মহাবিশ্বটা কি বাস্তব?

প্রশ্নটাকে অযৌক্তিক মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক। বাস্তব যে, তার প্রমাণ তো আমরাই। মহাবিশ্বের সব বস্তু, উপাদান তো আছে আমাদের চোখের সামনেই। দেখছি, শুনছি, স্পর্শ করছি, অনুভব করছি। তবু কীভাবে অবাস্তবতার প্রশ্ন আসে?

আসা সম্ভব কি না, সেটাই আমরা একটু যাচাই করে দেখতে চাই। যাচাই করতে তো আর দোষ নেই, তা–ই না?

শুরুতে দুই একটা প্যারাডক্সিক্যাল ঘটনার কথা বলে রাখি। আসলে মহাবিশ্বটা আমরা যেমন দেখি, আসলেই কি সেটা তেমনই? আমাদের দেখার বা বোঝার ক্ষমতা আসলে কতটুকু? আমরা দেখে যা মনে করি, জগৎটা কি আসলে ঠিক তেমনই? ছোট্ট একটা উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করি।

নিচের ছবিটা (ছবি ১) একটু ভাল করে লক্ষ করুন। একটি চেকারবোর্ড দেখা যাচ্ছে, যার প্রতিটি সারিতে ৫টি করে ছোট বর্গ আঁকা আছে। এক কোণায় রাখা একটি সিলিন্ডার। বর্গগুলো দেখে মনে হচ্ছে কোনাকুনি বরাবর বিবেচনা করলে এক সারির সব সাদা (বা ধূসর)। আবার তার পার্শ্ববর্তী সারির বর্গগুলো সব কালো রংয়ের। তাহলে A এবং B চিহ্নিত বর্গের রং আলাদা হওয়ার কথা।

অবিশ্বাস্য কথাটা এবার বলেই ফেলি। আসলে দুটো বর্গের রং একই। ছবিটি একধরনের আলোকীয় বিভ্রম (optical illusion)। এর নাম চেকার শ্যাডো ইলুশন। প্রমাণ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ছবিটিকে কোনো ইমেজ এডিটর সফটওয়্যারে নিয়ে দুটো বর্গের ওপর আইড্রপার টুল প্রয়োগ করা। প্রিন্ট করে নিয়ে সবগুলো বর্গ কেটে নিয়েও যাচাই করে দেখতে পারেন।

ছবি: ১
Kazi Akash

সহজেই আমাদের প্রাথমিক ভুল ধরা পড়ছে। আচ্ছা এটা নাহয় মেনেই নিলাম, এখানে আমাদের ভুল হতেই পারে। তাই বলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা ভুল হয়ে যেতে হবে?

সে আলোচনায় যাওয়ার আগে কোয়ান্টাম মেকানিকসের একটা কথা না বললেই নয়। এটি বলছে, পর্যবেক্ষণ করার আগপর্যন্ত একটি ঘটনা সম্ভাব্য সব অবস্থায় বিরাজ করে। পর্যবেক্ষণ বা পরিমাপ করার ফলেই ঘটনাটি একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় রূপ নেয়। এখান থেকেই শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল প্যারাডক্সের উদ্ভব। শ্রোডিঙ্গার সাহেব আইনস্টাইনের মতোই কোয়ান্টাম মেকানিকসের এই কথাটা মানতে পারতেন না। তাই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, পর্যবেক্ষণ করার আগে কি একটি বিড়াল একটি বিষাক্ত বাক্সে একই সঙ্গে মৃত ও জীবিত অবস্থায় থাকে? আইনস্টাইন তো রঙ্গ করে বলেছিলেন, আমরা যখন তাকিয়ে থাকি না, তখন কি আকাশে চাঁদ থাকে না? তবে আইনস্টাইনের রঙ্গ সত্ত্বেও পারমাণবিক জগতে কথাগুলোর কিন্তু ভিত্তি আছে। আর এই কথাগুলোর সত্যতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান সভ্যতা। আপনার হাতের মুঠোফোনের মাইক্রোচিপ, এমআরআই, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংসহ নানান ক্রিয়াকৌশল।

