সৌরজগতের সবচেয়ে কম ও বেশি বয়সের গ্রহ কোনটি
একান্নবর্তী পরিবারের মতো আমাদের সৌরজগতটাও বেশ বড়সড়। পরিবারের কর্তা যদি হন সূর্য মামা, তবে তার চারপাশে ঘুরঘুর করা আটটি গ্রহ হলো তার সন্তান। আমাদের পৃথিবীও তাদের একজন। কিন্তু ভাই-বোনদের মধ্যে একটা সাধারণ প্রশ্ন তো থাকেই—কে বড় আর কে ছোট? কে আগে জন্মেছে আর কে পরে?
আমাদের জন্মনিবন্ধন সনদ বা বার্থ সার্টিফিকেট থাকে, কিন্তু গ্রহদের তো আর তা নেই! আজ থেকে প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগের কথা। মহাকাশের এক বিশাল ধুলো আর গ্যাসের মেঘ বা নেবুলা ধসে পড়ে জন্ম হয়েছিল সূর্যের। কিন্তু সূর্যের জন্মের পরের ইতিহাসটা একটু ধোঁয়াশা। সৌরজগতের সবচেয়ে বয়ষ্ক গ্রহ কোনটি বা কোন গ্রহটি সবার আগে জন্মেছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝেও আছে বিতর্ক।
সেই বিতর্কে না গিয়ে আমরা বরং গ্রহের জন্মরহস্য জানার চেষ্টা করি। বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় যে তত্ত্বটি আছে, তার নাম অ্যাক্রিশন। সহজ কথায় বললে, ধুলো আর গ্যাস একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দলা পাকিয়ে বড় হতে থাকে। অনেকটা শীতকালে তুষারের বল বা লাড্ডু বানানোর মতো।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ মাইকেল মায়ারের মতে, এই যুক্তিতে সৌরজগতের গ্যাসীয় গ্রহরাই সবার আগে জন্মেছে। মানে শুরুতে বৃহস্পতি এবং শনি গ্রহের জন্ম হয়েছে।
কিন্তু কেন? পাথুরে গ্রহ কেন আগে জন্মালো না? কারণ, বৃহস্পতির মতো বিশাল গ্রহ তৈরি হতে প্রচুর পরিমাণ গ্যাসের দরকার হয়। সৌরজগতের শুরুতে প্রচুর গ্যাস ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্য সেই গ্যাস শুষে নিতে থাকে বা দূরে ঠেলে দেয়। তাই বৃহস্পতি বা শনিকে বড় হতে হলে খুব দ্রুত বড় হতে হয়েছে। আর এই দুটি গ্রহই যে সৌরজগতের সবচেয়ে বড়, তা তো এখন আমরা জানিই। সে হিসেবে এই গ্যাসীয় গ্রহ দুটিই সবার আগে তৈরি হয়েছে। কারণ, দেরি করলে তো গ্যাস ফুরিয়ে যেত!
তাহলে কি শুধু সম্ভাবনার ওপর দাঁড়িয়ে আছে গ্রহগুলোর বয়সের হিসাব?
অর্থাৎ, বৃহস্পতি ও শনি হলো সৌরজগতের বড় ভাই। তারা সূর্যের থেকে দূরে জন্ম নিয়েছিল, আর তাদের পরে সূর্যের কাছাকাছি জন্ম হয়েছে পৃথিবী, মঙ্গল বা শুক্রের মতো পাথুরে গ্রহগুলোর।
কিন্তু বিজ্ঞান কি এতই সহজ? যুক্তরাষ্ট্রের পারডু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কাউয়ে বোরলিনা শুনিয়েছেন ভিন্ন এক সম্ভাবনার কথা। স্ট্রিমিং ইনস্ট্যাবিলিটি মডেল নামে এক থিওরি অনুযায়ী, হয়তো পাথুরে গ্রহগুলোই আগে তৈরি হয়েছে!
তাঁর মতে, পাথর আর ধুলো জমে ছোট গ্রহগুলো আগে তৈরি হয়েছে। এরপর যখন গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছিল, তখন বড় গ্রহগুলো আর বাড়তে পারেনি বা তখনই তাদের গঠন প্রক্রিয়া থেমে গেছে। অর্থাৎ, এই থিওরি মানলে আমাদের পৃথিবীও কিন্তু সিনিয়র সিটিজেন হতে পারে!
তাহলে কি শুধু সম্ভাবনার ওপর দাঁড়িয়ে আছে গ্রহগুলোর বয়সের হিসাব? না, বয়স মাপার আরেকটা অদ্ভুত উপায় আছে। সেটা হলো, কোন গ্রহকে দেখতে কতটা তরুণ লাগে! এমআইটির বিজ্ঞানী গায়া স্টুকি ডি কোয়ে বলছেন, গ্রহের জন্ম কবে সেটা বাদ দিয়ে যদি আমরা দেখি কোন গ্রহের পৃষ্ঠ কত নতুন, তবে হিসাব পুরো উল্টে যায়।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবী হলো সৌরজগতের সবচেয়ে কনিষ্ঠ গ্রহ! কেন? কারণ পৃথিবীতে টেকটোনিক প্লেট আছে, আগ্নেয়গিরি আছে, আছে বাতাস আর পানি। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর ওপরের মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে, আবার নতুন মাটি বা পাথর তৈরি হচ্ছে। অনেকটা নিয়মিত ফেশিয়াল করার মতো। তাই পৃথিবীর ওপরের ত্বক বা পৃষ্ঠ সবসময় ‘নতুন’ থাকে।
অন্যদিকে বুধ বা মঙ্গলের দিকে তাকান। ওগুলোর পৃষ্ঠ কোটি বছর আগের উল্কাপাতের গর্ত বা ক্রেটার আজও দগদগে। ওগুলোর পৃষ্ঠ বদলায় না, তাই দেখলেই ‘বুড়ো’ মনে হয়।
তাহলে কী দাঁড়াল? সৌরজগতের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রহ কোনটি? সত্যি বলতে, মহাকাশের এই ক্যালেন্ডারের হিসাব মেলানো বড্ড কঠিন। বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। কখনো তারা চাঁদে যাচ্ছেন, কখনো মঙ্গলে রোভার পাঠাচ্ছেন—উদ্দেশ্য একটাই, ওখানকার পাথর বা মাটির স্যাম্পল এনে সঠিক বয়সটা বের করা।
মঙ্গলে এখন পারসিভেরান্স রোভার স্যাম্পল বা নমুনা জোগাড় করে বসে আছে। যেদিন সেই মাটির দলা পৃথিবীতে আসবে, হয়তো সেদিনই আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারব, পৃথিবী আসলে সৌরজগতের সবচেয়ে কনিষ্ঠ নাকি জেষ্ঠ!
ততদিন পর্যন্ত, বৃহস্পতিকে বড় ভাই মেনে নেওয়াই বোধহয় নিরাপদ!
