পায়ে হেঁটে মঙ্গল গ্রহ ঘুরতে কত সময় লাগবে

মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন মানুষের বহুদিনের। ১৯৬৯ সালে প্রথম চাঁদ জয় করেছে মানবজাতি। এখন স্বপ্ন মঙ্গল জয়। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, ২০৩০-এর দশকে মানুষ পাঠানো হবে মঙ্গলে। তার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে অনেক আগে। কথা হলো, যাঁরা মঙ্গলে যাবেন, তাঁদের সম্পূর্ণ গ্রহটা একবার ঘুরতে কত সময় লাগবে? 

শুরুতেই স্মরণ করিয়ে দিই, মঙ্গলে ঘুরতে চাইলে আপনাকে ঘুরতে হবে পায়ে হেঁটে। কারণ সেখানে তো আমাদের জন্য কেউ গাড়ি নিয়ে রাখেনি। অবশ্য দ্য মার্শিয়ান মুভি দেখা থাকলে মনে হতে পারে, মার্ক ওয়াটনির মতো হয়তো সেখানে এক-দুটো রোভার রাখা থাকবে, বা নিজেই সেরকম কিছু বানিয়ে নেওয়া যাবে বুদ্ধি খাটিয়ে। কারণ চাঁদের পৃষ্ঠেও তো মানুষ রোভারে ঘুরেছে। তাহলে মঙ্গলে কেন নয়? 

দ্য মার্শিয়ান মুভির পোষ্টার

আসলে, পৃথিবী থেকে মঙ্গলগামী নভোচারীদের যাত্রা হবে একমুখী। মানে শুধু মঙ্গলে যেতে পারবেন, সেখান থেকে ফিরতে পারবেন না। কেন? কারণ পৃথিবী থেকে মঙ্গলে গিয়ে আবার তাঁকে নিয়ে ফেরার মতো জ্বালানি বিশিষ্ট নভোযান এখনো আমরা তৈরি করতে পারিনি। তাই প্রথম যাঁরা মঙ্গলে যাবেন, জেনে বুঝেই মৃত্যুর দিকে পা বাড়াবেন তাঁরা। এমন পরিস্থিতে নিজের সঙ্গে করে একটা গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করা আসলে বাড়াবাড়ি। 

যদি মঙ্গল গ্রহের বিষুবরেখা বরাবর হাঁটতে থাকেন, তাহলে হাঁটতে হবে ২১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। তবে একটা শর্টকার্ট পথ বা সংক্ষিপ্ত ব্যবস্থাও আছে।

যাহোক, প্রসঙ্গে ফিরি। জানেন হয়তো, মঙ্গলে এখনো সে অর্থে পানির অস্তিত্ব পাননি বিজ্ঞানীরা। গ্রহটির দক্ষিণ মেরুতে যে বরফ পাওয়া গেছে জমাট কার্বন ডাই-অক্সাইডে ঢাকা, তা ব্যবহারযোগ্য বলে ভাবার কোনো কারণ নেই। অর্থাৎ মঙ্গলে সাগর, মহাসাগর বা জলাশয় থাকবে না আপনার অপেক্ষায়। তাই জাহাজ বা ভেলা ভাসানোর চিন্তাও সরিয়ে রাখতে হবে বাধ্য হয়ে। সে জন্য আপনাকে হেঁটেই লাল গ্রহের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হবে। তাই চলুন জানার চেষ্টা করি, মঙ্গলে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে কত সময় লাগবে।

পায়ে হেঁটে ঘুরতে যে অনেক সময় লাগবে, তা নিশ্চয়ই মুখ ফুটে বলে দিতে হবে না। কিন্তু নির্দিষ্ট করে সময় বলা আসলে কঠিন। বলা উচিত, প্রায় অসম্ভব। কেন? এ ব্যাপারে আমাদের ধারণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক এরদাল ইগিট। তিনি বলেন, ‘মঙ্গলে হাঁটার সময় নির্ধারণ করতে আমাদের দুটি বিষয় পরিমাপ করতে হবে। নভোচারীর বেগ কত এবং প্রতিদিন সে কতটুকু হাঁটতে পারবে।’ 

মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠ

কিন্তু এই দুটি বিষয়ের কোনোটিই আপনি জোর দিয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না। কারণ প্রতিটি মানুষের চলার বেগ ও কাজের ক্ষমতা ভিন্ন। ধরুন, আপনিই মঙ্গলের সেই নভোচারী, যিনি মঙ্গলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াবেন। যদি মঙ্গল গ্রহের বিষুবরেখা বরাবর হাঁটতে থাকেন, তাহলে হাঁটতে হবে ২১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। তবে একটা শর্টকার্ট পথ বা সংক্ষিপ্ত ব্যবস্থাও আছে। সে জন্য আপনাকে হাঁটতে হবে মঙ্গলের মেরু অঞ্চল বরাবর। এতে পথ কমবে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার। কিন্তু তাতে বাড়বে ঝামেলা। এই অঞ্চলে এত ঠান্ডা যে স্পেসস্যুট ছাড়া আপনি জমে বরফ হয়ে যাবেন। নিশ্চয়ই স্পেসস্যুট পরেই থাকবেন। অক্সিজেন বা লাইফ সাপোর্টও থাকবে। তবে সামান্য খোঁচা লেগে বা কোনোভাবে যদি স্যুট খানিকটা ফেটে যায়? সে কথা মাথায় রেখে ভাবুন তো, মাইনাস ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠান্ডার মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? কথায় আছে, ‘সুপথের ঘোরাও ভালো।’