কিন্তু তাই বলে অবাস্তব মহাবিশ্ব? আচ্ছা, এবার মূল আলোচনাতেই তাহলে ফিরে যাওয়া যাক।

১৯৮২ সালের কথা। ওই বছর গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটে। ফ্রান্সের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী অ্যাঁলে অ্যাসপের নেতৃত্বে একটি অভিনব পরীক্ষা পরিচালিত হয়। হয়তোবা এটাই হবে বিংশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। পরীক্ষাটি হয়তো সেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে পত্রিকায় আসেনি। বিজ্ঞানের খবরাখবর না রাখলে হয়তো অ্যাসপের নামটিও আপনার না–ও শোনা হয়ে থাকতে পারে। তো, তারা কী এমন করলেন যে নামটি শোনা উচিত ছিল?

অ্যাসপের দল দেখালেন, কিছু কিছু অবস্থায় ইলেকট্রনের মতো অতিপারমাণবিক কণিকারা বহু দূরে থেকেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে, সে যত বড় দূরত্বই হোক না কেন। তারা ১০ ফুট দূরে আছে কি ১০ লাখ কোটি দূরে, সেটা কোনো ব্যাপারই নয়। কোনোভাবে যেন একটি কণা জেনেই যায়, অন্য কণা কী করছে। অন্যদিকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বলছে, কোনো তথ্যই আলোর চেয়ে বেশি বেগে যেতে পারে না। ফলে উপরোক্ত ঘটনা সেই নীতির বিপরীত বলে মনে হচ্ছে। যদিও দুটো ঘটনার সমন্বয় করাও সম্ভব, তবু একটুখানি যদি-কিন্তুর অবকাশ থেকেই যায়। সেটা ভিন্ন আলোচনা। সেদিকে আপাতত না গিয়ে আমরা দেখতে চাই কণাদের এই অদ্ভুত বিজড়নের ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব হয় কি না। ঘটনাটির কেতাবি নাম কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গেলমেন্ট।

মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ডেভিড বোমও ভেবেছেন ভিন্ন কিছু। ভদ্রলোককে বিংশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিদ বলা হত। তাঁর মতে, অ্যাসপের পরীক্ষালব্ধ ফলের অর্থ হবে বাস্তবতার অস্তিত্ব নেই। দেখতে পরম বাস্তব মনে হলেও মহাবিশ্ব আসলে একটি কাল্পনিক বস্তু। একটি বিশাল বপুর হলোগ্রাম।

এত বড় দাবির সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে প্রথম কাজ হওয়া উচিত হলোগ্রাম সম্পর্কে ভালো একটু হলেও জানা। হলোগ্রাম হলো একটি ত্রিমাত্রিক চিত্র, যা লেজার আলোর মাধ্যমে তৈরি করা হয়। হলোগ্রাম তৈরির পদ্ধতিকে বলে হলোগ্রাফি। হলোগ্রামে লেজার আলো ব্যবহার করার কারণ হলো এখানে সব কটি রশ্মি সমান সাইজের হয়। একই সঙ্গে তরঙ্গিত হয়। একটি নির্দিষ্ট রঙের আলো থাকে শুধু। প্রিজম বা লেন্সের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় সাদা আলো বিভিন্ন রংয়ের আলোয় বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু লেজার রশ্মি একবর্ণী ও সমান সাইজের হওয়ায় চলার পথে সব কটি আলোকরশ্মি একই সঙ্গে থাকে।

