ইউরেনাসের গন্ধ

ইউরেনাস। সূর্য থেকে সপ্তম গ্রহ। সৌরজগতের প্রথম চারটি গ্রহই শুধু পাথুরে গঠনের। মঙ্গলের পরের গ্রহগুলোর পরিচয় গ্যাসীয় দানব। ইউরেনাস ও নেপচুনের বাড়তি পরিচয় আইস জায়ান্ট বা বরফদানব। পৃথিবী বা মঙ্গলদের মতো এই চার গ্রহের কোনো কঠিন পৃষ্ঠ নেই। ফলে এসব গ্রহের ক্ষেত্রে বায়ুমণ্ডলের কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞাও নেই। সাধারণত মহাকাশযান বা টেলিস্কোপের চোখে ইউরেনাসের সবচেয়ে বাইরের দিকের যে স্তরটি দূর থেকে দেখা যায়, তাকেই বায়ুমণ্ডল বলা হয়।

২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো গ্রহটির বায়ুমণ্ডলীয় মেঘে পাওয়া গেছে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসের চিহ্ন। এই গ্যাস আবার পাওয়া যায় পচা ডিমেও। তার মানে, ইউরেনাসের গন্ধও হবে পচা ডিমের মতো।

তবে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে যে মিথেন আছে, সেটা অনেক আগেই জানা গিয়েছিল। এবং মূলত এই গ্যাসের কারণেই ইউরেনাস গ্রহ দেখতে নীল। কিন্তু শুধু মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি জেনে গ্রহটির গন্ধ জেনে ফেলে যায় না। মিথেন যে গন্ধহীন গ্যাস! এ ছাড়াও ভয়েজার-২ অভিযানের মাধ্যমে জানা গিয়েছিল হাইড্রোজেন ও নিষ্ক্রিয় গ্যাস হিলিয়াম থাকার কথাও। কিন্তু এ দুটি গ্যাসও গন্ধহীন।

এর বাইরে পানি, অ্যামোনিয়া বা হাইড্রোজেন সালফাইড আছে কি না, তা জানা কঠিন কাজ। প্রথমত, গ্রহটি এত দূরে যে টেলিস্কোপেও এটি বেশ ছোট। আরেকটি অসুবিধা হলো, গ্রহটির যে অংশ আমরা দেখতে পাই, এই উপাদানগুলো আছে তার নিচের স্তরে। তাই বলে তো আর বিজ্ঞান থেমে থাকবে না। ইউরেনাসের ভেতরে উঁকি দেওয়ার একটি উপায় বের করে ফেলেছেন একদল আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ। ব্যবহার করেছেন শক্তিশালী জেমিনাই টেলিস্কোপ।

গবেষক দলের প্রধান ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহপদার্থবিদ প্যাট্রিক এরউইন। গ্রহটিতে অনুসন্ধান চালানোর জন্য তাঁর দল ব্যবহার করে ৮ মিটার টেলিস্কোপের নিয়ার-ইনফ্রারেড ইন্টিগ্র্যাল ফিল্ড স্পেকট্রোমিটার। এর মাধ্যমে এ-যাবত্কালের ইউরেনাসের সবচেয়ে বিস্তারিত বর্ণালি বিশ্লেষণ চালানো হয়েছে। তাঁরা মেঘের স্তরের ঠিক ওপরের এলাকার প্রতিফলিত সূর্যরশ্মির নমুনা দেখেন। আর তাতেই পাওয়া গেছে হাইড্রোজেন সালফাইডের চিহ্ন।

এই আবিষ্কারের মাধ্যমে জ্যোতির্বিদ্যার দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার সমাধান হয়েছে। আগে জানা ছিল না, গ্রহটির মেঘে হাইড্রোজেন সালফাইড বেশি নাকি অ্যামোনিয়া। শনি ও বৃহস্পতিও গ্যাসীয় দানব। কিন্তু ওই গ্রহগুলোতে প্রচুর পরিমাণ অ্যামোনিয়া থাকলেও নেই কোনো হাইড্রোজেন সালফাইড।

এদিকে ইউরেনাসের পরবর্তী ও শেষ গ্রহ নেপচুন। ইউরেনাসের সঙ্গে এর গঠনের মিল আছে। ফলে এই ফল থেকে নেপচুনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও কিছু ধারণা পাওয়া যায়।

শুধু তা-ই নয়, এর মাধ্যমে খোদ সৌরজগতের গঠন সম্পর্কেও ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। সৌরজগতের জন্মের সময় গ্রহের নাইট্রোজেন ও সালফারের অনুপাত নির্ভর করেছিল ওই গ্রহের অবস্থান ও তাপমাত্রার ওপর। আর নাইট্রোজেন ও সালফারই যথাক্রমে অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইডেরই উপাদান মৌল।

তার মানে, শনি ও বৃহস্পতির জন্ম সম্ভবত ইউরেনাস ও নেপচুন থেকে আলাদা উপায়ে হয়েছে। আর গ্যাসদানবদের সবাই চার পাথুরে গ্রহ বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গল থেকে আলাদাভাবে জন্ম নিয়েছে। এ বিষয়গুলো আরও বিস্তারিত জানতে ভবিষ্যতে ব্যবহার করা হবে ভূ ও মহাকাশভিত্তিক টেলিস্কোপ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জায়ান্ট ম্যাজেলান ও জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। তবে আরও নিখুঁত করে জানতে হলে ইউরেনাসে যান না পাঠিয়ে উপায় নেই। কিন্তু সেটা করতে আরও অন্তত কয়েক বছর সময় লাগবেই।

আপাতত মনুষ্যবাহী কোনো যান পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। এই মুহূর্তে লক্ষ্য হলো মঙ্গল। ইউরেনাসের অবস্থান তার চেয়েও পাঁচ গুণ দূরে। তবু কখনো যাওয়া সম্ভব হলেও ইউরেনাসের গন্ধ অনুভব করার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ইউরেনাসের ভয়ানক পরিবেশ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে কোনো ধরনের ত্রুটি করবে না। এক দিকে দম বন্ধ হওয়া গ্যাস, অন্য দিকে হিমাঙ্কের নিচে ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা।

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট ডট কম

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত