অসীম ও মহাবিশ্ব

কিছুদিন আগে বিজ্ঞানের একটি পাঠ্যবইয়ে দেখলাম লেখা আছে, মহাবিশ্ব একই সঙ্গে অসীম ও প্রসারণশীল, অর্থাৎ প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। কথাটা একটু বিভ্রান্তিকর। প্রথম কথা হলো, মহাবিশ্ব আদৌ অসীম কি না, তা নিশ্চিত করে কেউ জানে না। আবার প্রশ্ন দাঁড়ায়, মহাবিশ্ব যদি অসীম হয়, তার প্রসারণ কেমন হবে বা তার তাৎপর্যই বা কী হবে? অসীম জিনিস আরও বড় হলে তার নাম কী হবে? কেউ হয়তো বলবেন, আরও বড় অসীম হবে।

গণিত বলছে, অসীমের সঙ্গে ১ যোগ করলেও অসীমই হয়। আরও বড় সংখ্যা, এমনকি অসীম যোগ করলেও অসীম অসীমই থাকে। অসীম আসলেই এক গোলমেলে জিনিস। পদার্থবিদ বলুন কিংবা গণিতবিদ, অসীম থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততই যেন মঙ্গল (সব সময় অবশ্য নয়!)। এই যেমন ধরুন জোড় সংখ্যা আর বিজোড় সংখ্যার কথাই। কোন সংখ্যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, বলতে পারবেন? হয়তো মনে হবে যেহেতু বিজোড় সংখ্যা আগে আসে, তাই বিজোড় সংখ্যাই বেশি। অবশ্য শূন্যকে জোড় ধরে নিলে তো বিতর্ক এখানেই খতম। আর অকাট্য গাণিতিক যুক্তি তা বলেও। কিন্তু সেটা নাহয় ছাড় দিলাম। ২ থেকেই জোড় করুন না। এবার আপনি কি এমন কোনো বিজোড় সংখ্যা বলতে পারবেন, যার বিপরীতে আলাদা কোনো জোড় সংখ্যা পাওয়া যাবে না?

এটা তো সহজ ভাবনাই ছিল। আরেকটু জটিল করে ভাবি। ১, ২, ৩,…সংখ্যাগুলোকে আমরা স্বাভাবিক সংখ্যা বলি। আর এগুলোর বর্গ, মানে ১, ৪, ৯,...ইত্যাদিকে বলি বর্গ সংখ্যা। এবার ভাবুন তো স্বাভাবিক সংখ্যা বেশি, নাকি বর্গ সংখ্যা? এভাবে চিন্তা করা যায়: ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত চিন্তা করলে স্বাভাবিক সংখ্যা পাব ১০০ খানা। আর বর্গ সংখ্যা মাত্র ৯টি। বর্গ সংখ্যারা পিছিয়ে আছে। কিন্তু আসলেই কি তা–ই? আগের মতোই ভাবা যাক না।

এমন কোনো আলাদা স্বাভাবিক সংখ্যা পাওয়া যাবে কি, যার বিপরীতে আলাদা কোনো বর্গ সংখ্যা পাওয়া যাবে না? পাশের সারণিটা একটু দেখা যেতে পারে।

প্রতিটি স্বাভাবিক সংখ্যার বিপরীতেই একটি করে স্বতন্ত্র বর্গ সংখ্যা পাওয়া যাবেই। তাহলে স্বাভাবিক সংখ্যারা বেশি আছে বলা যাবে কি? এই সমস্যাটিকে বলা হয়, গ্যালিলিও প্যারাডক্স। গ্যালিলিও তাঁর টু নিউ সায়েন্সেস বইয়ে বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। শেষে গ্যালিলিও বলেছিলেন, বড়, সমান বা ছোট—এই কথাগুলো শুধু সসীম জিনিসের জন্যই খাটে। অসীম সেটের জন্য নয়। অবশ্য ঊনবিংশ শতকের জর্জ ক্যান্টর দেখিয়েছিলেন, বিভিন্ন রকম অসীম থাকতেও পারে। তবে অসীম নিয়ে জটিলতা কিন্তু কেটে যায়নি।