তবে হলোগ্রামে থাকে একটিমাত্র লেজার রশ্মি। যে বস্তুর হলোগ্রাম বানানো হবে, প্রথমে তাকে লেজার রশ্মির মধ্যে ডোবানো হয়। বিশেষ লেন্সের সাহায্যে লেজার রশ্মিটিকে ভেঙে দুটি রশ্মি বানানো হয়। এতে করে একই সাইজের দুটি লেজার রশ্মি পাওয়া যায়। এর একটিকে বলা হয় রেফারেন্স রশ্মি। একে সরাসরি ফিল্মে প্রক্ষেপ করা হয়। দ্বিতীয় রশ্মিটিকে যে বস্তুর হলোগ্রাম বানানো হবে, সেটা থেকে প্রতিফলিত করা হয়।

দুটি রশ্মি মিলিত হলে একটি ব্যতিচার নকশা হয়। আলো বা অন্য কোনো তরঙ্গের দুটি ধারার মিলনের ফলে তরঙ্গের বিস্তার বড় বা ছোট হওয়ার নাম ব্যতিচার। এটা বাস্তবে দেখতে চাইলে পুকুরে দুই দিক থেকে দুটি ঢিল মেরে তাদের মিলন দেখে নিতে পারেন। আলোর ব্যতিচারের ক্ষেত্রে রঙের নকশা পাওয়া যায়। আর হলোগ্রাম বানানোর জন্যে ব্যতিচার থেকে পাওয়া নকশাই ফিল্মে রেকর্ড করা হয়। ফিল্মটাকে ডেভেলপ করা হলে শুরুতে একে আলো ও অন্ধকারের আঁকিবুঁকি মনে হবে। কিন্তু একে আরেকটি লেজার রশ্মি দ্বারা আলোকিত করা হলে পুরো ছবিটিই ফুটে ওঠে। পাওয়া যায় ত্রিমাত্রিক ছবি।

হলোগ্রাম সম্পর্কে আরেক মজার ব্যাপার হলো, ফিল্মে ধারণ করার সময় পুরো ছবিটাই ফিল্মজুড়ে ধারণ করা হয়। ফলে একটি ফুলের হলোগ্রামের ফিল্মকে অর্ধেক করে ফেললেও আপনি পুরো ফুলটাই দেখতে পারবেন। বিষয়টা অনেকটা এমন: আপনি পুরো জানালা দিয়ে তাকিয়ে একটি গাছ দেখছেন। অর্ধেকটা জানালা দিয়ে তাকালেও পুরো গাছটি দেখবেন। হলোগ্রাম নিজে দ্বিমাত্রিক হলেও (যা কাগজে ছাপা দেখি আমরা) এতে ত্রিমাত্রিক বস্তুর সব বৈশিষ্ট্য থাকে। একইভাবে অর্ধাংশকে আবারও অর্ধেক করলে সেই পুরো ছবিই থাকবে। তার মানে সাধারণ ছবির বদলে হলোগ্রামের পুরো অংশে ছবির পুরো তথ্য থাকে। এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় হোল ইন এভরি পার্ট বা প্রতি অংশে পূর্ণ।

২০১৫ সালে স্পেনে একটি হলোগ্রাম মিছিল হয়েছিল। মিছিলটি হয় সরকারের একটি আইনের বিরুদ্ধে। সরকারি ভবনের আশপাশে সভা-সমাবেশের জন্য কড়া জরিমানা করে আইন প্রস্তাবের বিপক্ষে হয় মিছিলটি। মজার ব্যাপার হলো, মিছিলে সত্যিকার মানুষ অংশ নেয়নি। বরং আলো প্রক্ষেপণের মাধ্যমে মানুষের প্রতিকৃতি দিয়ে হলোগ্রাম মিছিল বানানো হয়েছিল। দেখে কিন্তু মনে হবে সত্যিকার মানুষই মিছিল করছে।

