উনিশ শতকের ফরাসি প্রত্যক্ষবাদী দার্শনিক অগাস্তে কোঁত তাঁর সময়ে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। সমাজবিজ্ঞানের জনক গণ্য করা হয় এই দার্শনিককে। কারণ, সমাজবিজ্ঞানে প্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারের কৃতিত্ব তাঁর। তা ছাড়া ‘সোসিওলজি’ বা ‘সমাজবিজ্ঞান’ শব্দটিও চালু করেন তিনি। তবে বিজ্ঞান তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর পরিচিতি একটু নেতিবাচকভাবে। কারণ, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ১৮৩৫ সালে অগাস্তে কোঁত বলে বসলেন, ‘কোনো নক্ষত্রের রাসায়নিক গঠন মানুষ কখনোই জানতে পারবে না।’
সেকালের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুযায়ী কথাটা ফেলে দেওয়ার উপায় ছিল না। ঠিকই তো! মানুষ তো কখনোই নক্ষত্রের কাছে যেতে পারবে না। তাহলে নক্ষত্র কী কী মৌল দিয়ে তৈরি, তা জানার কোনো উপায়ও নেই। রাসায়নিক বিশ্লেষণের কথা এলেই টেস্ট টিউবে নমুনা ভরে সেগুলো সেদ্ধ করে, পুড়িয়ে কিংবা ব্লেন্ড করে তার ধর্ম নিয়ে গবেষণা করার কথা মাথায় ভাসে। কিন্তু বহুদূর নক্ষত্রকে নিয়ে তেমনটি করা মোটেও সম্ভব নয়। তাই কোঁতের কথায় খুব একটা ওজর–আপত্তি করলেন না কেউ।
১৮৫৭ সালে মারা যান অগাস্তে কোঁত। ঠিক তার দুই বছর পরেই দেখা গেল, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী একেবারে ভুল! কারণ, বিজ্ঞানীরা এমন একটি উপায় আবিষ্কার করে বসলেন, যেটা ব্যবহার করে পৃথিবীতে বসেই দূর নক্ষত্রের গাঠনিক রাসায়নিক উপাদান বলে দেওয়া যাবে সঠিকভাবে। শুধু তা–ই নয়, বলে দেওয়া যাবে তার গতিবেগও। কী সেই প্রযুক্তি? আর তার পেছনের বিজ্ঞানটা কী?
প্রতিটি মৌল থেকে অনন্য বর্ণালি পাওয়া যায়, সেটা অন্য কোনো মৌলের বর্ণালির সঙ্গে মেলে না। মানুষের হাতের ছাপ যেমন একজনের সঙ্গে আরেকজনেরটা মেলে না, এটাও অনেকটা তেমন
এ বিষয়ে প্রথম পদক্ষেপটা শুরু হয়েছিল বেশ আগে। তখন অগাস্তে কোঁতের বয়স মাত্র চার বছর। মানে, ১৮০২ সালের ঘটনা সেটা। কাজটা শুরু হয়েছিল ইংরেজ পদার্থবিদ উইলিয়াম হাইড ওলাস্টোনের হাতে। এ বিজ্ঞানী ছিলেন আংশিক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। কিন্তু তাঁর হাতেই সে যুগে শুরু হয়েছিল আলোকবিদ্যা বা অপটিকসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ। সে সময় তিনি কাচের প্রিজমের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো ফেলে আলোকবর্ণালি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এ ধরনের গবেষণার সূচনা হয়েছিল বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের হাতে। এভাবেই আলোকবিদ্যা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেন নিউটন। তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ওলাস্টোন প্রথম সরু একটা নলের ভেতর সূর্যের আলো প্রবাহিত করেন। তারপর সেই সরু আলোকরশ্মি একটি প্রিজমের ওপর ফেলে তা ভাঙে রংধনুর সাতটি রঙে। এভাবে পাওয়া গেল সৌরবর্ণালি বা সোলার স্পেকট্রাম।
সৌরবর্ণালি পরীক্ষা করতে গিয়ে ওলাস্টোন দেখতে পান, রংগুলোর মাঝখানে বেশ কিছু কালো দাগ বা রেখা। দাগগুলোর কারণে রংগুলো পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে আছে। লাল রঙের অংশে দুটি, সবুজ অংশে তিনটি ও নীল ভায়োলেট অংশে দুটি কালো দাগ খুঁজে পেলেন ওলাস্টোন। কিন্তু তিনি ভাবলেন, রংগুলোর মাঝখানে ওগুলো আসলে স্রেফ ফাঁকা জায়গা, আর কিছু নয়। তাই এর কার্যকারণ নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করলেন না তিনি। তাই হাতের মুঠোয় রত্ন পেয়েও তার গুরুত্বটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারলেন না পদার্থবিদ ওলাস্টোন। তাঁর ধারণাটা আসলে ভুল ছিল।
সেটা বুঝলেন জার্মান বিজ্ঞানী জোসেফ ভন ফ্রনহফার। ওলাস্টোনের এই গবেষণার কথা শুনে এ বিষয়ে কৌতূহলী হন কয়েকজন বিজ্ঞানী। ফ্রনহফার ছিলেন তেমনই একজন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ বিষয়ে গবেষণা করেন তিনি। তার সুবিধা হলো এ গবেষণায় ওলাস্টোনের চেয়ে কিছুটা উন্নত মানের প্রিজম ও সরু নল ব্যবহার করেছিলেন। এভাবে বিশেষ কায়দায় প্রিজম আর সরু নল ব্যবহার করে ফ্রনহফার যে যন্ত্রটি তৈরি করলেন, সেটাই একসময় পরিচিত হয়ে উঠল স্পেকট্রোস্কোপ হিসেবে। বাংলায় যাকে বলি বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্র।
১৮১৫ সালের দিকে এই যন্ত্র দিয়ে আরও স্পষ্টভাবে সৌরবর্ণালি পরীক্ষা করার সুযোগ পান ফ্রনহফার। ক্রমে ৫৭৪টি আলাদা রেখা শনাক্ত করেন। সেগুলো ক্রমে লিপিবদ্ধ করে রাখেন তিনি। এসব রেখাকে বর্ণমালার অক্ষর ব্যবহার করে চিহ্নিতও করেন। তাঁর আবিষ্কৃত কয়েকটি লাইন এখনো বারবার উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে আছে সোডিয়ামের জন্য ডি লাইন বা ক্যালসিয়ামের জন্য এইচ ও কে লাইন। এরপর আরও কিছু রেখা শনাক্ত করেন অন্য বিজ্ঞানীরা। ফ্রনহফারের সম্মানে বর্তমানে সৌরবর্ণালির সব রেখা বা দাগকে বলা হয় ফ্রনহফার লাইন। ছোট্ট একটা জায়গায় রেখাগুলো এমনই ঠাসাঠাসি করে থাকে যে তাদের দেখতে অনেকটা বারকোডের মতো দেখা যায়। কিন্তু এই রেখাগুলো আসে কোথা থেকে? বর্ণালিরেখায় তাদের থাকার কারণটা কী?
এসব প্রশ্নের আংশিক জবাবটা ১৮৫০-এর দশকের শেষে দেন নামকরা জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট বুনসেন ও গুস্তাভ কার্শভ। রসায়ন পড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছেই বুনসেনের নাম পরিচিত। কারণ, রসায়ন ল্যাবে যে বুনসেন বার্নার ব্যবহার করা হয়, সে নামটি এসেছে এই রবার্ট বুনসেনের নাম থেকে। মজার ব্যাপার হলো, তিনি আসলে এর উদ্ভাবক নন। আসলে এ ধরনের বার্নার প্রথম উদ্ভাবন করেছিলেন মাইকেল ফ্যারাডে। পরে তা আরও উন্নত ধরনের বার্নার বানান বুনসনের সহকারী পিটার ডেসাগা। তাতে বুনসেনেরও কিছুটা অবদান ছিল। কিন্তু মূল কাজটা আসলে করেছিলেন ডেসাগা। বুনসেন তখন বেশ নামকরা বিজ্ঞানী। তাই ডেসাগা ভাবলেন, বুনসেনের নামে বার্নারটা নামকরণ করে বাজারজাত করা হলে ব্যবসায়িক সাফল্য পাওয়া যাবে। তার পরের কাহিনি তো ইতিহাস। ডেসাগার সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল, তা বিশ্বের যেকোনো রসায়ন ল্যাবে ঢুকলেই বোঝা যায়। অবশ্য আমাদের আলোচ্য বিষয় বুনসেন বার্নার কে উদ্ভাবন করলেন, তা নিয়ে নয় বরং বুনসেন ও কার্শফ কী করেছিলেন।
