তুমি কোন গগনের তারা

কোটি কোটি গ্যালাক্সি নিয়ে আমাদের এই মহাবিশ্ব। প্রতিটি গ্যালাক্সিতে আছে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি) নক্ষত্র। একটি নক্ষত্রের মধ্যে ১০ লাখ পৃথিবী সহজেই ঢুকে পড়তে পারে। আলোর বেগে চললে চাঁদে এক সেকেন্ডে পৌঁছানো যায়, সূর্যে যেতে লাগে ৮ মিনিট, ছয় ঘণ্টায় সৌরজগত পেরিয়ে যাবেন। সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টাউরিতে পৌঁছাতে লাগবে প্রায় চার বছর। আমাদের গ্যালাক্সি ছায়াপথের এপার থেকে ওপারে যেতে আলোর লাগে ১ লাখ ২০ হাজার বছর। প্রতিবেশী গ্যালাক্সি এন্ড্রোমেডাকে খালি চোখে অস্পষ্ট তারার মতো দেখায়। সেখানে পৌঁছাতে আলোর লাগবে ২৫ লাখ বছর! প্রতিবেশী সুপার ক্লাস্টার ভার্গো ৫ কোটি ৬০ লাখ আলোক বছর দূরে। ওখানে আছে দেড় হাজার গ্যালাক্সির এক জমায়েত। এত সব খবর জানা গেল কী করে?

দূরত্ব মাপার কৌশলটা জানা যাক। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। বেশ খানিকটা দূরে দীঘির পাড়ে একটি তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে। বহুদূরে গগনপ্রান্তে দেখা যাচ্ছে এক পাহাড়। পাহাড়টি কত উঁচু? পাহাড়টির দূরত্ব কত? পাহাড়ে না উঠে কি ওর উচ্চতা মাপা যায়? পাহাড়ের কাছে না গিয়ে দূর থেকে কি ওর দূরত্ব মাপা যায়? হ্যাঁ, যায়। এর জন্য প্রয়োজন সামান্য একটু ত্রিকোণমিতির কৌশল। তিন হাজার বছর আগে ব্যাবিলন এবং মিসরে এ কৌশল জানা ছিল। গ্রিক বিজ্ঞানী অ্যারিস্টারকাস (খ্রিস্টপূর্ব ৩১০-২৩০) এবং টলেমি (১০০-১৬৮ খ্রি.) আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান এবং গতিপথ নির্দেশনায় ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করেছিলেন। সূর্যাস্তের সময়ে এক হাত সূর্যের দিকে প্রসারিত করুন, আরেক হাত সন্ধ্যাতারার (শুক্র গ্রহ) দিকে। আপনার দুটি সম্প্রসারিত হাতের মাঝের কোণ হলো সূর্য এবং শুক্র গ্রহের মাঝের কৌণিক দূরত্ব। গ্রিক বিজ্ঞানীরা জানতেন যে সূর্য থেকে শুক্র গ্রহের এই কৌণিক দূরত্ব কখনোই ৪৭ ডিগ্রির বেশি হয় না।

তাঁদের পৃথিবীকেন্দ্রিক সৌরজগতের নকশা থেকে এই সর্বোচ্চ কৌণিক দূরত্ব (Maximum elongation) বোঝা প্রায় অসম্ভব ছিল। এর ব্যাখ্যা দিতে বেচারা টলেমি কতই না ঝামেলায় পড়েছিলেন!

আবার সেই তালগাছ এবং পাহাড়ের কাছে আসা যাক। এমন জায়গায় দাঁড়ান যেন আপনি, তালগাছ এবং পাহাড়টা একই সরলরেখায় থাকে। এখন বাঁ হাত যদি তালগাছের দিকে বাড়ান এবং ডান হাত পাহাড়ের দিকে, তবে দুই হাতের মাঝের কৌণিক দূরত্ব শূন্য হবে। এবার রাস্তা ধরে কয়েক গজ হাঁটুন। তারপরে আবার এক হাত তালগাছের দিকে এবং আরেক হাত পাহাড়ের দিকে বাড়ালে আপনার দুই হাতের মাঝে একটি কৌণিক দূরত্ব পাওয়া যাবে। এই কৌণিক দূরত্ব আপনি যতখানি হেঁটেছেন সেই দূরত্ব এবং তালগাছ ও পাহাড়ের দূরত্বের ওপরে নির্ভর করবে।

আরও একটা পরীক্ষা করা যাক। আপনার হাত সামনে বাড়িয়ে দিন। হাতের মুঠোয় একটি পেনসিল ধরে রাখুন। পেনসিলের এক মাথা যেন ওপরের দিকে বাড়ানো থাকে। পেনসিল না পেলে হাতের একটি আঙুল উঁচিয়ে ধরলেও চলবে। ডান চোখ বন্ধ করে বাঁ চোখ দিয়ে পেনসিলের দিকে তাকান। চোখ, পেনসিল ও দূরের কোনো জিনিস, যেমন দরজার কোনা, জানালার শিক বা সোফার কিনারা একই সরলরেখায় নিয়ে আসুন। এবারে বাঁ চোখটি বন্ধ করে ডান চোখটি খুলুন। এই চোখ টেপাটিপির খেলাটা কয়েকবার খেলুন। কী দেখছেন? এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে পেনসিলটি যেন লাফ দিয়ে সরে যাচ্ছে! এই মিথ্যে লাফালাফির নাম লম্বন বা প্যারালাক্স (Parallax)।

