শিশু মহাবিশ্বের গ্যালাক্সির রহস্যভেদ জেমস ওয়েবের

জেমস ওয়েবের চোখে বিগ ব্যাংয়ের মাত্র ৪০০ মিলিয়ন বছরের পরের গ্যালাক্সি এমএসিএস০৬৪৭-জেডিছবি: নাসা, ইসা

শিশু মহাবিশ্বের আদি গ্যালাক্সিগুলো যেন অদ্ভুত আচরণ করছে। মানছে না জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম-কানুন। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ছবিতে ধরা পড়েছিল বিষয়টা। দেখা গেল, বিগ ব্যাংয়ের ৫০০ বছরের মতো পরের আদি গ্যালাক্সিগুলো এত উজ্জ্বলভাবে জ্বলজ্বল করছে যে এর কোনো ব্যাখ্যা হয় না। কারণ, এসব গ্যালাক্সির এত উজ্জ্বল হওয়ার কোনো কারণ নেই। ওগুলোর ভেতরের নক্ষত্রগুলো তরুণ। তাদের আলো এত উজ্জ্বল নয়। গ্যালাক্সিগুলোর ভেতরের নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা হিসাব করে তাই এসব গ্যালাক্সির উজ্জ্বলতার হিসাব মেলানো যাচ্ছিল না।

বিজ্ঞানীরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। হচ্ছে কী এসব! এত উজ্জ্বল গ্যালাক্সি শিশু মহাবিশ্বে থাকারই কথা না। মিল্কিওয়ের মতো প্রচুর নক্ষত্রবিশিষ্ট বেশ ভারী গ্যালাক্সিগুলো এরকম উজ্জ্বলতা দেখায়। অতটা ভারী হওয়ার অর্থ, যথেষ্ট পরিমাণ পরিণত নক্ষত্র থাকা। এতে যে সময় লাগে, বিগ ব্যাংয়ের পরের ওইটুকু সময় সে জন্য যথেষ্ট নয়। ওই সময়ের নক্ষত্রগুলো তখন সদ্য জন্ম নিয়েছে।

অথচ জেমস ওয়েব যে পরিমাণ আলো দেখতে পেয়েছে, তাতে মনে হয়, ওইটুকু সময়েই প্রচুর পরিণত নক্ষত্র ছিল আদি গ্যালাক্সিগুলোতে। তাহলে কি ওসব গ্যালাক্সিতে অন্য কিছু ঘটছিল?

জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের প্রমাণিত সব তত্ত্বের ‘মাথায় খড়গ’ ঝুলছে যেন! গ্যালাক্সি উৎপত্তির তত্ত্ব যেমন ধোপে টিকছে না, তেমনি হালে পানি পাচ্ছে না কসমোলজির স্ট্যান্ডার্ড মডেল। কারণ, এই মডেল বলে, বিগ ব্যাংয়ের পরের কয়েক শ মিলিয়ন বছরে শক্তি ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে তৈরি হয় পদার্থ। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় প্রথম দিকের নক্ষত্রগুলো। অথচ জেমস ওয়েব যে পরিমাণ আলো দেখতে পেয়েছে, তাতে মনে হয়, ওইটুকু সময়েই প্রচুর পরিণত নক্ষত্র ছিল আদি গ্যালাক্সিগুলোতে। তাহলে কি ওসব গ্যালাক্সিতে অন্য কিছু ঘটছিল?

হ্যাঁ, অন্য কিছুই ঘটছিল। নতুন এক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে এ তথ্য। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবে দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল-এ। ইতিমধ্যে এটি গৃহীত হয়েছে, রিভিউ হয়েছে। কী বলছে এ গবেষণা?

১২ বিলিয়ন বছর পুরোনো একদল গ্যালাক্সি। এগুলোর অন্তত ৯০ শতাংশ উজ্জ্বল গ্যাসে পূর্ণ। আশপাশে একঝাঁক নক্ষত্র। এসব নক্ষত্রের আলো স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করেছে। উজ্জ্বল গ্যাসগুলো ঠান্ডা হয়ে আসার পর এতে শুরু হয়েছে আতশবাজির মতো নক্ষত্র জন্মের খেলা। যেন মেলা বসেছে নক্ষত্রের আঁতুড়ঘরে। একের পর এক নক্ষত্র জন্মাচ্ছে, আর জ্বলে উঠছে আলো। এরকম ধারাবাহিক নক্ষত্রজন্মের তীব্র বিস্ফোরণ ও আলোয় আলোয় স্নাত গ্যাসই আসলে ওই প্রচণ্ড উজ্জ্বলতার রহস্য।

গবেষণাপত্রটির মূল লেখক অংশু গুপ্ত। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটির জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী। এক ই-মেইলে তিনি লাইভ সায়েন্সকে জানিয়েছেন, এ ধরনের মিথস্ক্রিয়ার ফলে নক্ষত্রের ধারাবাহিক জন্মের বিষয়টি আদি গ্যালাক্সিগুলোর ভরের ব্যাখ্যাও দিতে পারে সঠিকভাবে।

জেমস ওয়েব নভোদুরবিন
ছবি: সংগৃহীত
পাঠক হয়তো জিজ্ঞেস করবেন, নক্ষত্রের আলো স্ফুলিঙ্গ হিসাবে কাজ করে কীভাবে? আলো তো তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। এই তরঙ্গ শুষে নিয়েছে ওসব গ্যাস। তারপর আবারও বিকিরণ করেছে

এসব উজ্জ্বল গ্যাসের সন্ধানও অবশ্য জেমস ওয়েব নভোদুরবিনই দিয়েছে। জেমস ওয়েবের অ্যাডভান্সড ডিপ এক্সট্রাগ্যালাক্টিক সার্ভের অংশ হিসাবে সংগ্রহ করা তথ্যেই পাওয়া গেছে এসব গ্যাসের সন্ধান। এ সার্ভেতে গ্যালাক্সিগুলোর বর্ণালি বিশ্লেষণের পাশাপাশি অবলোহিত আলোয় ছবি তোলা হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল। পাঠক হয়তো জিজ্ঞেস করবেন, নক্ষত্রের আলো স্ফুলিঙ্গ হিসাবে কাজ করে কীভাবে? আলো তো তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। এই তরঙ্গ শুষে নিয়েছে ওসব গ্যাস। তারপর আবারও বিকিরণ করেছে। এই বিকিরণই ধরা পড়েছে আলো হিসাবে।

অংশ গুপ্তের ভাষ্যেও উঠে এসেছে বিষয়টি। ‘গ্যাস নিজে নিজে আলো বিকিরণ করতে পারে না। কিন্তু আশপাশের তরুণ, ভারী নক্ষত্রগুলো একদম সঠিক তরঙ্গের আলো বিকিরণ করেছে। সঠিক মানে, গ্যাসগুলোকে উত্তেজিত করার জন্য যে তরঙ্গের আলো প্রয়োজন ছিল, তা। আর আদি গ্যালাক্সিগুলোতে এরকম তরুণ নক্ষত্রের সংখ্যা ছিল অনেক। গ্যাসগুলো তাই ওসব আলো শুষে নিয়েছে, তারপর বিকিরণ করেছে আলো হিসাবে। সেই আলোই শনাক্ত করা হয়েছে পরবর্তীতে।’

বর্তমান কালের তুলনামূলক নতুন গ্যালাক্সিগুলোর বর্ণালির সঙ্গে সেই আদি গ্যালাক্সিগুলোর বর্ণালি তুলনা করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গেছে, বর্তমানের ১ শতাংশ গ্যালাক্সি ওরকম। একই বৈশিষ্ট্য তাদের। কিন্তু তুলনামূলক নতুন এসব গ্যালাক্সি নিয়ে গবেষণা করা সহজ। এ থেকে যে তথ্য ও ইনসাইট পাওয়া যাবে, তা কাজে লাগবে আদি গ্যালাক্সিগুলোকে আরও ভালোভাবে বুঝতে। জানা যাবে শিশু মহাবিশ্বের রাসায়নিক বিষয়গুলোও।

অংশু গুপ্তের ভাষ্যেই শুনুন, ‘যেসব রাসায়নিক মৌলের মাধ্যমে পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সব গড়ে উঠেছে, হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম ছাড়া আর সব কিছুর জন্মই মূলত বহুদূরের ওসব নক্ষত্রের বুকের গহীনে। ফলে আজকের বিশ্বকে ভালোভাবে বুঝতে আশপাশের ওসব গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য বোঝা জরুরি।’

বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোকে এভাবেই বারবার পরীক্ষা দিতে হয়। এ যাত্রা পরীক্ষায় পাশ করে গেল জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার তত্ত্বগুলো। পাশ করে গেল কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্বের প্রমিত মডেল। এভাবেই বিজ্ঞান এগিয়ে যায়। আমরা জানতে পারি মহাবিশ্বের নতুন কোনো রহস্যের সমাধান, আরেকটু ভালোভাবে বুঝতে পারি মহাবিশ্বের সৌন্দর্য।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল, উইকিপিডিয়া

মূল গবেষণাপত্র