১৮৫০ সালের দিকে জার্মানি শহর হাইডেলবার্গে বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করার পদ্ধতি চালু হয়েছিল। সে জন্য বাতাসহীন কোনো প্রকোষ্ঠে কয়লাকে প্রচণ্ড উত্তপ্ত করা হতো। ফলে তৈরি হতো হাইড্রোজেন, কার্বন মনোক্সাইড, মিথেন, ইথিলিনসহ উদ্বায়ী হাইড্রোকার্বন গ্যাস। এ গ্যাসই পাইপের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে নিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো সেকালে। একইভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারেও নানা কাজে ব্যবহার করা হতো এ গ্যাস। গ্যাসটি সহজলভ্য হওয়ার কারণে বুনসেন বার্নার বানানোর কথা মাথায় আসে বিজ্ঞানী পিটার ডেসাগার। বার্নারে দাহ্য গ্যাসের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিতভাবে অক্সিজেন মেশানো হতো। ফলে পাওয়া যেত স্বচ্ছ এক শিখা। কাজেই ফ্লেম টেস্ট বা শিখা পরীক্ষার জন্য বুনসেন বার্নার হয়ে ওঠে আদর্শ হাতিয়ার। এই পরীক্ষায় কোনো পদার্থ পুড়িয়ে উৎপন্ন শিখার রং থেকে পদার্থটি শনাক্ত করা হয়।
এ ধরনের পরীক্ষায় বুনসেন কালার ফিল্টার ব্যবহার করে কাজটি করতেন। কিন্তু কী মনে করে কার্শফ একদিন বললেন, স্পেকট্রোস্কোপি ব্যবহার করে হয়তো আরও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। সেটা সত্যিই হয় কি না, সেটা একসঙ্গে পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নেন বুনসেন ও কার্শফ। সে জন্য তাঁরা একটা যন্ত্র বানান, যেখানে একটি সরু স্লিট বা নল বসানো ছিল, যাতে তার ভেতর দিয়ে আলো নিয়ে প্রিজমের ওপর ফেলা যায়। এ ছাড়া একটি কোলিম্যাটর বসানো হয় আলোকরশ্মিকে আরও সরু করার জন্য। ছিল একটি প্রিজম, যা আলোকে ভেঙে রংধনুর সাত রঙে ভেঙে ফেলতে পারে। সবশেষে রাখা হয়েছিল মাইক্রোস্কোপের মতো একটা আইপিস। বর্ণালিরেখা দেখার জন্য এই আইপিসে চোখ রাখতে হতো এই যন্ত্রে। এর আগেও স্পেকট্রোস্কোপে প্রথমবারের মতো প্রিজম আর আইপিস ব্যবহার করেছিলেন ফ্রনহফার। তবে সেগুলো ছিল আলাদা আলাদা। বুনসেন আর কার্শফের কৃতিত্ব হলো, তাঁরা সব কটি মিলিয়ে একটামাত্র যন্ত্র বানাতে সক্ষম হন। সালটা ১৮৫৯।
হাইডেলবার্গের এই বিজ্ঞানী জুটি এরপর বুনসেন বার্নারের বিভিন্ন মৌল রেখে পরীক্ষা করে দেখলেন। দেখা গেল, বিভিন্ন পদার্থকে বুনসেন বার্নারের স্বচ্ছ শিখার ওপর রাখলে সেগুলো পুড়ে ভিন্ন ভিন্ন রঙের শিখা পাওয়া যায়। যেমন সোডিয়াম পোড়ালে পাওয়া যায় হলুদ শিখা। তামা বা কপার পোড়ালে সবুজ/নীল রঙের শিখা পাওয়া যায়। এই শিখা থেকে পাওয়া আলো স্পেকট্রোস্কোপি ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করে দেখলেন বুনসেন ও কার্শফ। এভাবে উত্তপ্ত অবস্থায় প্রতিটি পদার্থ থেকেই বর্ণালিতে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের উজ্জ্বল রেখা পাওয়া গেল। সোডিয়ামের বর্ণালি পাওয়া যাচ্ছে বর্ণালিরেখার হলুদ অংশে এবং সবুজ/নীল অংশে পাওয়া যাচ্ছে তামার বর্ণালি। এভাবে অন্যান্য পদার্থ বা মৌলের ক্ষেত্রেই আলাদা ফলাফল পেলেন বুনসেন আর কার্শফ। এই হলুদ সোডিয়াম লাইনগুলোকেও ফ্রনহফার লাইন বলা হয়। কাচের আলোকধর্ম পরীক্ষা করতে এই লাইনগুলো ব্যবহার করতেন ফ্রনহফার। এভাবেই একসময় সৌরবর্ণালির দিকে ঝুঁকেছিলেন তিনি।
এভাবে বুনসেন ও কার্শফ অচিরেই বুঝতে পারলেন, যেকোনো উত্তপ্ত বস্তু বর্ণালিতে আলাদা আলাদা লাইন তৈরি করে। অর্থাৎ প্রতিটি মৌল থেকে অনন্য বর্ণালি পাওয়া যায়, সেটা অন্য কোনো মৌলের বর্ণালির সঙ্গে মেলে না। মানুষের হাতের ছাপ যেমন একজনের সঙ্গে আরেকজনেরটা মেলে না, এটাও অনেকটা তেমন। এই বর্ণালিও যেন নির্দিষ্ট কোনো মৌলের হাতের ছাপের মতো। এভাবেই গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার করে বসলেন জার্মান বিজ্ঞানী জুটি। আবিষ্কার তো হলো, এবার এটা কাজে লাগানো যায় কীভাবে? সে উপায়ও এক সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে যেন এই দুই বিজ্ঞানীর হাতে ধরা দিল।
সূর্য থেকে সোনা যদি এখানে নামিয়ে আনা সম্ভব না হয়, তাহলে মিছিমিছি ওই সোনা খুঁজে কী লাভ?
২
ঘটনাটা হলো, সেদিন হাইডেলবার্গে নিজেদের গবেষণাগারে কাজ করছিলেন বিজ্ঞানী জুটি। এমন সময় ম্যানহিম নামের একটি জায়গায় এক কারখানায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটল। জায়গাটা তাঁদের ল্যাব থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে। ল্যাবের জানালা দিয়ে সেই দৃশ্য চোখে পড়ল বুনসেন ও কার্শফের। হুট করে তাঁদের মাথায় দারুণ এক বুদ্ধি খেলে গেল। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা যায় ‘ইউরেকা’! কথিত আছে, দারুণ এক আবিষ্কারের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ বলতে বলতে রাস্তায় দিগম্বর হয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করেছিলেন প্রাচীন গ্রিসের বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস। তবে বুনসেন আর কার্শফ ঠান্ডা মাথার মানুষ। তাঁরা ভাবলেন, তাঁদের যন্ত্র আর পদ্ধতিটা পরীক্ষা করে দেখবেন। কাজেই স্পেকট্রোস্কোপে অগ্নিকাণ্ডের আলো বিশ্লেষণ করলেন তাঁরা। বর্ণালিরেখায় এমন কিছু লাইন দেখতে পাওয়া গেল, যা থেকে বোঝা গেল অগ্নিশিখায় স্ট্রোনটিয়াম ও বেরিয়ামের উপস্থিতি। পরদিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, তাঁদের কথা সত্যি। তার মানে, তাঁদের পদ্ধতিটা কাজ করছে।
কয়েক দিন পরের ঘটনা। এক বিকেলে নদীর তীর ধরে হাঁটতে বেরিয়েছেন ওই দুই জার্মান বিজ্ঞানী। হাইডেলবার্গের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে এই নদী। নাম নেকবার। কথিত আছে, শেষ বিকেলের সেই আলোয় বুনসেন নাকি কার্শফকে বলেছিলেন, ‘আমরা যদি এত দূর থেকে ম্যানহিমের পোড়া বস্তুর প্রকৃতি শনাক্ত করতে পারি, তাহলে সূর্যের বস্তুও তো এভাবে শনাক্ত করতে পারার কথা।’
বুনসেনের এই ছোট্ট কথাই জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বলাই বাহুল্য, এরপর নিজেদের স্পেকট্রোস্কোপের মুখটাও সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে দেন এই জার্মান জুটি। আগেই বলেছি, বর্ণালিতে ফ্রনহফার বেশ কিছু কালো রেখা শনাক্ত করেছিলেন। বুনসেন ও কার্শফ দেখতে পেলেন, ল্যাবরেটরিতে বসে বিভিন্ন মৌল বা পদার্থকে উত্তপ্ত করে স্পেকট্রোস্কোপে বর্ণালির নির্দিষ্ট জায়গায় যেসব উজ্জ্বল রেখা পাওয়া গেছে, এই কালো রেখাগুলোও বর্ণালির ঠিক সেসব অংশেই অবস্থিত। এমনকি তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্যও হুবহু এক।
বুনসেন বার্নারে নির্দিষ্ট কোনো মৌলকে উত্তপ্ত করা হলে বর্ণালিতে উজ্জ্বল রেখা পাওয়া যায়। বর্ণালিতে ঠিক যেসব জায়গায় ফ্রনহফারের কালো রেখা পাওয়া যায়, ঠিক সেসব জায়গাতেই পাওয়া যায় এসব উজ্জ্বল রেখা। তাই কার্শফ ধারণা করলেন, এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উজ্জ্বল রেখাগুলো আসে উত্তপ্ত গ্যাস থেকে। অন্যদিকে শীতল কোনো গ্যাসের ভেতর দিয়ে আলো আসার সময় কিছু আলো শোষিত হয়। সে কারণেই বর্ণালিতে দেওয়া যায় কালো রেখা। আসলে ওই রংগুলো শীতল গ্যাস শুষে নেয়, তাই বর্ণালিতে তাদের উপস্থিতি কালো দেখায়।
সৌরবর্ণালিতেও আসলে ঠিক এই ঘটনা ঘটে। কারণ, সূর্যের বাইরের স্তরে এসব মৌলের উপস্থিতি। সূর্যের বাইরের এই স্তর ভেতরের স্তরের তুলনায় শীতল। ভেতরের উষ্ণ স্তর থেকে বাইরের তুলনামূলক শীতল স্তরে আলো আসার সময় নির্দিষ্ট কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষিত হয়। তার ওপর সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে ছড়িয়ে আছে কত শীতল গ্যাসমেঘ ও ধূলিকণা। এসবের মধ্য দিয়ে আলো শোষিত হতে হতে এসে পৌঁছে পৃথিবীতে। ফলে বর্ণালিরেখায় উজ্জ্বল রেখার অনুপস্থিতি ধরা পড়ে। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কালো রেখা দেখা যায়। বিষয়টিকে এভাবেই ব্যাখ্যা করলেন কার্শফ।
কিন্তু তখন পর্যন্ত কেউ জানে না যে এই রেখাগুলোর উৎপত্তি কেন হয়। সে জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও প্রায় অর্ধশতাব্দী। বিশ শতকে ডাচ বিজ্ঞানী নীলস বোর আর তাঁর দলবলের হাতে পারমাণবিক গঠনের জন্য কোয়ান্টাম তত্ত্ব গড়ে তোলার পরই এর সঠিক কারণটা বোঝা সম্ভব হয়।
সেটা সাধারণভাবে বোঝার চেষ্টা করা যাক। অবশ্য আগেই বলে রাখছি, এটা আক্ষরিক অর্থে পুরোটা সঠিক নয়। শুধু বোঝার সুবিধার্থে এই উদাহরণ দেওয়া। হাইড্রোজেন পরমাণুর কথা ধরা যাক। এ পরমাণুর মাঝখানে একটি প্রোটন রয়েছে। এই নিউক্লিয়াসের চারপাশে একটিমাত্র ইলেকট্রন ঘুরপাক খাচ্ছে। নিউক্লিয়াসের চারপাশে ভিন্ন ভিন্ন প্রধান শক্তিস্তর রয়েছে। একে ইংরেজি ছোট হাতের এন (n) বর্ণ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। একটি ইলেকট্রনকে শুধু একটি শক্তিস্তরে খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ n = 1, 2, 3...ইত্যাদিতে। প্রতিটি পরমাণুর ইলেকট্রনসংখ্যা নির্দিষ্ট, যা অন্য পরমাণু থেকে একেবারেই আলাদা। শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের এই বিন্যাসকে যেকোনো পরমাণুর হাতের ছাপ বলা যায়। কারণ, এই বিন্যাস অন্য মৌলের পরমাণুর থেকে আলাদা।