গণনাযোগ্য অসীম বলে একটি কথা আছে। যে অসীম সেটকে স্বাভাবিক সংখ্যার সঙ্গে এক এক করে দাঁড় করানো যাবে, তাদের বলা হয় গণনাযোগ্য অসীম। বর্গ সংখ্যাগুলোও অসীম। বর্গ সংখ্যার পরিমাণ অসীম হলেও সসীম সময়ে নির্দিষ্টসংখ্যক বর্গ সংখ্যা পর্যন্ত গুনে আসা যাবে। সবগুলো বর্গ সংখ্যা বলতে হলে অসীম সময় লাগবে ঠিকই। কিন্তু যদি বলা হয়, ১৫২১ বর্গ সংখ্যাটি পর্যন্ত (বা অন্য যেকোনো বর্গ সংখ্যা) সংখ্যাগুলো বলুন, তাহলে কিন্তু কাজটি করা যাবে।

আবার হিলবার্টের প্যারাডক্সের কথাই ভাবুন। ধরুন, একটি হোটেলে গণনাযোগ্য অসীম সংখ্যক কক্ষ আছে। আরও ধরুন, বর্তমানে সবগুলো কক্ষে অতিথি আছেন। এবার নতুন আরেকজন অতিথি এলে কী হবে? তিনি কি এই হোটেলে আশ্রয় পাবেন?

পাবেন আসলে। কীভাবে সেটা? যেহেতু হোটেলে গণনাযোগ্য অসীম সংখ্যক কক্ষ আছে, তাই আমরা প্রথম কক্ষের অতিথিকে দ্বিতীয় কক্ষে নিয়ে যাব। দ্বিতীয় কক্ষের অতিথিকে তৃতীয় কক্ষে। এভাবে nতম কক্ষের অতিথিকে নিয়ে রাখব n+1তম কক্ষে। বিষয়টি মানতে কষ্ট হলে ওপরের গণনাযোগ্য অসীমের বৈশিষ্ট্যে আবার একটু চোখ বুলিয়ে নিন। এভাবে ওই হোটেলে যেকোনো সসীম কিংবা অসীম সংখ্যক নতুন অতিথিকে রাখা যাবে।

গণিতে অসীম বোঝানোর জন্য একটি প্রতীক (∞) ব্যবহার করা হয় ঠিকই। কিন্তু তবু অসীম কিন্তু সত্যিকার অর্থে সংখ্যার মর্যাদা পায়নি। আর সেটা দিতে গেলে মস্ত গন্ডগোল লেগে যেতে পারে। যেমন অসীমের সঙ্গে ১ যোগ করলেও অসীম হয়, আবার ২ যোগ করলেও অসীম হয়। তাহলে কি ১ আর ২ সমান? সমস্যাটা ১ আর ২-এ নয়। অসীমকে সব সময় সংখ্যা মনে করতে গেলেই সমস্যা। এ জন্য অসীম আসলে যতটা না সংখ্যা, তার চেয়ে বেশি হলো ধারণা। তাই তো অসীমকে বাস্তব সংখ্যা (R) বলা হয় না।

অসীমকে মহাবিশ্বের সঙ্গে মেলাতে গেলে গোলমালটা দ্বিগুণ হয়। আমরা এখনো নিশ্চিতভাবে জানি না মহাবিশ্ব কত বড়। মহাবিশ্ব অসীম হলে এর আকার নিয়ে আর ভাবার তেমন কিছু নেই। তবে অসীম না হলে মহাবিশ্বের একটি নির্দিষ্ট আকার থাকবে। কিন্তু গোলমালটা হলো আমরা কখনোই পুরো মহাবিশ্বকে দেখতে পাব না। হ্যাঁ, মহাবিশ্ব সসীম হলেও পারব না। কারণ হলো, মহাবিশ্বের প্রসারণ। আর আলোর বেগের সামান্যতা। হ্যাঁ, বুঝেশুনেই আলোর বেগকে সামান্য বললাম। যদিও সে বেগ সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার। তাহলে কীভাবে কম হলো সে বেগ?

মহাবিশ্বের জন্ম আজ থেকে প্রায় ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে। সেই থেকে প্রসারিত হচ্ছে। জন্মের ১০-৩৬ সেকেন্ড পরে তো প্রসারণটা ছিল মারাত্মক। সে প্রসারণ স্থায়ী হয়েছিল জন্মের মাত্র ১০-৩২ সেকেন্ড পর পর্যন্ত। সময়টার নাম স্ফীতি যুগ। ওই সামান্য সময়েই মহাবিশ্বের সাইজ ১০-২৬ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। অন্যভাবে বললে, প্রোটনের চেয়ে ছোট একটি বস্তু তরমুজের সমান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এখনো প্রসারিত হয়ে চলেছে মহাবিশ্ব। তা–ও আবার প্রতিমুহূর্তে প্রসারণের হার বাড়ছে।

এবার আরেকটু ভাবি। মহাবিশ্বের জন্ম ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে, এ কথার অর্থ কী? অর্থ হলো, জন্মের পর মহাবিশ্বের দূরতম অঞ্চল থেকে আমাদের কাছে আলো এসে পৌঁছানোর জন্য সময় পেয়েছে ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর। তার মানে ১ হাজার ৩৮০ কোটি আলোকবর্ষের বেশি দূরের বস্তু আমরা দেখতে পারব না। তার মানে, পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বিবেচনা করলে প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া যায় পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ২ হাজার ৮০০ আলোকবর্ষ।

এটার আরও গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য অন্যখানে। মহাবিশ্বের আকার যদি ১ হাজার ৩৮০ কোটি আলোকবর্ষের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সেই দূরত্বের চেয়ে দূরের কোনো বস্তু আমরা কখনো দেখব না। কারণ, সেখান থেকে কোনো দিনই আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাবে না। সসীম মহাবিশ্বকেও পুরোটা দেখতে না পারার জন্য এই কারণটাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আরও বড় কারণও রয়েছে।

একটু আগে আমরা বললাম, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের প্রাথমিক আকার ২ হাজার ৮০০ আলোকবর্ষ হতে পারে। আসলে কিন্তু আরও বেশি। কারণ ওই যে মহাবিশ্বের প্রসারণ। আমরা যে আগে ব্যাসার্ধ বলেছিলাম ১ হাজার ৩৮০ আলোকবর্ষ, প্রসারণের কারণে সেই ব্যাসার্ধ এখন ফুলে–ফেঁপে হয়েছে আরও বেশি। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বলছেন প্রসারণের কারণে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের বর্তমান ব্যাসার্ধ হবে ৪ হাজার ৭৫০ কোটি আলোকবর্ষ। তার মানে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দূরত্ব হবে ‘অন্তত’ ৯ হাজার ৩০০ আলোকবর্ষ। তার মানে শুধু পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বেরই এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে আলো পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ১০ হাজার কোটি বছর। সময় যত গড়াবে, সেই দূরের প্রান্তটি আরও দূরে সরতে থাকবে। ফলে সেই প্রান্তকে আর কখনো দেখা হবে না আমাদের। কারণ, সেটা দেখতে হলে আলোর বেগকে আমাদের চোখে এসে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু আলোর বেগ যে অত্যন্ত সামান্য! ফলে মহাবিশ্বের একটি অংশ সব সময় আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরেই থেকে যাবে।

এখানে একটি কথা বলে না রাখলেই নয়। পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের কেন্দ্র কিন্তু আমরা পৃথিবীকে ধরেছি । কিন্তু এর মানে এই নয় যে মহাবিশ্বেরও কেন্দ্র পৃথিবী। মোটেও তা নয়। আসলে মহাবিশ্বের নির্দিষ্ট কোনো কেন্দ্রই নেই। সেটার কারণ আপাতত আলোচনার সুযোগ নেই। আমরা মূল কথায় ফিরে যাই।

এ তো গেল মহাবিশ্ব সসীম হলে তার কথা। কিন্তু অসীম হলে? আগেই বলেছি, ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে। তবু একটু ভাবার চেষ্টা করি। এক ঘনমিটারের একটি স্থানের কথা ভাবুন। এখানে অবশ্যই সসীম সংখ্যক সম্ভাব্য কণা থাকতে পারে। জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল নাম্বারফাইলের টনি প্যাডিলা হিসাব করে দেখেছেন কণার সংখ্যা হয় (১০১০)৭০। কণার সংখ্যা অসীম হওয়া সম্ভব নয়। কেননা, প্রতিটি কণারই থাকবে নিজস্ব স্পিন বা ঘূর্ণন, চার্জ, অবস্থান, বেগ ইত্যাদি। এসব বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে অসীম পরিমাণ কণা থাকা সম্ভব নয়। কথাটাকে আরও সহজ করে বললে হয়, মহাবিশ্বে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যধারী কণার সংখ্যা অসীম হওয়া সম্ভব নয়।

এটাও ঠিক যে মহাবিশ্বে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যধারী কণার সম্ভাব্য পরিমাণটা এত বিশাল যে মহাবিশ্বের সব পেনসিল দিয়েও সংখ্যাটাই লিখে শেষ করা যাবে না। সে তুলনায় পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে কণার সংখ্যা মাত্র ১০৮০। তার মানে, মাত্র ১ ঘনমিটার আয়তনের মধ্যেই ঢের বেশি পরিমাণ স্বতন্ত্র কণাকে স্থান দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু! কিন্তু মহাবিশ্ব অসীম হলে?

কী হবে ভাবার আগে মাথায় রাখুন, মহাবিশ্বে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র কণার সংখ্যা অনেক বেশি হলেও সংখ্যাটা সসীম। কিন্তু অসীম মহাবিশ্বে এত বড় সংখ্যারও কোনো বাহাদুরি নেই। ফলে আপনি পৃথিবী থেকে ভ্রমণ করে দূরে যেতে থাকলে একসময় সম্ভাব্য সব কণার বিন্যাস শেষ হয়ে যাবে। ফলে একসময় আপনি আগের কণার একই রকম বিন্যাস দেখা শুরু করবেন। তার মানে একসময় আপনি ঠিক আপনারই মতো একজন মানুষকে পেয়ে যাবেন। আপনার প্রিয় পোষা প্রাণীটার মতো আরেকটা প্রাণীও খুঁজে পাবেন। অবিকল নকল জিনিস এভাবে পেতে থাকবেন। যত সামনে যাবেন, তত এমন নকল জিনিস আসতে থাকবে।

আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আপনি যত সামনে যাবেন, তত নকলের আকার বড় হবে। নকল পাড়া-মহল্লা, শহর, দেশ থেকে পেতে পেতে একসময় আপনি পুরো মহাবিশ্বের নকল আরেকটা মহাবিশ্বই পেয়ে যাবেন। সেটা পাওয়ার জন্য মাল্টিভার্স তত্ত্বও লাগবে না। এগুলো হবে আমাদের মহাবিশ্বের মধ্যেই নকল মহাবিশ্ব।

আর প্রসারণ? তাত্ত্বিকভাবে অসীম বস্তুরও প্রসারণ থাকতে পারে। কিন্তু ওই যে বললাম, অসীম একটা গোলমেলে বস্তু। অসীম বস্তু প্রসারিত হলেও আগের চেয়ে বড় হবে না। কারণ, আগেও অসীম ছিল, আর এখন যা হয়েছে সেটাও অসীম। অসীম যে সংখ্যা হতে পারে না, সেটারও আরেকটা বাস্তব উদাহরণ দেখা গেল। তবে আসলেই মহাবিশ্ব অসীম না সসীম, সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক: প্রভাষক (পরিসংখ্যান), পাবনা ক্যাডেট কলেজ

সূত্র: স্পেস ডট কম, ডিসকভারি ম্যাগাজিন, ম্যাথইনসাইট ডট অর্গ, ফিজ ডট অর্গ, মিডিয়াম ডট কম ও হিডেন রিয়েলিটি/ ব্রায়ান গ্রিন