পৃথিবী সূর্যের চারদিকে বছরে একবার ঘোরে। আজ পৃথিবী কক্ষপথের যে স্থানে আছে, ছয় মাস পরে থাকবে তার অন্য প্রান্তে। আর এই দুই স্থানের দূরত্ব হবে পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাসের সমান। এই চলন্ত পৃথিবীটা যদি আমি হই, সূর্য বা কাছের কোনো নক্ষত্রকে যদি তালগাছের সঙ্গে তুলনা করি এবং দূরের কোনো নক্ষত্রকে পাহাড়ের সঙ্গে, তবে কৌণিক দূরত্বের পরিবর্তন মেপে তারাদের দূরত্ব মাপা যায়। পৃথিবীর পথচলার সঙ্গে সঙ্গে দূর আকাশের তারাদের অবস্থানের পরিবর্তনকে নাক্ষত্রিক লম্বন (Stellar Parallax) বলে। গ্রিক বিজ্ঞানীরা বোকা ছিলেন না! অনেক চেষ্টা করেও তাঁরা এই নাক্ষত্রিক লম্বন মাপতে পারেননি। তাই ধরে নিয়েছিলেন যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে না। যুক্তিটা ঠিক ছিল, মাপটি ছিল ভুল! তারারা এত দূরে থাকে যে নক্ষত্র লম্বন কোণ বেজায় ছোট।

সেকালের যন্ত্রপাতি দিয়ে এত ছোট কৌণিক দূরত্ব মাপা সম্ভব ছিল না। প্রক্সিমা সেন্টাউরির নাক্ষত্রিক লম্বন কোণের পরিমাণ ০.৭৬৮১৩ সেকেন্ড, ওর দূরত্ব হবে ৪.২৪ আলোক বছর। দূরের তারাদের জন্য এই কোণ এতই নগণ্য, যা তা খুব ভালো দুরবিন দিয়েও মাপা সম্ভব নয়। নাক্ষত্রিক লম্বন পদ্ধতিতে ৫০০ আলোক বছরের ভেতরে যে তারাগুলো আছে, তাদের দূরত্বই শুধু মাপা যায়।

একটি ১০০ ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতির কথা ধরা যাক। ১ ফুট দূর থেকে তাকে যত উজ্জ্বল দেখাবে, ১০ ফুট দূর থেকে তাকে তার চেয়ে ১০০ গুণ কম উজ্জ্বল দেখাবে। দূরত্বের বর্গের অনুপাতে জ্বলন্ত বস্তুর উজ্জ্বলতা দেখতে কম লাগে। তাই আসল উজ্জ্বলতা এবং দৃশ্যমান উজ্জ্বলতার প্রভেদ জানা গেলে যেকোনো তারার দূরত্ব মাপা যায়। একটি তারার দৃশ্যমান উজ্জ্বলতা মাপা কঠিন নয়। কিন্তু তারাটির আসল উজ্জ্বলতা জানা যাবে কী করে?

তারার আসল উজ্জ্বলতা নির্ভর করে ওর বাইরের আবরণের তাপমাত্রা ও আয়তনের ওপরে। তারার রং ও বর্ণালি থেকে তারার তাপমাত্রা বের করা যায়। কিন্তু একটি তারার ব্যাস বা আয়তন সরাসরি বের করা সহজ নয়। তারাদের আসল উজ্জ্বলতা মেপে এবং তার সঙ্গে দৃশ্যমান উজ্জ্বলতার তুলনা করে ওদের দূরত্ব বের করার অনেক উপায় আছে। এখানে বহুল ব্যবহূত একটি কৌশলের কথা লিখছি।

এক ধরনের নক্ষত্র আছে, যাদের উজ্জ্বলতা সময়ের সঙ্গে বাড়ে-কমে। দুই-তিন মাসের মধ্যে এই বাড়া-কমা কয়েকবার ঘটতে পারে। এই তারাগুলোর নাম সিফিয়েড ভ্যারিয়েবল (Cepheids Variable) নক্ষত্র। এই তারাগুলো ক্রমাগত সম্প্রসারিত ও সংকুচিত হয়। যেহেতু একটি তারা কী পরিমাণ আলো ছড়াবে তা তার আয়তনের ওপর নির্ভর করে, তাই এই তারাগুলোর উজ্জ্বলতা ক্রমাগত বাড়ে-কমে। এই বাড়া-কমার হার যতই বেশি, তারাটির উজ্জ্বলতা ততই বেশি। তারার উজ্জ্বলতার পরিবর্তন সহজেই মাপা যায়। এই পরিবর্তনের কম্পাঙ্ক মেপে সিফিয়েড নক্ষত্রের আসল উজ্জ্বলতার খবর মেলে। আর দৃশ্যমান উজ্জ্বলতা মাপা তো একেবারেই সহজ কাজ। এই দুই উজ্জ্বলতা জানার পরে একটু অঙ্ক কষে তারাটির দূরত্ব মাপা যায়। সিফিয়েড নক্ষত্র বিপুল পরিমাণে আলো ছড়ায়। বহুদূর থেকে ওদের দেখা যায়। দূর আকাশের কোনো গ্যালাক্সির দূরত্ব জানতে চাইলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রথমেই এমন তারার খোঁজ করেন। ৫ থেকে ১০ কোটি আলোক বছরের দূরত্ব মাপার জন্য এরা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের প্রধান সহায়।

লেখক: ইমিরেটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৮ সালের বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত