সম্প্রতি লাল গ্রহ মঙ্গলের রঙিন মানচিত্র প্রকাশ করেছে চীনের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা সিএনএসএ। তাদের পরিচালিত মঙ্গল অভিযান তিয়ানওয়েন-১-এর মাধ্যমে ছবি সংগ্রহ করে এ মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। সম্প্রতি এ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্স বুলেটিন জার্নালে।
এ গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে, মঙ্গলের নতুন এ মানচিত্রের প্রতি পিক্সেল ধারণ করছে মঙ্গলের প্রায় ৭৬ মিটার জায়গা। এর আগে প্রতি পিক্সেলে গ্রহটির ১ কিলোমিটার বা তার বেশি অঞ্চল দেখাতে পেরেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ১ পিক্সেলে ১ কিলোমিটার জায়গা দেখানোর বিষয়টাকে বলা হয়, ১ কিলোমিটার স্থানগত বা স্পেসিয়াল রেজ্যুলুশন। সেদিক থেকে এটা মঙ্গলের সবচেয়ে বেশি রেজ্যুলুশনের মানচিত্র।
২০২০ সালের ২৩ জুলাই শুরু হয় তিয়ানওয়েন-১ মিশন। এরপর ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মহাকাশযানটি পৌঁছায় মঙ্গলের কক্ষপথে। প্রায় তিন মাস কক্ষপথে অবস্থানের পর মঙ্গলের মাটিতে পৌঁছে যায় চীনের রোভার। যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পর মঙ্গলের বুকে তৃতীয় দেশ হিসেবে নাম লেখায় চীন। চায়না ন্যাশনাল স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (সিএনএসএ) প্লানেটরি এক্সপ্লোরেশন অব চায়না বা তিয়ানওয়েন প্রকল্পের প্রথম মিশন এটি। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য সৌরজগতের গ্রহগুলোতে রোবোটিক মিশন পরিচালনা করা।
সেসব ছবি ব্যবহার করে সিএনএসএর একদল গবেষক তৈরি করেছেন ওই মানচিত্র। গবেষকদলের নেতৃত্বে ছিলেন ন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরি চীনের (এনএওসি) অধ্যপক লি চুনলাই।
তিয়ানওয়েন-১ অভিযানের মূল মহাকাশযানে ছিল একটি অরবিটার বা কক্ষপথযান, দুটি ডিপ্লয়েবল ক্যামেরা, একটি রিমোট ক্যামেরা, একটি ল্যান্ডার ও ঝাউরং রোভার। এসবের পাশাপাশি ছিল ১৪টি অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। এ অভিযানের লক্ষ্য, মঙ্গলের ভূ-প্রকৃতি, অভ্যন্তরীণ কাঠামো, বায়ুমণ্ডলের বৈশিষ্ট্য ও পানি অনুসন্ধান করা।
প্রায় ১ হাজার ৩০০ দিন ধরে মঙ্গলে অনুসন্ধান চালাচ্ছে তিয়ানওয়েন-১। এ সময় লাল গ্রহটির কক্ষপথে অবস্থান করে মঙ্গলের প্রায় ১৪ হাজার ৭৫৭টি ছবি তুলেছে মহাকাশযানটি। সেসব ছবি ব্যবহার করে সিএনএসএর একদল গবেষক তৈরি করেছেন ওই মানচিত্র। গবেষকদলের নেতৃত্বে ছিলেন ন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরি চীনের (এনএওসি) অধ্যপক লি চুনলাই। সহকর্মী হিসেবে ছিলেন চীনের একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী ও গবেষক।
তিয়ানওয়েন-১ এর মডারেট রেজ্যুলুশন ক্যামেরা বা মোরিক ব্যবহার করে তোলা ওই ছবিগুলোর স্থানগত রেজ্যুলুশন ছিল ৫৭ থেকে ১৯৭ মিটারের মধ্যে। এর পাশাপাশি মার্স মিনারেলজিক্যাল স্পেকট্রোমিটার ব্যবহার করে দৃশ্যমান ও অবলাল আলোয় সম্পূর্ণ মঙ্গলের মোট ৩২৫ স্ট্রিপ ডাটা বা সরু-লম্বা ছবি ধারণ করা হয়। ২৬৫ থেকে ৮০০ মিটারে মধ্যে ছিল এসব ছবির স্থানগত রেজ্যুলুশন। এসব ছবি ও তথ্য ব্যবহার করে অধ্যাপক লি চুনলাই ও তাঁর সহকর্মীরা মঙ্গলের মানচিত্রটি তৈরি করেন। মানচিত্রের মান উন্নত করতে তাঁরা বান্ডেল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে থ্রিডি মডেল ও ক্যামেরা সেটিংস আরও নিখুঁত করা যায়। দ্বিমাত্রিক ছবিতে বস্তুর অবস্থান আর থ্রিডি মডেলে বস্তুর অবস্থানের মধ্যকার ত্রুটি দূর করতে এ প্রযুক্তি বেশ কার্যকর। নিখুঁত মানচিত্র, ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির পরিবেশ, বিশেষ করে রোবটের চলাচলের মতো পরিবেশ তৈরি করতে এসব ত্রুটি দূর করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মানবজাতির মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। ভবিষ্যতে মঙ্গলে মানুষের অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন এ মানচিত্র দারুণভাবে কাজে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মঙ্গলের এ মানচিত্রে কোনো অবস্থানের ত্রুটি ১ পিক্সেলেরও কম। মার্স মিনারেলোজিক্যাল স্পেকট্রোমিটারের তথ্য ব্যবহার করে মানচিত্রে মঙ্গলের রং ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে তাই বর্তমানে এটি মঙ্গলের সবচেয়ে নিখুঁত ও বড় মানচিত্র।
মানবজাতির মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। ভবিষ্যতে মঙ্গলে মানুষের অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন এ মানচিত্র দারুণভাবে কাজে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আগামী দুই দশকের মধ্যে মঙ্গলে মানবমিশন পরিচালনার পরিকল্পনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।