্রে গ্রহপৃষ্ঠের তাপমাত্রা হবে ১৫ থেকে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। হালকা শীতের কাপড় থাকলেই এবার আপনি নামতে পারবেন গ্রহটির বুকে। তবে স্পেসস্যুটের হেলমেট এখনই খুলতে যাবেন না।

৪.

কেপলার টুটুবির বায়ুমণ্ডল শ্বাস নেওয়ার অযোগ্য হওয়ার একটা বড় আশঙ্কা আছে। বায়ুমণ্ডল যেমনই হোক না কেন, নিরাপদ বাসস্থান তৈরি করতে হবে হবে এখানে। যার মাধ্যমে বায়ুচাপ, তাপমাত্রা এবং বাতাসের মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এ গ্রহেরই সম্পদ ব্যবহার করে থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তির সাহায্যে কাজটি করা সম্ভব।

গ্রহটির অবস্থান আমাদের কাছাকাছি হলে মঙ্গলের চেয়ে এখানে যাওয়াই বেশি যুক্তিযুক্ত হতো। একবার সেখানে মানুষ কলোনি তৈরি করলে সমুদ্রের পানি, বাতাস ও সূর্যের শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ শক্তি তৈরি করা যেত।

বায়ুমণ্ডলের ব্যাপার তো গেল, সূর্য থেকে আসা বিকিরণের সমাধান কী? পৃথিবীর অদৃশ্য চৌম্বকক্ষেত্র ও বায়ুমণ্ডল বিরতিহীনভাবে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি আটকে দিচ্ছে। কেপলার টুটুবিতে চৌম্বকক্ষেত্র কতটা শক্তিশালী বা আদৌ আছে কি না, সে তথ্য আমরা এখনও জানি না। না থাকলে, গ্রহটির অবস্থা মঙ্গল বা শুক্রের চেয়ে ভালো কিছু হতো না।

অবশ্য, গ্রহটি সত্যিই আমাদের সৌরজগতে থাকলে বিজ্ঞানীরা সেখানে রোবট পাঠিয়ে আগেই এসব খুঁটিনাটি তথ্য জেনে নিতেন। ফলে কেপলার টুটুবির দিকে রওনা দেওয়ার আগেই গ্রহের তাপমাত্রা, বাতাসের মান, ঘনত্ব—সবই জানা থাকত আপনার।

গ্রহটির অবস্থান আমাদের কাছাকাছি হলে মঙ্গলের চেয়ে এখানে যাওয়াই বেশি যুক্তিযুক্ত হতো। একবার সেখানে মানুষ কলোনি তৈরি করলে সমুদ্রের পানি, বাতাস ও সূর্যের শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ শক্তি তৈরি করা যেত। খাবার নিয়ে একটু ঝামেলা হতো হয়তো। পৃথিবীর গাছপালা সেখানে জন্মানোর জন্য গ্রিনহাউজ তৈরি করতে হতো। যার ভেতরের পরিবেশ হতো সুনিয়ন্ত্রিত ও পৃথিবীর মতো। ধীরে ধীরে গ্রহটির পরিবশে খাওয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হতো পৃথিবীর এসব উদ্ভিদকে।

অতি মহাসাগরে ভাসমান উচ্চ আমিষসমৃদ্ধ শ্যাওলাও খাবারের একটি বিকল্প উৎস হতে পারত কেপলার টুটুবিতে। আর কপাল ভালো হলে মিলত প্রাণের সন্ধান। এমনকি বুদ্ধিমান প্রাণের সন্ধান পাওয়ার সম্ভবনাও আছে বেশ।

তবে যাহোক, এসব কিছু বাস্তবে আসলে সম্ভব নয়। কারণ, গ্রহটি সৌরজগতে তৈরি হয়নি। ৬৩৫ আলোকবর্ষ দূর থেকে পুরোদস্তুর এক গ্রহকে টেনে এনে সৌরজগতে বসানোর প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও মানুষের নেই। বলা বাহুল্য, সেই সক্ষমতা থাকলে গ্রহটি এখানে আনার বদলে মানুষ সেখানে গিয়েই থাকতে চাইত। সেটাই হতো বেশি যৌক্তিক।

লেখক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াটইফ শো, উইকিপিডিয়া, নাসা, জেপিএল