মহাকাশ
নবম গ্রহে পৌঁছাতে কত দিন লাগবে
অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, কয়েক বছরের মধ্যে সৌরজগতের নবম গ্রহ আবিষ্কৃত হতে পারে। তাই যদি হয়, তাহলে অধরা সেই গ্রহে পৃথিবী থেকে নভোযান পাঠাতে কত বছর সময় লাগবে?
সৌরজগতে গ্রহ কয়টি? আগ্রহীরা হয়তো মাথা চুলকে বলবেন, ৮টিই তো জানি। তাহলে নবম গ্রহের কথা আসছে কোত্থেকে? আর সেই গ্রহ না থাকলে সেখানে যাওয়ার কথাই-বা আসছে কেন?
হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে এখনো নবম গ্রহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহলে কেন নবম গ্রহ নিয়ে আলোচনা করছি? কারণ, কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, সৌরজগতের শেষ প্রান্তে লুকিয়ে আছে অধরা সেই নবম গ্রহ। আর সেই গ্রহটি খুঁজে পাওয়া থেকে আমরা মাত্র কয়েক বছর পিছিয়ে আছি। অবশ্য এ সবই তাত্ত্বিক কথাবার্তা। নবম গ্রহ এখনো বিজ্ঞানীদের খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ। প্রথমে সেটা খুঁজে পেতে হবে, তারপর শুরু হবে সেই গ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রা।
সেখানে পৌঁছাতে কত দিন লাগবে, তা জানার আগে একটু জেনে নিই, এই নবম গ্রহটা আসলে কী। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রহটি যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে সেটির অবস্থান হবে নেপচুন থেকেও দূরে। সে হিসেবে সৌরজগতের সর্বশেষ গ্রহ হবে সেটা। বর্তমানে সৌরজগতে স্বীকৃত গ্রহ ৮টি। সবচেয়ে দূরে রয়েছে নেপচুন। নবম গ্রহটি হবে তার চেয়েও দূরে। হিসাব অনুযায়ী ওই গ্রহটিও হবে ইউরেনাস বা নেপচুনের মতো গ্যাস বা বরফের তৈরি। পৃথিবী থেকে সেটি হবে কমপক্ষে ৫-১০ গুণ ভারী।
কিন্তু হঠাৎ বিজ্ঞানীদের কেন মনে হলো সৌরজগতে আরেকটি গ্রহ লুকিয়ে আছে? এটা কি শুধুই বিজ্ঞানীদের কল্পনা, নাকি বাস্তবতা রয়েছে কিছু? আসলে বিজ্ঞানীরা শুধু শুধু কিছু অনুমান করেন না। তাঁদের অনুমানের পেছনেও থাকে যুক্তি। নবম গ্রহটির ব্যাপারটাও সেরকম। নেপচুনের কক্ষপথের বাইরে বিজ্ঞানীরা প্রায় এক ডজন বস্তুকে এমনভাবে নড়াচড়া করতে দেখেছেন যেন সেগুলো কোনো বড় বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আর যদি সত্যিই নির্দিষ্ট কোনো বস্তুকে কেন্দ্র করে অন্য কোনো কিছু বস্তু ঘোরে, তাহলে সেই নির্দিষ্ট বস্তুটা গ্রহ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যেমন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে চাঁদ। তবে সেটা বামন গ্রহও হতে পারে।
নাসা যদি নবম গ্রহে মহাকাশযান পাঠাতে চায়, তাহলে এ ব্যাপারে তাদের প্রথমে পরিকল্পনা করতে হবে। তারপর মার্কিন সরকার থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
তাহলে কবে মানবজাতি নিশ্চিত হতে পারবে আসলেই সৌরজগতে নবম গ্রহ নামে কিছু আছে কি না? খুব সম্ভবত ২০২৫ সালের শেষদিকেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, ২০২৫ সালের শেষদিকে অত্যাধুনিক ভেরা সি রুবিন অবজারভেটরি রাতের আকাশ জরিপ করা শুরু করবে। আর সেই জরিপ থেকেই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্ল্যানেট নাইন।
এখন সত্যিই যদি প্ল্যানেট নাইন বা নবম গ্রহ ধরা দেয়, তাহলে নিশ্চয়ই সেখানে নভোযান পাঠাতে চাইবে অনেক দেশ। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, তাদের পরিচালিত দুটি নভোযান ভয়েজার ১ ও ২ এর আগে এর চেয়েও বেশি দূরত্ব পাড়ি দিয়ে সৌরজগৎ ছাড়িয়ে গেছে। তবে অন্য কোনো দেশও যুক্তরাষ্ট্রের আগে সেখানে নভোযান পাঠাতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু এখন পর্যন্ত মহাকাশ গবেষণায় সবচেয়ে বেশি সফল, তাই উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তথা নাসার নামই ব্যবহার করা যাক।
নাসা যদি নবম গ্রহে মহাকাশযান পাঠাতে চায়, তাহলে এ ব্যাপারে তাদের প্রথমে পরিকল্পনা করতে হবে। তারপর মার্কিন সরকার থেকে অনুমোদন নিতে হবে। একই কথা যে কোনো দেশের জন্যই প্রযোজ্য। এতে অনেক দিন সময় লাগে। কারণ, এগুলো অনেক ব্যয়বহুল ব্যাপার। এ নিয়ে লুক্সেমবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেস সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার আন্দ্রেয়াস হেইন বলেন, ‘পরিকল্পনা শেষে কোনো দেশের সরকার থেকে অনুমোদন নিতে প্রায় এক দশক বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগবে। কারণ, মিশনটি হবে দীর্ঘ।’
ভাবতে পারেন, কেন এত বছর সময় লাগবে? কারণ অ্যাডাম ধরে নিয়েছেন, নবম গ্রহটি সূর্য থেকে প্রায় ৪০০ সৌরজাগতিক একক দূরে।
এসব জটিল বিষয় বাদ দিয়ে আমরা বরং ধরে নিই, পরিকল্পনা শেষে কোনো দেশ সরকার থেকে অনুমোদন পেয়ে গেছে। এখন শুধু নবম গ্রহের যাওয়ার পালা। তাহলে কত দিন লাগবে পৌঁছাতে? ২০২২ সালে অ্যাডাম হিবার্ড নামে এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রি-প্রিন্ট ডেটাবেস আরজিভে (arXiv) এ নিয়ে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। যদিও তা পিয়ার রিভিউ করা হয়নি। সেখানে তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন, নাসার ভয়েজার প্রোবের মতো একটা মহাকাশযান প্ল্যানেট নাইনে পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ৪৫-৭৫ বছর।
ভাবতে পারেন, কেন এত বছর সময় লাগবে? কারণ অ্যাডাম ধরে নিয়েছেন, নবম গ্রহটি সূর্য থেকে প্রায় ৪০০ সৌরজাগতিক একক দূরে। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বকে বলা হয় এক সৌরজাগতিক একক বা অ্যাস্ট্রোনমিকেল ইউনিট। অর্থাৎ নবম গ্রহটি হবে পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্ব থেকে প্রায় ৪০০ গুণ দূরে। এখানে জানিয়ে রাখি, সৌরজগতের সবচেয়ে দূরের গ্রহ নেপচুন রয়েছে সূর্য থেকে ১৯ সৌরজাগতিক একক দূরে। মানে সূর্য থেকে নেপচুনের যে দূরত্ব, নবম গ্রহটি হবে তারচেয়েও ১৩ গুণ দূরে।
পরে অবশ্য আরেকটা গবেষণায় দেখা গেছে, প্ল্যানেট নাইনের গড় দূরত্ব হতে পারে ৫০০ বা ৫৫০ মহাজাগতিক একক। টানা ৭৫ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরে একটা নভোযান নির্দিষ্ট লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছাবে, এটা অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। কারণ, পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে থাকা ভয়েজার ১ প্রোবটি চলছে প্রায় ৪৬ বছর ধরে। এত দিনে তা পৌঁছেছে মাত্র ১৬৩ মহাজাগতিক একক দূরত্বে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, প্ল্যানেট নাইন খুঁজে পেলে সেখানে মানবজাতির কোনো প্রোব পৌঁছাতে ভয়েজারের চেয়েও ৩ গুণ বেশি সময় লাগবে।
আরেকটি সম্ভাবনার কথা বলা যায়। আমরা যদি হালকা পালযুক্ত উন্নত প্রপালশন প্রযুক্তি বানাতে পারি, যা সূর্যের আলো তথা ফোটনের ধাক্কায় চলবে
তবে ভবিষ্যতে যদি আমাদের প্রযুক্তি আরও উন্নত হয়, তাহলে এ সময় হয়তো আরও কমবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ক্যালটেক) জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইক ব্রাউন ২০১৬ সালে বলেছিলেন, সম্ভবত ২০ বছরের মধ্যে আমরা প্ল্যানেট নাইনে পৌঁছাতে পারব। তাঁর যুক্তি ছিল, ভয়েজার ১ ঠিক সোজা পথে সৌরজগতের বাইরে যায়নি। যাওয়ার সময় শনি, বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনের পাশাপাশি এদের উপগ্রহগুলো পর্যবেক্ষণ করেছে। ফলে গতি কমিয়ে চলতে হয়েছে ভয়েজার ১-কে। কিন্তু প্ল্যানেট নাইনে পৌঁছাতে সে ঝামেলা নেই। সোজা পথে নির্দিষ্ট নভোযানটি চলে যাবে গন্তব্যে। আর এর মধ্যে প্রযুক্তি যদি আরও উন্নত হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
আরেকটি সম্ভাবনার কথা বলা যায়। আমরা যদি হালকা পালযুক্ত উন্নত প্রপালশন প্রযুক্তি বানাতে পারি, যা সূর্যের আলো তথা ফোটনের ধাক্কায় চলবে—অর্থাৎ গ্যাসের বদলে ফোটন নির্গমণ করে ছুটতে পারবে, তাহলে হয়তো আরও দ্রুত পৌঁছানো যাবে নবম গ্রহে।
তবে এ সবই সম্ভব হবে যদি নবম গ্রহটি খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রহটিই যদি না পাওয়া যায়, তাহলে আর এতসব জটিল চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। গ্রহটি খুঁজে পাওয়া গেল কি না, তা হয়তো আমাদের জীবদ্দশায়ই দেখে যেতে পারব। কিংবা হয়তো নিশ্চিতভাবে জানতে পারব, আসলে এমন কোনো গ্রহ আছে কি নেই। কিন্তু সেই গ্রহ যদি সত্যিই থাকে, সেখানে কোনো প্রোব পৌঁছেছে কি না, তা কি আমরা দেখে যেতে পারব? কে জানে!