পরমাণুর সঙ্গে কোনো ফোটনের সংঘর্ষের সময় একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। ফোটনের শক্তি যদি পরমাণুর দুটি শক্তিস্তরের মধ্যকার পার্থক্যের সমান হয়, তাহলে নিম্ন শক্তিস্তরের ইলেকট্রনটি ওই ফোটন শুষে নিতে পারে। এরপর ইলেকট্রনটি লাফ দিয়ে ওপরের শক্তিস্তরে চলে যাবে। এভাবে পরমাণুটি উত্তেজিত হয়। এভাবে কোনো ফোটনের শক্তি যথেষ্ট শক্তিশালী হলে ইলেকট্রনটি মুক্ত হয়ে পরমাণুর বাইরে ছিটকেও চলে যেতে পারে। একে বলে আয়নায়ন বা আয়োনাইজেশন। কিন্তু পরমাণুর উচ্চ শক্তিস্তরের কোনো ইলেকট্রন ফোটন নিঃসরণ করে, তাহলে কী ঘটবে? সে ক্ষেত্রে ঘটবে ঠিক উল্টো ঘটনা। ইলেকট্রনটি ফোটন নিঃসরণ করে শক্তি হারাবে, ফলে সেটি নিম্ন শক্তিস্তরে চলে যাবে।
স্পেকট্রোস্কোপির ক্ষেত্রে প্রথমে ফোটন শোষণের কথা বলা যাক। ধরা যাক, কোনো গ্যাস উত্তপ্ত করা হয়েছে। এরপর ওই গ্যাস থেকে নিঃসৃত আলো যদি কোনো ঠান্ডা গ্যাসের ভেতর দিয়ে চালনা করে প্রিজমের ওপর ফেলা হয়েছে। এবার পর্যবেক্ষণ করলে বর্ণালিতে আমরা কিছু ফাঁকা জায়গা বা কালো রেখা দেখতে পাব। আসলে এই কালো রেখাগুলো শক্তির (তরঙ্গদৈর্ঘ্য) সঙ্গে সম্পর্কিত। হাইড্রোজেনের শক্তিস্তরের শক্তির পার্থক্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক। ইলেকট্রনের ফোটন শোষণই বর্ণালিরেখা হিসেবে দেখা যায়। কারণ, ফোটনের এই তরঙ্গদৈর্ঘ্য আসলে শোষিত হয়ে গেছে। এই বর্ণালিকে বলা হয় শোষণ বর্ণালি বা অ্যাবজর্বশন স্পেকট্রাম। আসলে গ্যাসকে উত্তপ্ত না করে ঠান্ডা অবস্থাতে রাখা হলে তার অণু-পরমাণুগুলো যেন নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে। তার আর নড়াচড়া করার শক্তিও থাকে না। তখন তার আর আলো বিকিরণ করার ক্ষমতা থাকে না। তার ভেতর দিয়ে কোনো আলো পাঠালে দেখা যাবে, গ্যাসগুলো কিছু আলো শোষণ করছে। সব আলো নয়, বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বা বিশেষ রঙের কিছু আলো (সূর্যের আলোর ক্ষেত্রে এটা ঘটে)।
আরেকটি পরীক্ষায় ধরা যাক, কোনো গ্যাসকে খুবই উত্তপ্ত করা হলো। তাহলে সেই গ্যাস কিছু আলো বা ফোটন বিকিরণ করবে। তার মানে, তার কিছু শক্তি আলো হয়ে বেরিয়ে আসবে। প্রতিটি গ্যাস বা অণু-পরমাণুর পারমাণবিক গঠন আলাদা। আর কোন পদার্থ থেকে কোন রঙের আলো বেরিয়ে আসবে, তা নির্ভর করবে এই গঠনের ওপর। প্রতিটি পদার্থ থেকে আলাদা রঙের আলো বেরিয়ে আসবে। আগেই বলেছি, এটা প্রায় মানুষের হাতের ছাপের মতো। তাই আগে থেকে জানা থাকলে আলোর রং দেখেই বলে দেওয়া সম্ভব কোন আলোটা কোন পদার্থ থেকে আসছে। আলোকে প্রিজমের ওপর ফেলে আমরা যে বর্ণালি পাব, তাকে বলা হয় নিঃসরণ বর্ণালি বা অ্যামিশন স্পেকট্রাম। এই বর্ণালি আসলে শোষণ বর্ণালির ঠিক উল্টো। নিঃসরণ বর্ণালিতে কালো রেখার জায়গায় উজ্জ্বল রঙের রেখা দেখা যায়। বুনসেন আর কার্শফ ল্যাবে বিভিন্ন মৌল পরীক্ষা করতে গিয়ে এ ধরনের বর্ণালি পেয়েছিলেন।
কাজেই শোষণ বর্ণালিতে যে কালো রেখা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে সেই সব আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সম্পর্ক, যারা শোষিত হয়েছে। এসব কালো রেখার সঙ্গে নিঃসরণ বর্ণালির তরঙ্গদৈর্ঘ্য হুবহু মিলে যায়। শোষণ বর্ণালি পরীক্ষায় আমরা কিছু কালো রেখা দেখতে পাই। প্রতিটি কালো রেখা ভিন্ন ভিন্ন মৌলের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি, প্রতিটি মৌলের আলাদা বর্ণালি আছে। অর্থাৎ হাইড্রোজেন, হিলিয়াম বা সোডিয়ামের জন্য আলাদা বর্ণালি পাওয়া যাবে, যা অন্য কারও সঙ্গে মিলবে না। এটা অনেকটা পণ্যের গায়ের বারকোডের মতো, যা দিয়ে পণ্যটি শনাক্ত করা যায় আর সেখানে কোনো ভুলের আশঙ্কা থাকে না।