হোল ইন এভরি পার্ট বৈশিষ্ট্য থেকে বস্তুর বিন্যাস সম্পর্কে চিন্তার দারুণ একটি পথের সন্ধান মেলে। বিজ্ঞানের ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যায়, বেশির ভাগ সময় মনে করা হয়েছে, একটি জিনিসকে বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে একে কেটে কেটে ছোট করা। মানে ব্যবচ্ছেদ করে উপাদানগুলো দেখার চেষ্টা করা। যেমনটা করা হয় ব্যাঙ, ইঁদুর বা পরমাণুকে বোঝার জন্যে।

কিন্তু হলোগ্রাম থেকে বোঝা যায়, মহাবিশ্বের সবকিছুকে এভাবে বোঝা যাবে না। হলোগ্রাফিক চিত্রকে ভেঙে ভেঙে বুঝতে গেলে আমরা এর উপাদান খুঁজে পাব না। পাব আগের চেয়ে ছোট পূর্ণ অংশই। এর মাধ্যমে অ্যাসপের আবিষ্কারকে বোম অন্যভাবে ভাবার সুযোগ পেলেন। বোমের বিশ্বাস, অতিপারমাণবিক কণারা দূরে চলে গেলেও যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে, তার কারণ এই নয় যে তারা সামনে-পেছনে রহস্যময় কোনো সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। বরং তাদের আলাদা কণা মনে হওয়াটাই একটা বিভ্রম। তাঁর মতে, বাস্তবতার আরও গভীর কোনো স্তরে এই কণাগুলো স্বতন্ত্র কোনো সত্ত্বা নয়। বরং একই মৌলিক জিনিসের বহিঃপ্রকাশ।

বোমের কথাটা আরও ভালো করে বুঝতে একটি উদাহরণ দেখি। মনে করুন, একটি অ্যাকুয়ারিয়ামে একটি মাছ আছে। আপনি অ্যাকুয়ারিয়ামটি সরাসরি দেখছেন না। এতে কী আছে সেটা দেখতে পাচ্ছেন দুটি টেলিভিশন ক্যামেরার মাধ্যমে। একটি ক্যামেরা আছে অ্যাকুয়ারিমের সামনের দিকে আর আরেকটি আছে এক পাশে।

টেলিভিশনের স্ক্রিনে তাকালে দুটো মনিটরের মাছকে আলাদা মনে হবে। দুই ক্যামেরার দিকও তো আছে ভিন্ন দিকেই। ফলে ছবি দুটিও কিছুটা আলাদা হবে। তবে অনেকক্ষণ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকলে দেখবেন, দুই ছবির মধ্যে কোথায় যেন একটা সম্পর্ক আছে। একটি মাছ যখন ঘোরে, অন্য মাছটিও সামান্য ভিন্ন রকম মোড় নেয়। একটি পাশে ঘুরলে আরেকটি সামনের দিকে মোড় নেয়। আসল বিষয় (মাছ আছে একটিই) না জানলে আপনি হয়তো ভাববেন, দুটো মাছ তাৎক্ষণিকভাবে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কিন্তু আসলে তো তা নয়।

বোমের মতে, অ্যাসপের পরীক্ষায় কণাদের মধ্যে ঠিক এটাই ঘটেছে। আপাতদৃষ্টিতে আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলা এই যোগাযোগ হয়তো আমাদের বলছে বাস্তবতার আরও গভীর একটি স্তর আছে। আমাদের নিজেদের মাত্রার বাইরের আরও কোনো মাত্রা থেকে হয়তো আমরা গোপন নেই। ঠিক যেমন অ্যাকুয়ারিয়ামের মতো। তাঁর মতে আমরা অতিপারমাণবিক কণাদেরকে আলাদা কণা হিসেবে দেখি, কারণ, এরা আসলে বাস্তবতার একটি অংশমাত্র। পুরোটা নয়।

কণাগুলো আসলে আলাদা আলাদা অংশ নয়। আরও গভীর ও ভেতরের একটি একক। এরাও হলোগ্রাফিক ফুলের মতোই। আর মহাবিশ্ব যেহেতু এই জিনিসগুলো দিয়েই তৈরি, তাই মহাবিশ্বটা নিজেও একটি হলোগ্রাম। এটা ছাড়াও মহাবিশ্বের আরও কিছু ভুতুড়ে বৈশিষ্ট্যও আছে। বিভিন্ন কণাদের আলাদা থাকার বিষয়টি যদি বিভ্রম হয়ে থাকে, তাহলে বাস্তবতার গভীর স্তরে সবকিছুই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মানুষের মস্তিষ্কের কার্বন পরমাণুর ইলেকট্রনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে সমুদ্রে বিচরণ করা মাছের অতিপারমাণবিক কণার। সম্পর্ক আছে গাছের সঙ্গে। নক্ষত্রের সঙ্গে।

সবকিছুই সবকিছুকে স্পর্শ করে আছে। আমরা মানুষেরা মহাবিশ্বের সব জিনিসকে বিভক্ত করতে চাই। বিভাগ অনুসারে সাজাতে চাই। কিন্তু এই কাজগুলো আসলে কৃত্রিম। পুরো জগৎটা অখণ্ডনীয় এক জালের মধ্যে গাঁথা আছে। হলোগ্রাফিক মহাবিশ্বে স্থান ও কালকেও মৌলিকভাবে বিচার করা সম্ভব নয়। যেখানে কোনোকিছুই অন্য কিছু থেকে আলাদা নয় সেখানে অবস্থানের ধারণাই তো অকার্যকর।

গভীর স্তরে বাস্তবতাও একধরনের সুপারহলোগ্রাম। যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একসঙ্গে বিদ্যমান। হয়ত একদিন সুপারহলোগ্রাফিক স্তরে পৌঁছে গিয়ে অতীতের দৃশ্যগুলোকে তুলে আনা যাবে। কিংবা ভবিষ্যতেরও?

সুপারহলোগ্রামে কী আছে, সেটা একটি উন্মুক্ত প্রশ্ন। ধরা যাক, সুপারহলোগ্রাম থেকেই মহাবিশ্বের জন্ম। যত রকম অতিপারমাণবিক কণা আছে বা হবে, সব কটিই এতে আছে। সব ধরনের বস্তু ও শক্তির বিন্যাস আছে এতে। তার মানে এর সবকিছু এক মহাজাগতিক সংগ্রহশালা।

বোম স্বীকার করছেন, সুপারহলোগ্রামে কী লুকানো আছে, তা জানার সুযোগ নেই। কিন্তু এটাও বলা যাবে না, কিছুই লুকানো নেই। তাঁর মতে, আবার এ–ও হতে পারে, বাস্তবতার সুপারহলোগ্রাফিক স্তর আসলে এক নিছক মঞ্চবিশেষ, যার ভেতরে অসীমসংখ্যক আরও পর্যায়। এই ধারণা বোমের একার নয় কিন্তু। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্নায়ুশারীরবিদ কার্ল প্রিব্রামও মনে করছেন, আমাদের বাস্তবতা হলোগ্রাফিক হতে পারে।

মস্তিষ্কের স্মৃতির ধরে রাখার কৌশল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রিব্রাম হলোগ্রাফিক ধারণা পেয়েছেন। বহু যুগের গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় না থেকে স্মৃতি ছড়িয়ে থাকে মস্তিষ্কজুড়ে। ১৯২০–এর দশকে কার্ল ল্যাশলি এ নিয়ে অনেকগুলো পরীক্ষা চালান। ইঁদুর নিয়ে পরীক্ষা করে তিনি দেখেন, এর মস্তিষ্কের যে অংশই বিচ্ছিন্ন করা হয়, এটি সার্জারির আগে শেখা জটিল কাজ করতে মনে রাখতে পারে। মস্তিষ্কের এই প্রতি অংশে পূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না।

পরে ১৯৬০ সালে প্রিব্রাম হলোগ্রাফি সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি পেয়ে গেলেন কাঙ্ক্ষিত ব্যাখ্যা। প্রিব্রামের বিশ্বাস, স্মৃতির সঙ্কেত নিউরন বা নিউরনের ছোট ছোট গুচ্ছে আবদ্ধ নয়। এটি বরং আছে স্নায়ুর সংকেতের বিন্যাস আকারে, যা পুরো মস্তিষ্কে এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে আছে। ঠিক যেভাবে লেজার আলোর ব্যতিচার নকশা হলোগ্রাফিক ছবি ধারণা করা একখণ্ড ফিল্মের পুরোটা জুড়ে বিস্তৃত থাকে। তাই প্রিব্রামের বিশ্বাস, মস্তিষ্কটাই একটি হলোগ্রাম।

প্রিব্রামের মত মেনে নিলে দারুণ একটি জিনিস সহজে ব্যাখ্যা করা যায়: মস্তিষ্ক এত অল্প জায়গায় কীভাবে এত সুবিশাল তথ্য সংরক্ষণ করে? হিসাব করে দেখা গেছে, গড়ে পুরো আয়ুষ্কালে মানুষের মস্তিষ্ক অন্তত এক হাজার কোটি বিট তথ্য ধারণ করতে পারে। মানে পাঁচ সেট এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার সমপরিমাণ তথ্য।

ঠিক একইভাবে দেখা গেছে, হলোগ্রামও ব্যাপক পরিমাণ তথ্য ধারণ করতে পারে। একটি ফটোগ্রাফিক ফিল্মে পতিত আলোর কোণ পরিবর্তন করে একই পৃষ্ঠে বহু আলাদা চিত্র সংরক্ষণ করা যাবে। দেখা গেছে, এক ঘন সেন্টিমিটার পরিমাণ ফিল্মেই এক কোটি তথ্য রাখা যাবে। মস্তিষ্কের বিশাল ভাণ্ডার থেকে আমরা কীভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে আসতে পারি, তা–ও হলোগ্রাফিক নীতি থেকে সহজে বোঝা যায়। আপনার বন্ধু যদি জিজ্ঞেস করে, জেব্রা শব্দটি শুনলে আপনার মাথায় কী আসে? উত্তর দিতে আপনাকে ফাইলের পর ফাইল খুঁজে বেড়াতে হবে না। ডোরাকাটা, ঘোড়ার মতো দেখতে, আফ্রিকান জাতক ইত্যাদি কথাগুলো মুহূর্তের মধ্যে আপনার মাথায় চলে আসবে।

মানুষের চিন্তার প্রক্রিয়ার একটি দারুণ ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিটি তথ্য অন্য তথ্যের সঙ্গে আন্তসম্পর্কিত। এটাও হলোগ্রামের একটি বৈশিষ্ট্য। হলোগ্রামের প্রতিটি অংশ অসীমভাবে অন্য অংশগুলোর সঙ্গে জড়িত।

মস্তিষ্কের স্মৃতিধারণই একমাত্র বিষয় নয়, যেটাকে প্রিব্রামের হলোগ্রাফিক মডেল দিয়ে সহজে বোঝা যায়। স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্ক কীভাবে বিপুল পরিমাণ কম্পাঙ্ককে (আলো, শব্দ ইত্যাদির) রূপান্তর করে, সেটাও বোঝা যায়, যার মাধ্যমে অনুভবযোগ্য জগতের অনভূতি আমরা লাভ করি। কম্পাঙ্কের এনকোডিং (বস্তুকে সঙ্কেতে আবদ্ধ করা) ও ডিকোডিংয়ের (মূল বস্তুর চিত্র ফিরিয়ে দেওয়া) কাজ হলোগ্রাম সবচেয়ে ভালো পারে। ঠিক যেভাবে হলোগ্রাম একধরনের লেন্সের মতো কাজ করে, অনুবাদ যন্ত্র যেভাবে দেখতে অর্থহীন একগুচ্ছ কম্পাঙ্ককে একটি চিত্রে পরিণত করে, প্রিব্রামের মতে মস্তিষ্ক তেমনি লেন্স ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংকেতকে গাণিতিকভাবে আমাদের উপলব্ধিতে রূপ দান করে।

