আদি বাসস্থান ছাড়ার কারণ

পৃথিবী গোলাকার, এ কথা সবার জানা। একসময় মানুষ বিশ্বাস করত পৃথিবী চ্যাপ্টা বা সমতল। কিন্তু সে ধারণা এখন বদলে গেছে। প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর বাইরে যাওয়ার আগে কীভাবে মানুষ বুঝতে পারল পৃথিবী গোল? পৃথিবীর আকারই-বা জানল কীভাবে? ছোটদের জন্য এসব নিয়ে আনাতোলি তমিলিন রুশ ভাষায় লিখেছেন দারুণ একটি বই। এই বইয়ের বাংলা অনুবাদ করেছেন অরুণ সোম। নাম দিয়েছেন পৃথিবী কি গোল। বইয়ের ছবি এঁকেছেন ইউরি সমোলনিকভ। ‘রাদুগা’ প্রকাশনের এই বই বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…

বিজ্ঞানীদের মতে, সবচেয়ে আগে মানুষের আবির্ভাব ঘটে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ অঞ্চলে। ওসব এলাকায় আদিম মানুষের প্রাচীনতম দেহাবশেষ ও তার স্থূল হাতিয়ার পাওয়া গেছে, কিন্তু আমেরিকা মহাদেশে বা অস্ট্রেলিয়ায় এমন কোনো নিদর্শন মেলেনি। তার মানে কি এই নয় যে মানুষ আরও পরে কোনো এক সময় সেখানে বাসাবদল করে? বাসাবদল কেন করে? কেন চলে যায় নিজেদের জন্মস্থান ছেড়ে? কীভাবেই বা পার হয় বিশাল মহাসাগর? 

জানা গেছে যে এ ধরনের বাসাবদলের কারণ অনেক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষুধার তাড়না। আদিম শিকারীরা বন্য জন্তুজানোয়ারের পালের পেছন পেছন বাস উঠিয়ে নিয়ে চলে যেত, বন্য জন্তুজানোয়ার যেখানে, তারাও সেখানে যেত। কোনো কোনো কুলকে বাড়াবাড়ি রকমের জঙ্গী পড়শীদের হাত থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হতো। আবার কোনো কোনো সময় পৃথিবী নিজেও জীবজন্তু ও মানুষের বাসভূমি ত্যাগের কারণ হতো। 

আমাদের এই গ্রহের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এমন বেশ কয়েকটি পর্বের সন্ধান পেয়েছেন যখন উষ্ণ জলবায়ুর বদলে এসেছে শৈত্য, তারপর আবার উষ্ণতা। কেন যে এমন ঘটেছিল বলা কঠিন। এটা ঘটে বিশেষ করে তখন যখন ভূগর্ভের ভেতরে প্রচণ্ড শক্তি জেগে ওঠে। মারাত্মক ভূমিকম্পে পৃথিবীর মাটি টলমল করে। পৃথিবীর গায়ে ভাঁজ পড়তে থাকে। জেগে ওঠে নতুন নতুন পাহাড়-পর্বত, ধুমায়মান আগ্নেয়গিরি, আর পৃথিবী চৌচির হয়ে বের হতে থাকে যত রকমের গভীর ফাটল—গিরিখাত। জাগ্রত আগ্নেয়গিরিগুলো বায়ুমণ্ডলে এত বেশি ছাই ছুঁড়ে ফেলতে থাকে যে বাতাস আর স্বচ্ছ রইল না। ঘন ভারী কালো কালো মেঘের দল সূর্যকে বহু কালের জন্য ঢেকে রেখে দেয়। ঠান্ডা নেমে আসে। 

অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য এমন কথাও বলেন যে, সময় সময় সূর্য নিজেই আর তেমন উজ্জ্বল কিরণ দিত না, আমাদের পৃথিবীতে কম তাপ দিত। কারণ যা-ই হোক না কেন, ঠিক এই ধরনের পর্বগুলোতেই পৃথিবীর উঁচু উঁচু জায়গায় হিমবাহ গড়ে উঠতে লাগল। সাগর-মহাসাগর থেকে জলীয় বাষ্প ওপরে উঠে গিয়ে তুষার হয়ে ঝরে পড়ে শ্যামল উপত্যকাভূমিগুলোকে ঘন তুষারস্তূপে ঢেকে দিল। পাহাড়ের হিমবাহ পুরু আর ভারী হতে থাকে, এদিকে সাগরের পানি ক্রমেই কমতে থাকে। সাগরের কোনো কোনো অগভীর অংশে তলা পর্যন্ত দেখা যেতে লাগল, পরে সেগুলো শুকিয়ে গিয়ে ডাঙা হল। পৃথিবীর এক অংশ থেকে অন্য অংশের ওপর গড়ে উঠল ডাঙার সেতু। অবশ্য সত্যি কথা বলতে গেলে কি, পৃথিবীতে সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে ভয়ঙ্কর শৈত্যপ্রবাহ চলছিল মানুষের আবির্ভাবের বহুকাল আগে। তবে মানুষও তার কবল থেকে একেবারে রেহাই পায়নি। 

হিমবাহগুলো তাদের নিজেদের ভারে পাহাড়ের চুড়ো থেকে সমভূমিতে গড়িয়ে নামতে থাকে। ঠান্ডার তাড়নায় তৃণভোজী পশুপাল পালাতে থাকে, তাদের পেছন পেছন হিংস্র জন্তুজানোয়ার। সেই সঙ্গে মানুষও। 

ডাঙার সেতু বয়ে দলে দলে জীবজন্তু এবং সেই সঙ্গে আদিম শিকারীরাও এশিয়া থেকে আমেরিকা মহাদেশে চলে আসতে সক্ষম হয়। দক্ষিণ-চীন সাগরের খালি তলদেশ আর সুন্দা দ্বীপপুঞ্জের ওপর দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ার কোনো বাধাই ছিল না। 

হাজার হাজার বছর ধরে চলল হিমযুগ। কিন্তু হাজার হাজার বছরও তো আর অনন্তকাল নয়। ধীরে ধীরে ভারী মেঘ সরে যেতে লাগল, সূর্য ফের উজ্জ্বল কিরণ দিতে শুরু করল। ফলে বরফ গলল, হিমবাহ সরে যেতে বাধ্য হলো। বরফমুক্ত জমিগুলোতে আবার গজিয়ে উঠল রসাল শ্যামল ঘাস, মাথা তুলে দাঁড়াল কাঁচ গাছপালার বন। ঘন তৃণভূমিতে আগমন ঘটল ম্যামথ, লোমশ গণ্ডার, বড় বড় শিশুওয়ালা হরিণ, ঘোড়া, কস্তুরীগাই—এই রকম বিশাল বিশাল জন্তুর। তাদের অনুসরণ করে শিকারীরাও ফের জায়গা বদল করল। 

এদিকে সূর্য আরও প্রখর হয়ে উঠল, দাবদাহ ছড়াতে লাগল। উত্তাল নদনদী সাগরে গিয়ে পড়তে লাগল। পানি উঠে বন্যায় ভাসিয়ে দিল ডাঙার সেতু। যে সব মানুষ পেছনে পড়ে ছিল তারা চিরকালের জন্য অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। 

এই ধরনের হিমযুগ আর উষ্ণতার যুগ একাধিকবার আসে। প্রতিবারই ঠান্ডায় ও ক্ষুধার তাড়নায়, উষ্ণতার আশায় জীবজন্তু ও মানুষেরা উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণে ও দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে উত্তরে সরে যায়। সর্বত্রই গতি আর গতি —পশুপাখি, মানুষ সকলেই বাসবদল করে চলছে। অনেকেই এই স্থানান্তরের ধকল সহ্য করতে না পেরে মারা যায়। তবে অনেকে বেঁচেও থাকে। আর প্রতিবারই এরকম বাসবদলের ফলে মানুষের জীবনে কিছু না কিছু নতুনত্ব আসে।

(চলবে…) 

মূল: আনাতোলি তমিলিন

অনুবাদ: অরুণ সোম