আপনি তো আর রোবট না যে টানা ৪ হাজার ঘণ্টা হাঁটবেন। মানুষ যেহেতু, নিশ্চয়ই বিশ্রাম নিতে হবে। খেতে হবে। ঘুমাতে হবে।

এখন মনে করুন, আপনার গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার। পৃথিবীতে মানুষ আসলেই গড়ে এই বেগে হাঁটতে পারে। কিন্তু মঙ্গলে হাঁটার গতি ঠিক এরকম হবে না। কারণ গ্রহটির মহাকর্ষ বল পৃথিবীর চেয়ে কম, পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ। আরও ব্যাপার আছে। পৃথিবীতে আপনার সঙ্গে করে খাবার বা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ঘুরতে হবে না, পরতে হবে না স্পেসস্যুট। কিন্তু মঙ্গলে এ সবই আপনাকে করতে হবে। ফলে কমে যাবে হাঁটার গতি। কিন্তু আমাদের যেহেতু একটা সংখ্যা ধরে নিতে হবে, তাই ধরে নিচ্ছি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার বেগে আপনি মঙ্গলে হাঁটবেন। তাহলে আপনার সময় লাগবে প্রায় ৪ হাজার ২৯০ ঘণ্টা, পৃথিবীর প্রায় ১৭৯ দিন। মঙ্গলে একদিন হয় পৃথিবীর ২৪.৭ ঘন্টায়। একে বলে সোল। সুতরাং ৫ কিলোমিটার বেগে হেঁটে মঙ্গল ঘুরতে আপনার লাগবে ১৭৪ সোল বা মঙ্গলের ১৭৪ দিন। অর্থাৎ মঙ্গল গ্রহের হিসেবে বছরের এক-চতুর্থাংশ সময়। বলে রাখি, মঙ্গলে ৬৬৮.৬ সোলে এক বছর হয়।

তবে এখানেও একটা ‘কিন্তু’ রয়ে যায়। আপনি তো আর রোবট না যে টানা ৪ হাজার ঘণ্টা হাঁটবেন। মানুষ যেহেতু, নিশ্চয়ই বিশ্রাম নিতে হবে। খেতে হবে। ঘুমাতে হবে। আবার টানা ৪ হাজার ঘণ্টা হাঁটার মতো অক্সিজেনও আপনার সিলিন্ডারে থাকবে না। ফলে অবশ্যই আপনাকে মাঝখানে থামতে হবে। 

ধরে নিই, আপনি প্রতি রাতে ৮ ঘণ্টা ঘুমাবেন। প্রতিদিন যে পরিমাণ হাঁটবেন, তাতে রাতে ৮ ঘণ্টার কম ঘুমালে চলবে না। মোট ঘুমে আপনার আরও ৫৬ সোল চলে যাবে। বোঝার সুবিধার্তে মঙ্গলের সোলকে আমরা দিন বলব এখন থেকে। এবার ধরে নিচ্ছি প্রতিদিন খাওয়া, বিশ্রাম, পোশাক পরিবর্তন, নিজেকে পরিষ্কার রাখা ও যাবতীয় কাজের জন্য প্রতিদিন আরও ৫ ঘণ্টা করে ব্যয় করবেন। তাতে যাবে মোট ৩০ বা ৩৫ দিন। তাহলে সব মিলিয়ে আপনার সময় লাগবে মঙ্গলের হিসেবে ১৭৪ + ৫৬ + ৩৫ = ২৬৫ দিন।

সৌরজগতের সবচেয়ে উঁচু পর্বত মঙ্গলে অবস্থিত। এর নাম অলিম্পাস মুন

তবে এতেও হয়তো সব সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ এই লেখার মধ্যে অনেকবার ধরি, মনে করি ব্যবহার করেছি। সবকিছু তো আর পাটিগণিত না যে ধরে নিয়ে সমাধান করে ফেলবেন। যেমন মঙ্গলে আছে সৌরজগতের সবচেয়ে বড় পর্বত, গিরিখাত। তা ছাড়া উঁচু নিচু জায়গা তো আছেই। সেসব পাড়ি দিতে নিশ্চয়ই আপনার সময় বেশি লাগবে। এই হিসাবটা শুধুই কল্পনার জন্য করা। বাস্তবে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরে বেড়ানোর সময় এখনো আসেনি। হয়তো একদিন এসব সমস্যার সমাধান করে নভোচারীরা ঘুরে বেড়াবেন মঙ্গলে। কিন্তু তখন তা দেখার জন্য আমরা থাকব কি না, কে জানে! 

লেখক: সদস্য, সম্পাদনা দল, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: স্পেস ডট কম, রয়্যাল মিউজিয়াম গ্রিনউইচ ও নাসা