অনেকগুলো জোরালো প্রমাণ বলছে, মস্তিষ্ক কাজ করে হলোগ্রাফিক নীতি মেনেই। তাই স্নায়ুশারীরবিদরা প্রিব্রামের তত্ত্বকে ব্যাপক সমর্থন দিয়েছেন। আর্জেন্টাইন-ইতালীয় গবেষক হুগো জুকারেয়ি সম্প্রতি হলোগ্রাফিক মডেলকে আরেকটু বিস্তৃত করেছেন। একে নিয়ে এসেছেন শব্দবিষয়ক বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যায়। মাথা না নাড়িয়েই মানুষ শব্দের উৎস শনাক্ত করতে পারে। মাত্র একটি কান সচল থাকলেও সেটা সম্ভব। এটা এক বড় রহস্য। জুকারেয়ি আবিষ্কার করেন, এটাও হলোগ্রাফিক মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। জুকারেয়ি হলোফোনিক সাউন্ড নামে এক প্রযুক্তিও আবিষ্কার করেছেন, যার মাধ্যমে শব্দকে দারুণ বাস্তব করে পুনঃ সৃষ্টি করা যায়।

আমদের ব্রেইন কম্পাঙ্কের ইনপুটের ওপর নির্ভর করে গাণিতিকভাবে জড় বাস্তবতা তৈরি করে—এ কথার পক্ষে ব্যাপক পরীক্ষামূলক প্রমাণও আছে। দেখা গেছে, আগে যেমনটা ভাবা হতো, তার চেয়ে অনেক বেশি কম্পাঙ্কের প্রতি আমাদের ব্রেইন সংবেদনশীল। গবেষকরা দেখেছেন, আমাদের দর্শনেন্দ্রিয়ও শব্দ কম্পাঙ্কের প্রতি সংবেদনশীল। আমাদের ঘ্রাণ স্নায়ু বর্তমানে মহাজাগতিক কম্পাঙ্ক নামে পরিচিত সংকেতের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি আমাদের দেহের কোষগুলো অনেক বিস্তৃত পরিসরের কম্পাঙ্কের প্রতি সংবেদনশীল। ফলে মনে হচ্ছে, আমাদের চেতনার হলোগ্রাফিক ক্ষেত্রেই এই কম্পাঙ্কগুলো বিভক্ত হয়ে উপলব্ধির জন্ম দেয়।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে প্রিব্রামের হলোগ্রাফিক মডেলকে বোমের তত্ত্বের সঙ্গে মেলালে। যদি মহাবিশ্বের উপস্থিতি একটি গৌণ বাস্তবতা হয়ে থাকে, যা কিছু আছে, সব যদি কম্পাঙ্কের হলোগ্রাফিক প্রলেপ হয়ে থাকে, মস্তিষ্কও যদি হলোগ্রাম হয়ে থাকে, মস্তিষ্ক যদি হলোগ্রাফিক প্রলেপ থেকে অল্প কিছু কম্পাঙ্ক বাছাই করে সেটাকে গাণিতিকভাবে স্নায়বিক উপলব্ধিতে রূপদান করে থাকে, তাহলে সত্যিকার বাস্তবতা আসলে কী?

রাখঢাক করে বললে বলতে হয়, সত্যিকার বাস্তবতা বলতে কিছু থাকে না। প্রাচ্যের অনেকগুলো ধর্ম যেমনটা বলছে, বাস্তবতা আসলে নিছক এক মায়া বা ভ্রম। যদিও আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, আমরা জড় পৃথিবীর কাঠামোসম্পন্ন প্রাণী, আসলে সেটাও এক মায়া।

আসলে আমরা কম্পাঙ্কের এক সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো গ্রাহক মাত্র। এই সমুদ্র থেকে আমরা যা গ্রহণ করি এবং ভৌত বাস্তবতায় রূপান্তর করি, তা সুপারহলোগ্রামের অনেকগুলো পথের একটি পথ মাত্র। অনেক গবেষকই মনে করছেন, বিজ্ঞান বাস্তবতার যত রূপ তৈরি করতে পেরেছে, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে নিখুঁত। অনেক গবেষক তো বলছেন, এর মাধ্যমে বহু আদিভৌতিক ব্যাপারও ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

যে মহাবিশ্বে একেকটি মস্তিষ্ক বড় এক হলোগ্রামের এক একটি অবিভাজ্য অংশ ও একে অপরের সঙ্গে অসীমসংখ্যক পথে যুক্ত, সেখানে হলোগ্রাফিক স্তরের যোগাযোগের মাধ্যম হবে হয়ত টেলিপ্যাথি (কোনো প্রকার ইন্দ্রিয় ছাড়া যোগাযোগ)। একটি তথ্য এক মন থেকে কীভাবে বহু দূরের আরেক মনে চলে যায় সেটা খুব সহজেই বোঝা যায়। মনোবিজ্ঞানের অনেকগুলো ধাঁধারও সমাধান হয়। যেমন চেক স্নায়ুবিদ স্ট্যানিস্লাভ গ্রফম্যান মনে করেন, হলোগ্রাফিক মডেলের মাধ্যমে মানুষের চেতনার পরিবর্তিত অবস্থার অনেকগুলো আচরণ ব্যাখ্যা করা যায়।

জড় মহাবিশ্বে আমাদের বিশ্বাসটা পাল্টে ফেলা অবশ্যই কঠিন। অবশ্য কোয়ান্টাম মেকানিকস ও আপেক্ষিকতার বেশির ভাগ কথাই তো আমাদের কাছে খুব অদ্ভুত ঠেকে। সেই হিসেবে হলোগ্রাফিক নীতি অসম্ভব অদ্ভুত নয়।

অন্যভাবে চিন্তা করলে বলা যায় মহাবিশ্বটা আসলে একটি কম্পিউটার সিমুলেশন। অথবা সম্পূর্ণ গাণিতিক কাঠামো। কথাগুলো নিছক কল্পনা নয়। আছে জোরালো ভিত্তিও। ম্যাক্স টেগমার্ক আওয়ার ম্যাথমেটিক্যাল ইউনিভার্স বইয়ে জোরালো যুক্তি দেখিয়েছেন, আমাদের মহাবিশ্বটা নিছক গাণিতিক নয়, এটা নিজেই গণিত। আবার আমরা দ্য ম্যাট্রিক্স, দ্য থার্টিন্থ ফ্লোর, সোর্স কোড মুভিগুলোর মতো কোনো সিমুলেশনে (কৃত্রিম বাস্তবতা) বাস করছি না বলারও কোনো জো নেই। বরং কম্পিউটার বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও গেমসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভার্চ্যুয়াল বাস্তবতার প্রয়োগ দেখে দেখে সেই ধারণাগুলোই বেশি বাস্তব মনে হচ্ছে। এর সঙ্গে আমাদের নভেম্বর ২০১৯ সংখ্যায় ‘আপনি আসলে কে’ লেখাটিকে মেলালে বাস্তব মহাবিশ্বের সঙ্গে মন ও মগজের সম্পর্ক নিয়ে কিছু ধারণা পাওয়া যাবে।

লেখক: প্রভাষক, পরিসংখ্যান বিভাগ, পাবনা ক্যাডেট কলেজ

সূত্র: ইলিনয় ডট এজু, লাইভসায়েন্স ডট কম, রেন্স ডট কম, আওয়ার ম্যাথমেটিক্যাল ইউনিভার্স/ম্যাক্স টেগমার্ক