৩
১৮৬০-এর দশকে কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের এত কিছু জানা ছিল না। তবু সেটা না বুঝেও বুনসেন আর কার্শফের পদ্ধতি ব্যবহার করে জানা সম্ভব হলো সূর্য বা অন্যান্য নক্ষত্র কী দিয়ে তৈরি। সেবার সূর্যের আলো থেকে পাওয়া বর্ণালিতে কয়েক শ রেখা রেকর্ড করেন কার্শফ। সেখান থেকে ১৬টি ভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মৌল শনাক্ত করতে পারেন তিনি।
কার্শফের এই আবিষ্কার সম্পর্কে ১৮৫৯ সালের এক সহকর্মীকে কথা প্রসঙ্গে একবার বুনসেন মন্তব্য করেছিলেন, ‘একেবারেই অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার’। সত্যিই তা–ই। এভাবে পৃথিবীতে বসেই যে সূর্য বা অন্যান্য নক্ষত্রের গাঠনিক উপাদান বা মৌল সম্পর্কে জানা সম্ভব হবে, তা এর আগে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি। কিছুদিন পরেই পৃথিবীর বাইরে প্রথম কোনো মৌল আবিষ্কার করেন এক বিজ্ঞানী।
কার্শফের এই আবিষ্কার বার্লিনে প্রুশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসে তোলা হলো ১৮৫৯ সালের ২৭ অক্টোবর। এই দিনকেই এখন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের জন্মদিন ধরা হয়। অগাস্তে কোঁতের কথাটি মনে আছে তো। তাঁর সেই কথা মিথ্যা প্রমাণিত হতে সময় লাগল তিন দশক। শুধু তা–ই নয়, পৃথিবী তখন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত একটা মৌলও আবিষ্কৃত হয় সূর্যে। সেই মৌলটি হলো হিলিয়াম। এভাবে ধারাবাহিক আরও কিছু গবেষণায় দেখা গেল, মহাবিশ্বের সিংহভাগ মৌল হলো হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম।
শেষ করি মজার একটি ঘটনা দিয়ে। স্পেকট্রোস্কোপিতে চোখ রেখে সে সময় সূর্যে ভারী মৌল (যেমন লোহা, সোনা ইত্যাদি) আছে কি না, তার খোঁজ চালাচ্ছিলেন গুস্তাভ কার্শফ। সে সময় নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাত–দিন গবেষণায় মগ্ন থাকতেন তিনি। খবরটা জানতে পেরে খুব একটা খুশি হলেন না কার্শফের ব্যাংক ম্যানেজার। এই নিয়ে মাতামাতির কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না তিনি। ভীষণ বিরক্ত হয়ে কার্শফকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘সূর্য থেকে সোনা যদি এখানে নামিয়ে আনা সম্ভব না হয়, তাহলে মিছিমিছি ওই সোনা খুঁজে কী লাভ?’
বেশ কয়েক বছর পর এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের জন্য সোনার মেডেল পেলেন কার্শফ। সেটা হাতে নিয়ে তিনি সোজা ছুটলেন সেই ব্যাংক ম্যানেজারের কাছে। মেডেলটা দেখিয়ে তাকে বললেন, ‘এই যে দেখো, সূর্য থেকে সোনা এসেছে।’
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: নক্ষত্রের গান/ বিমান নাথ, আনন্দ পাব. কলকাতা, ২০১৬
বিগ ব্যাং/ সাইমন সিং