চীনের নিউট্রিনো গবেষণাগারের প্রথম ফলাফল প্রকাশ, ভাঙল ৫০ বছরের রেকর্ড

বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে জুনো ডিটেক্টরছবি: জুনো কোলাবরেশন

ঠিক এই মুহূর্তে আপনার শরীরের ভেতর দিয়ে কোটি কোটি কণা চলে যাচ্ছে, অথচ আপনি টেরও পাচ্ছেন না; কোনো ব্যথাই লাগছে না। দেয়াল, পাহাড়, এমনকি আস্ত পৃথিবী ভেদ করে চলে যেতে পারে এই কণা। বিজ্ঞানীরা এদের নাম দিয়েছেন ঘোস্ট পার্টিকেল বা ভুতুড়ে কণা। আসল নাম নিউট্রিনো।

এই নিউট্রিনো ধরতেই চীনের গবেষকেরা মাটির অনেক গভীরে তৈরি করেছেন বিশ্বের অন্যতম বড় ফাঁদ—‘জিয়াংমেন আন্ডারগ্রাউন্ড নিউট্রিনো অবজারভেটরি’ বা জুনো। মাত্র দুই মাসেই এটি যা করে দেখিয়েছে, তা গত ৫০ বছরের বিজ্ঞানকেও হার মানিয়েছে!

জুনোর বিজ্ঞানীরা এই প্রকল্পের একটি বিশেষ ডিটেক্টর মাত্র ৫৯ দিন চালিয়েছেন। আর এর মধ্যেই তাঁরা নিউট্রিনোর শক্তির মাত্রা বা এনার্জি স্পেকট্রাম এত নিখুঁতভাবে মেপেছেন, যা আগে কখনো সম্ভব হয়নি।

গবেষক জিওচিনো রানুচ্চি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ‘গত অর্ধশতক ধরে বিজ্ঞানীরা যা করার চেষ্টা করছিলেন, আমরা মাত্র ৫৯ দিনেই তা করে ফেলেছি। বুঝতেই পারছেন এই যন্ত্রটি কতটা শক্তিশালী!’

জুনোর গোলাকার কেন্দ্রের ভেতর আছে ২০ হাজার টন তরল। কোনো নিউট্রিনো এই তরলে আঘাত করলে আলোর ঝলক তৈরি হয়, আর চারদিকে ঘিরে থাকা সেন্সরগুলো সেই আলো ধরে ফেলে
ছবি: জুনো কোলাবরেশন

নিউট্রিনো হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় কণা। আমাদের চেনাজানা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম বা স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুযায়ী এদের ভর থাকার কথা নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, এদের ভর আছে। এ জন্য ২০১৫ সালে জাপানের তাকাকি কাজিতা ও কানাডার আর্থার বি. ম্যাকডোনাল্ড পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান।

শুধু তা-ই নয়, এরা ম্যাজিকের মতো রূপ বদলাতে পারে। চলার পথে এরা কখনো ইলেকট্রন, কখনো মিউওন, আবার কখনো টাউ নিউট্রিনোর রূপ নেয়। এই ঘটনাকে বলে নিউট্রিনো অসিলেশন। আর এই রূপ বদলানোর রহস্য ভেদ করলেই পদার্থবিজ্ঞানের এক নতুন অজানা জগৎ আমাদের সামনে খুলে যাবে।

চীনের এই গবেষণাগারটি আসলে মাটির প্রায় ৭০০ মিটার গভীরে রাখা বিশাল এক গোলক, যা প্রায় ১১৫ ফুট চওড়া। এর ভেতরে আছে লিকুইড সিন্টিলেটর নামে ২০ হাজার টন বিশেষ তরল। মাটির নিচে হওয়ায় মহাজাগতিক অন্যান্য রশ্মি এখানে ঢুকতে পারে না। কিন্তু নিউট্রিনো ঠিকই ঢুকে পড়ে। আর যখনই কোনো নিউট্রিনো এই তরলের সঙ্গে ধাক্কা খায়, অমনি সেখানে একটা ছোট্ট আলোর ঝিলিক দেখা যায়। চারপাশ ঘিরে রাখা হাজার হাজার সেন্সর সেই আলো থেকেই বের করে আনে মহাবিশ্বের গোপন সব তথ্য।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা সবে শুরু। নিউট্রিনোর ভরের ক্রম এবং মহাবিশ্বে কেন অ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থের চেয়ে সাধারণ পদার্থের পরিমাণ বেশি, সে রহস্যের উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে এই মাটির নিচেই।

অদৃশ্য এই কণাগুলো আমাদের শোনাচ্ছে নতুন এক পদার্থবিজ্ঞানের গল্প। আর চীন সেই গল্প শোনার জন্যই পেতেছে ইতিহাসের অন্যতম বড় যন্ত্র!

চূড়ান্ত প্রস্তুতির মুহূর্ত। সাদা গোলকের ভেতরেই রয়েছে ২০ হাজার টন তরল
ছবি: জুনো কোলাবরেশন

চীনের এই যুগান্তকারী গবেষণার প্রথম ফলাফলগুলো প্রিপ্রিন্ট সার্ভার ‘আরজিভ’ (arXiv)-এ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া এটি যাচাই-বাছাই বা পিয়ার-রিভিউয়ের জন্য চাইনিজ ফিজিকস সি জার্নালে জমা দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনোর দুটি জটিল বিষয় ‘মিক্সিং অ্যাঙ্গেল’ এবং এদের ‘ভরের পার্থক্য’ সবচেয়ে নির্ভুলভাবে মাপতে পেরেছেন। এই ফলাফল প্রমাণ করল, মাটির নিচের এই ডিটেক্টরটি ঠিকঠাক কাজ করছে এবং এটি মহাবিশ্বের বড় রহস্যগুলো ভেদ করতে পুরোপুরি প্রস্তুত।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, গণিত বিভাগ, পদ্মা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শরীয়তপুর

সূত্র: লাইভ সায়েন্স ও সায়েন্টিফিক আমেরিকান