দুটি নিউট্রন স্টার মিলে জন্ম দিল সুপারকিলোনোভা

বাঁ পাশে দেখা যাচ্ছে একটি বিশাল নক্ষত্রের সুপারনোভা বিস্ফোরণ। মাঝের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে সেই বিস্ফোরণের পর জন্ম নেওয়া দুটি নিউট্রন স্টার। ধারণা করা হচ্ছে, এদের অন্তত একটির ভর আমাদের সূর্যের চেয়েও কম। আর ডান পাশের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে তাদের চূড়ান্ত সংঘর্ষ বা কিলোনোভাছবি: ক্যালটেক/ কে. মিলার ও আর. হার্ট

বিশাল কোনো নক্ষত্র যখন মারা যায়, তখন এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়। এই বিস্ফোরণকে আমরা বলি সুপারনোভা। আবার দুটো মৃত নক্ষত্র বা নিউট্রন স্টার যখন একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, তখন তৈরি হয় কিলোনোভা। এই কিলোনোভাই হলো মহাকাশের স্বর্ণ আর ইউরেনিয়ামের কারখানা।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা এবার এমন এক ঘটনার সাক্ষী হলেন, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। বিজ্ঞানীরা এবার জোড়া বিস্ফোরণ দেখেছেন! তাঁরা ধারণা করছেন, এটিই ইতিহাসের প্রথম সুপারকিলোনোভা।

মূল ঘটনাটা ২০২৫ সালের ১৮ আগস্টের। পৃথিবী থেকে প্রায় ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে মহাকাশের এক কোণায় অদ্ভুত এক সংকেত ধরা পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের লাইগো এবং ইউরোপের ভার্গো ডিটেক্টরে মহাকর্ষ তরঙ্গ বা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ধরা পড়ার পর বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসেন।

প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো কাউন্টির পালোমার পর্বতমালায় অবস্থিত পালোমার অবজারভেটরির বিজ্ঞানীরা দেখলেন, সেখান থেকে লাল রঙের আলো বেরিয়ে আসছে। সেগুলো আবার ম্লান হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ঠিক ২০১৭ সালে আবিষ্কৃত প্রথম কিলোনোভা GW170817-এর মতো। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, আরেকটা কিলোনোভার সন্ধান পেয়েছেন। 

কিন্তু টুইস্টটা এল তিন দিন পর। হঠাৎ করেই সেই ম্লান হয়ে যাওয়া লাল আলো আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল! তবে এবার আর লাল নয়, নীল রঙের আলো। আর নীল আলো মানেই সেখানে হাইড্রোজেনের উপস্থিতি আছে। অর্থাৎ, সুপারনোভার লক্ষণ।

একই ঘটনায় প্রথমে কিলোনোভা (লাল) আর পরে সুপারনোভার (নীল) এমন জগাখিচুড়ি অবস্থা দেখে অনেক বিজ্ঞানী আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। তাঁরা ভাবলেন, এটা সাধারণ কোনো সুপারনোভাই হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক মানসী কাসলিওয়াল এবং তাঁর দল হাল ছাড়লেন না।

‘সূর্যের চেয়ে কম ভরের এই নিউট্রন স্টারগুলো তৈরির একমাত্র উপায় হলো দ্রুত ঘূর্ণায়মান কোনো তারার মৃত্যু।'
ব্রায়ান মেটজগার, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

মানসী কাসলিওয়াল সন্দেহ করলেন, এখানে কিছু একটা আছে! ডেটা বিশ্লেষণ করে তারা দেখলেন, সেখানে যে নিউট্রন স্টারগুলো ধাক্কা খেয়েছে, তাদের অন্তত একটির ভর সূর্যের ভরের চেয়েও কম!

সাধারণত একটি নিউট্রন স্টারের ভর সূর্যের ভরের ১.২ থেকে ৩ গুণ পর্যন্ত হয়। সূর্যের চেয়ে কম ভরের নিউট্রন স্টার তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হলেও বাস্তবে এর দেখা মেলা ভার। 

তাহলে সূর্যের চেয়ে হালকা এই অদ্ভুত নিউট্রন স্টার এল কোথা থেকে? আর একই সঙ্গে দুই রঙের আলো কেন? এর উত্তরে বিজ্ঞানীরা সুপারকিলোনোভার থিওরি দাঁড় করিয়েছেন। তাঁদের মতে ঘটনাটি অনেকটা এরকম; একটি বিশাল নক্ষত্র খুব দ্রুত ঘুরছিল। মৃত্যুর আগে এটি ভেঙে দুটি ছোট নিউট্রন স্টারে পরিণত হয়। ছোট মানে সূর্যের চেয়ে হালকা। এই দুটি নিউট্রন স্টার একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে প্রথমে একটি কিলোনোভা তৈরি করে। সেই কিলোনোভা থেকে লাল আলো ও ভারী ধাতু তৈরি হয়। এরপর পুরো নক্ষত্রটির বাইরের খোলস বিস্ফোরিত হয়ে তৈরি করে সুপারনোভা। সেজন্যই নীল আলো দেখা যায়। অবশ্য একই সময় লাল আলও বেরিয়েছে, কিন্তু তা নীল আলোর কারণে ঢাকা পড়ে যায়। 

যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রায়ান মেটজগার বলছেন, ‘সূর্যের চেয়ে কম ভরের এই নিউট্রন স্টারগুলো তৈরির একমাত্র উপায় হলো দ্রুত ঘূর্ণায়মান কোনো তারার মৃত্যু। যদি এই থিওরি সত্যি হয়, তবে আমরা মহাকাশে স্বর্ণ, প্লাটিনাম বা ইউরেনিয়ামের মতো ভারী মৌলগুলো কীভাবে তৈরি হয়, তার এক নতুন কারখানার সন্ধান পাবো।’

মহাবিশ্বের অধিকাংশ ভারী মৌল, যেমন সোনা, প্লাটিনাম এবং আয়োডিন তৈরি হয় আর-প্রসেস নামে প্রক্রিয়ায়। এই প্রক্রিয়া সাধারণত কিলোনোভা বিস্ফোরণের সময় ঘটে। সুপারকিলোনোভা এই প্রক্রিয়ারই এক বিশাল সংস্করণ হতে পারে। 

তবে শেষ করার আগে মনে করিয়ে দিতে চাই, এটি এখনো একটি থিওরি বা তত্ত্ব। তবে এটি যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তবে মহাকাশ বিজ্ঞানের বইয়ে নতুন এক অধ্যায় যুক্ত হবে। মানসী কাসলিওয়াল ঠিকই বলেছেন, তাঁরা হয়তো সত্যিই ইতিহাসের সাক্ষী হতে চলেছেন।

লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়, শশিকর, মাদারীপুর

সূত্র: পপুলার সায়েন্স, নাসা, স্পেস ডটকম ও লাইভ সায়েন্স