ঈদের চাঁদের রহস্য

ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। কাল ঈদ। রিমার মনে অনেক প্রশ্ন। ঈদের চাঁদ কেন ক্ষণস্থায়ী? মাত্র কয়েক মিনিট পশ্চিম দিগন্তে দেখা দিয়েই কেন টুপ করে ডুবে যায়? প্রতিদিন সকালে নতুন সূর্য ওঠে পুবের আকাশে, অথচ ঈদের নতুন চাঁদ ওঠে পশ্চিমের আকাশে—এই পার্থক্যই-বা কেন? এই সব প্রশ্নের উত্তর...

হঠাৎ একটা হাসির রোল! সবাই হাসছে।

রিমা সংবিৎ ফিরে পেল। ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। কাল ঈদ। সবাই খুশিতে নাচছে। আর সে কি না ছাদের এক কোণে খাতা-কলম নিয়ে গণিতের কঠিন হিসাবনিকাশ করতে বসে গেছে। চাঁদের নাড়ি-নক্ষত্র বের করতে স্মার্টফোনে গুগল সার্চ করছে।  

ঈদের আনন্দে যোগ দিতে রিমার কাজিনরা সবাই এসেছে। প্রতিবারই আসে। বাসার ছাদে উঠে ভাইবোনেরা সবাই পশ্চিম আকাশের দিগন্তরেখার দিকে নজর রাখছিল। সবাই দেখছে, ঈদের চাঁদ উঠল কি না। কার আগে কে দেখে, তারই প্রতিযোগিতা। চাঁদ দেখাও গেল। চারদিকে বাজির শব্দ। কিন্তু রিমা অন্য জগতে।

রিমার মহাবিজ্ঞানী ভাবসাব দেখে অয়ত্রী, সুমিতি, নিলয়, আরফান, আয়ানা, মালিহা, সায়ন, শ্রেয়সী, ইথিকা, কঙ্কন, আরিশা, রিমঝিম, প্রাঙ্গণ—সবাই হেসে কুটিপাটি।

রিমার মনে অনেক প্রশ্ন।

আচ্ছা, ঈদের চাঁদ কেন ক্ষণস্থায়ী? মাত্র কয়েক মিনিট পশ্চিম দিগন্তে দেখা দিয়েই কেন টুপ করে ডুবে যায়? আবার ঈদের একচিলতে চাঁদ কখনো আকাশের ডান দিকে কিছুটা হেলে থাকে, ইংরেজি অক্ষর ‘C’-এর উল্টারূপে, কখনো দিগন্তরেখার সমান্তরালে নৌকার মতো। এ রকম কেন? প্রতিদিন সকালে নতুন সূর্য ওঠে পুবের আকাশে, অথচ ঈদের নতুন চাঁদ ওঠে পশ্চিমের আকাশে—এই পার্থক্যই-বা কেন?

এ রকম অনেক প্রশ্নের উত্তর তার চাই। সে জন্য রিমা খাতা-কলম নিয়ে বসে গেছে।

অবশ্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই রিমা তার স্মার্টফোনে এক ক্লিকেই সব প্রশ্নের উত্তর বের করে ফেলল। আবার কাগজ-কলমে এঁকে একটা এক্সপেরিমেন্টও করে ফেলল।

এক্সপেরিমেন্টটা এ রকম: অন্ধকার ঘরে এক পাশে একটা বাতি জ্বলছে, সেটা সূর্য। কিছু দূরে সে নিজে দাঁড়িয়ে আছে। ধরা যাক সে পৃথিবী। এখন এক হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে একটা টেনিস বল ধরে রেখেছে। এই বলটা চাঁদ। এ অবস্থায় সে নিজের চারপাশে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিভিন্ন অবস্থানে দেখছে বলটাকে বাতির আলো কখন কতটা আলোকিত করছে। এভাবে সে বুঝে নিচ্ছে, আমরা কেন রাতের আকাশে চাঁদকে দিনে দিনে ছোট-বড় হতে দেখি।

আর তখন তার আনন্দ দেখে কে!

ছুটে এল রিমঝিম, প্রাঙ্গণ, তরী।

ওরা ধমকের সুরে বলল, এই, চিল্লাস কেন রে?

রিমা শুধু বলে, ইউরেকা, ইউরেকা! সব জেনে গেলাম।

কী জানলি রে?

অনেক কিছু। সব, সব। শুনবি?

ওর কাজিনরা সবাই রিমাকে ঘিরে ধরে। বল না আমাদের। আকাশের কথা। চাঁদের কথা।

রিমা বলল, ওসব বুঝতে একটু মাথা খাটাতে হয়, বুঝলি?

চাঁদের বিভিন্ন দশা

শোন, পৃথিবী নিজের অক্ষরেখার চারপাশে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে বলে যেমন প্রতিদিন সকালে সূর্য পুবের আকাশে ওঠে আর সন্ধ্যায় পশ্চিমের আকাশে অস্ত যায়, চাঁদও ঠিক তাই। সে পৃথিবীর চারপাশে পশ্চিম থেকে পুব দিকে ঘুরছে। সে জন্যই পূর্ণিমার চাঁদ পুবের আকাশে ওঠে। আর শেষ রাতে পশ্চিমে অস্ত যায়।

কিন্তু প্রতিদিন চাঁদ পুব দিকে একটু পিছিয়ে পড়ে। প্রায় ১৩ ডিগ্রি পুব দিকে পিছিয়ে পড়ে। এ জন্য পরদিন আকাশে চাঁদ উঠতে প্রায় ৫৩ মিনিট দেরি হয়। মানে, সূর্য ডোবার আগেই চাঁদ আকাশে ওঠে, কিন্তু সূর্যের আলোর জন্য আলোকিত চাঁদ আমরা দেখতে পাই না। দৃশ্যমান হয় সূর্যাস্তের পর। প্রতিদিনই আকাশে চাঁদ আগের দিনের চেয়ে প্রায় ৫৩ মিনিট দেরিতে ওঠে।

মহাবিশ্বের অন্য নক্ষত্রদের অবস্থানের তুলনায় একই অবস্থানে ফিরে আসতে চাঁদের প্রায় ২৮ দিন (২৭ দিন ৮ ঘণ্টা) সময় লাগে। একে বলা হয় সাইডেরিয়াল মান্থ। কিন্তু এ সময়ে সূর্যের অবস্থান একটু এগিয়ে যায়। তাই আকাশে সূর্যের অবস্থানের তুলনায় একই স্থানে ফিরে আসতে চাঁদের সময় লাগে প্রায় সাড়ে ২৯ দিন। একে বলে সাইনোডিক মান্থ।

তার মানে দাঁড়াল, পূর্ণিমার পর প্রতি সন্ধ্যায় আগের সন্ধ্যার চেয়ে কিছু সময় পর পূর্ব দিগন্তের একটু ওপরে চাঁদ ওঠে, আকারে একটু ছোট হয়। পরদিন আরও একটু পর আকাশে চাঁদ ওঠে, আকারও একটু কমে। ফলে প্রতিদিনই আকাশে চাঁদের অবস্থানের সময় কমতে থাকে এবং আকারে ছোট হতে থাকে। এভাবে কমতে কমতে ২৮-২৯ দিন পর আকাশে চাঁদের অবস্থানকাল শূন্য হয়ে যাবে। তখন সূর্য ও চাঁদ একই সঙ্গে পৃথিবীর বিপরীত দিকে অবস্থান করবে। সেদিন আকাশে চাঁদ দেখা যাবে না। সে রাতটাই অমাবস্যা।

এর পরদিন পশ্চিম আকাশে চাঁদ দিগন্তরেখার সামান্য ওপরে খুব অল্প সময় অবস্থান করবে। সেটাই নতুন চাঁদ। একেবারে সুতার মতো একচিলতে চাঁদ। এর পরদিন চাঁদ পশ্চিম দিগন্তরেখার একটু ওপরে উদিত হবে, একটু চওড়া হবে এবং আগের দিনের চেয়ে একটু বেশি সময় আকাশে দেখা যাবে। এভাবে আবার প্রায় ১৫ দিন পর হবে পূর্ণিমা।

এ সময় কঙ্কন প্রশ্ন করল, কিন্তু ঈদের চাঁদ কখনো উল্টা ‘C’-এর মতো, কখনো নৌকার মতো দেখা যায় কেন?

রিমা একটু মাথা চুলকে বলল, এর ব্যাখ্যা অবশ্য একটু কঠিন। তবে সহজ করে বলা যায়, পৃথিবী যেহেতু সাড়ে ২৩ ডিগ্রি কোণে হেলানো অবস্থায় সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, সে জন্য যে কারণে ঋতুবৈচিত্র্য ঘটে, একই কারণে বিভিন্ন ঋতুতে নতুন চাঁদের অবস্থান একটু ভিন্ন রকম হয়। যেমন, মার্চ-এপ্রিল-মে এর দিকে নতুন চাঁদ দেখতে অনেকটা নৌকার মতো এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দেখা যাবে উল্টো ‘C’-এর মতো। আমরা উত্তর গোলার্ধে আছি বলে চাঁদকে আকাশে এভাবে দেখি। দক্ষিণ গোলার্ধে চাঁদের বাঁকটা ‘C’-এর মতোই দেখাবে।

এবার বুঝলে তো ঈদের চাঁদের সব রহস্য!

রিমার কাজিনরা কেউ বুঝে, কেউ না বুঝেই সায় দিল।

তারপর সবাই গান ধরল—রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ…