রাতের আকাশ কালো কেন

ডাচ চিত্রকর ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ-এর বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য স্টারি নাইট’-এ রাতের আকাশ বেশ উজ্জ্বল দেখালেও বাস্তব ঠিক তার উল্টো। রাতের আকাশ প্রকৃতপক্ষে কালো। কিন্তু রাতের আকাশে জ্বলছে কোটি কোটি নক্ষত্র। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথে আছে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নক্ষত্র। আর গোটা মহাবিশ্বে গ্যালাক্সি আছে আনুমানিক ১২৫ বিলিয়ন। এত এত নক্ষত্র জ্বলছে, তবু কেন রাতের আকাশ আলো ঝলমলে নয়?

প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে জন্ম হয়েছিল মহাবিশ্বের। বিস্ফোরণের পর ফুলেফেঁপে ওঠে মহাবিশ্ব। ঠিক বেলুনে হাওয়া ঢুকিয়ে ফোলানো হলে যেভাবে ফুলে ওঠে। মহাবিশ্বের এই ফুলে ওঠা, অর্থাৎ সম্প্রসারিত হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে আজও। ফলে মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলো তাদের সব নক্ষত্র নিয়ে বিপুল বেগে পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে গ্যালাক্সিগুলো আমাদের পৃথিবী থেকেও সরে যাচ্ছে দূরে। গ্যালাক্সি তথা নক্ষত্রপুঞ্জের এই দূরে সরে যাওয়ার কারণেই রাতের আকাশ অন্ধকার দেখায় বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। পদার্থবিদ্যার যে সূত্রটি দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা হয়, তার নাম ডপলার এফেক্ট বা ডপলার ক্রিয়া। 

আরও একটু সহজ করে বলি। ধরুন, ঝুম বৃষ্টিতে মাথার ওপর ছাতা ধরে হাঁটছেন। আপনার হাঁটার গতি ধীর। ছাতাটি ঠিক মাথার ওপরে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। এবার ছাতাটি ঠিক মাথার ওপরে না রেখে হেলিয়ে দিলেন একটু সামনের দিকে। ধীরে ধীরে হাঁটার গতি আরও বাড়ালেন। একসময় ছুটতে লাগলেন। এবার মনের অজান্তেই ছাতাটি মাথার ওপর থেকে সরিয়ে মেলে ধরলেন ঠিক বুকের সামনে। যেন মাথার ওপর আর বৃষ্টি না পড়ে। এখন বৃষ্টি পড়ছে বুকের ওপর! কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়! বৃষ্টি তো আর দিক পরিবর্তন করেনি। সে বরাবরই ওপর থেকে সোজা নিচের দিকে পড়ছে। তবু কেন ছাতাটি বুকের সামনে ধরলেন? এমনটি করেছেন, কারণ আপনি না জানলেও আপনার অবচেতন মন ডপলার এফেক্ট সম্পর্কে সচেতন ছিল। আপনি যখন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটছিলেন, তখন বৃষ্টির ঝাপটা আপনার পেছনের দিকে কমে সামনের দিকে বেড়ে গেছে। তাই ছাতা মাথার ওপর থেকে সরিয়ে সামনের দিকে ধরেছিলেন।

পানির তরঙ্গ, শব্দ তরঙ্গ বা আলোর তরঙ্গ—এ সবই ডপলার এফেক্টের নিয়ম মেনে চলে। যখন কোনো তরঙ্গ আমাদের দিকে ছুটে আসে বা আমরা কোনো তরঙ্গের দিকে ছুটে যাই, তখন সে তরঙ্গের দৈর্ঘ্য কমে যায়। তরঙ্গের দৈর্ঘ্য কমলে বেড়ে যায় কম্পন। ফলে বৃষ্টির ঝাপটা, শব্দ কিংবা আলোর তীব্রতা বেড়ে যায়। আবার যখন কোনো তরঙ্গ আমাদের থেকে দূরে সরে যায় বা আমরা কোনো তরঙ্গ থেকে দূরে সরে যাই, তখন তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বাড়ে। আর তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বাড়লে কম্পন কমে। ফলে বৃষ্টির ঝাপটা, শব্দ ও আলোর তীব্রতা কম মনে হয়।

এটাই ডপলার বাস্তবতা। এ কারণেই কোনো পুলিশের গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স যখন সাইরেন বাজিয়ে আমাদের দিকে ছুটে আসে, তখন সাইরেনের শব্দ তীব্র মনে হয়। আবার গাড়ি আমাদের পেছনে ফেলে গেলে শব্দের তীব্রতা মনে হয় কমে গেছে। এই একই কারণে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলো তাদের সব নক্ষত্র নিয়ে আমাদের থেকে দূরে চলে গেলে নক্ষত্রের আলোর তীব্রতা আমাদের চোখে কমে যায়। ফলে রাতের আকাশ মনে হয় কালো। নক্ষত্ররা নিরন্তর আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই রাতের আকাশ আমাদের চোখে কালো দেখাচ্ছে। 

লেখক: কানাডা প্রবাসি