পৃথিবীকে পাশ কাটানোর প্রায় ৪০ বছর পর হ্যালির ধূমকেতু আবারও ফিরছে পৃথিবীর দিকে। কোনো বিপর্যয় না হলে ২০৬১ সাল নাগাদ একে দেখে যাবে পৃথিবীর আকাশে। নাসার জ্যোতিবির্জ্ঞানীদের হিসাব বলছে, গত ৯ ডিসেম্বর, শনিবার হ্যালির ধূমকেতু সূর্য থেকে এর কক্ষপথের সর্বোচ্চ দূরত্ব, অর্থাৎ এপিহেলিওনে (অপসূর) পৌঁছেছে। সূর্য থেকে এ বিন্দুর দূরত্ব প্রায় ৩৫ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (এইউ)।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। এই দূরত্বকে ১ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট বা এইউ বলা হয়। এদিক থেকে ধূমকেতুটি এখন পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যকার দূরত্বের ৩৫ গুণ দূরে আছে। অর্থাৎ ধূমকেতুটির বর্তমান অবস্থান নেপচুনের কক্ষপথের বাইরে। প্লুটোর মহাজাগতিক উঠান থেকে ফিরতি পথ ধরেছে। সূর্য থেকে প্লুটোর কক্ষপথের দূরত্ব প্রায় ৩৯ এইউ।
নিউটন হ্যালিকে মহাকর্ষ সূত্রের সাহায্যে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন, এটি কোনো অলৌকিক জিনিস নয়। বরং গ্রহ-নক্ষত্রের মতোই একটি সাধারণ বিষয়। নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে বস্তুটি।
হ্যালির ধূমকেতু ৭৬ বছরে সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসে। এটি বর্তমানে এই কক্ষপথের মাঝামাঝি আছে। গত প্রায় ৩৮ বছর ধরে ধূমকেতুটি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এখন আগামী প্রায় ৩৮ বছর ধরে এটি আমাদের কাছে আসতে থাকবে।
শেষবার সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি, অর্থাৎ পেরিহেলিওনে (অনসূরে) ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬ সালে। মাত্র ৮ কোটি ৭৮ লাখ কিলোমিটার দূর দিয়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছিল সেবার। দূরত্বটা শুক্র গ্রহের কক্ষপথের কাছাকাছি। সেবার বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীর মানুষ এ ধুমকেত নিয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠেছিল।
২০০৩ সালের পর থেকে ধূমকেতুটি আর দেখতে পাননি বিজ্ঞানীরা। এর আগে, নভোযানের মাধ্যমে পৃথিবীতে বসেও একে শনাক্ত করা গিয়েছিল।
ধূমকেতু হলো বরফ ও ধুলোর গোলক। মহাজাগতিক এই বস্তু ঝাঁটার মতো লেজের কারণে বিশেষভাবে পরিচিত। সূর্যের বিকিরণের কারণে ধূমকেতুর বরফ বাষ্পীভূত হয়ে লেজ সৃষ্টি করে।
এটিই প্রথম ধূমকেতু, যার সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা ফিরে আসার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ১৬৮২ সালে ইংরেজ জ্যোতির্বিদ অ্যাডমন্ড হ্যালি ধূমকেতুটি পর্যবেক্ষণ করে এ অনুমান করেন। শুরুতে বাকিদের মতো হ্যালিও জানতেন না জিনিসটা আসলে কী। আকাশ পর্যবেক্ষণবিষয়ক ওয়েবসাইট আর্থস্কাই-এর মতে, তিনি প্রথমে এটাকে লোমশ নক্ষত্র বলে ধারণা করেছিলেন। পরে বিষয়টা ভালোভাবে বোঝার জন্য তিনি বন্ধু আইজ্যাক নিউটনের দ্বারস্থ হন।
ততদিনে নিউটনে মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করে রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন বিজ্ঞান মহলে। নিউটন হ্যালিকে মহাকর্ষ সূত্রের সাহায্যে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন, এটি কোনো অলৌকিক জিনিস নয়। বরং গ্রহ-নক্ষত্রের মতোই একটি সাধারণ বিষয়। নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে বস্তুটি। নিউটন তাঁর ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা বইয়ে ধূমকেতু নিয়ে লিখেছিলেন। তবে তাঁর সে রচনা সম্পূর্ণ ছিল না। নিউটনের বদৌলতে হ্যালি জিনিসটা নিয়ে আরও গবেষণা করেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখেন, বস্তুটি অতীতে আরও বহুবার দেখা গেছে পৃথিবীর আকাশে। অলৌকিক বা ক্ষতিকর বস্তু বলে মনে করার অবশ্য কারণ ছিল। ১০৬৬ সালে ধূমকেতুটি দেখা যাওয়ার পরই সে বছর ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হ্যারল্ড মারা যান। ফলে মানুষের মনে কুসংস্কার দানা বাঁধে।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০ অব্দে চীনা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন বস্তু সম্পর্কে লিখে গেছেন। এর আগে গ্রিসের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও একই জিনিস নিয়ে ৪৬৮ থেকে ৪৬৬ অব্দের মধ্যে লিখেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তবে এ তথ্য নিশ্চিত নয়। যাহোক, অ্যাডমন্ড হ্যালি অতীতে ২৪ বার এমন বস্তু দেখা যাওয়ার ইতিহাস মিলিয়ে দেখেন।
পৃথিবীর কক্ষপথে হ্যালির ফেলে যাওয়া বরফের টুকরোর কারণে এ দুটি উল্কাবৃষ্টি হয়। টুকরোগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে এলে জ্বলে ওঠে। বরফের পরিবর্তে আগুনের লেজ দেখা যায় এসব বরফখণ্ডে।
কাছাকাছি সময়ে, ১৫৩১ এবং ১৬০৭ সালে পৃথিবীর নানা স্থান থেকে আকাশে যে উজ্জ্বল বস্তু দেখা গিয়েছিল। তিনি ধারণা করেন, সেটাও ওই একই বস্তু। বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের সহায়তায় হ্যালি নিজের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সেসব তথ্য মিলিয়ে অনুমান করেন এসব ঘটনার কারণ হয়তো একই। অর্থাৎ এক বস্তুই নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে দেখা গিয়েছিল আকাশে।
এ থেকে হ্যালি গাণিতক হিসেব কষে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ১৭৫৮ সালে আবারও পৃথিবীর আকাশে একে দেখা যেতে পারে। এখন আমরা জানি, হ্যালির সেই ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে আবারও পৃথিবীর আকাশ থেকে দেখা গিয়েছিল ধুমকেতুটি। হ্যালি নিজে অবশ্য নিজের ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা দেখে যেতে পারেননি। ভদ্রলোক ১৭৪২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। পরে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে ধূমকেতুটির নাম দেন হ্যালির ধূমকেতু।
এরপর সময়ে সময়ে হ্যালির ধূমকেতু আবারও সূর্যের সবচেয়ে কাছের বিন্দুতে আসবে ২০৬১ সালের ২৮ জুলাই। তার আগেই চাইলে হ্যালির ‘লোমশ নক্ষত্র’ দেখতে পারবেন ইচ্ছে হলে। বছরে দুবার পৃথিবীতে বিশেষ ধরনের উল্কাবৃষ্টি হয়। একটির নাম ‘ডেল্টা অ্যাকুয়ারিড মিটিওর শাওয়ার’। এটা মে মাসে দেখা যায়। আর অক্টোবরে দেখা যায় ‘ওরিনয়েড মিটিওর শাওয়ার’। ঠিক ধরেছেন, মিটিওর শাওয়ার মানেই উল্কাবৃষ্টি। পৃথিবীর কক্ষপথে হ্যালির ফেলে যাওয়া বরফের টুকরোর কারণে এ দুটি উল্কাবৃষ্টি হয়। টুকরোগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে এলে জ্বলে ওঠে। বরফের পরিবর্তে আগুনের লেজ দেখা যায় এসব বরফখণ্ডে।