প্রথমবারের মতো ব্ল্যাকহোল বোমা তৈরি হলো গবেষণাগারে 

ব্ল্যাকহোল বোমের কথা বিজ্ঞানীরা প্রথম চিন্তা করেন ১৯৬৯ সালে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘূর্ণায়মান সিলিন্ডার এবং চুম্বকীয় কুণ্ডলী ব্যবহার করে ব্ল্যাকহোলের একটি মডেল তৈরি করেন বিজ্ঞানীরা। এই মডেল ব্যবহার করে ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

শাটারস্টোক

সম্প্রতি প্রথমবারের মতো গবেষণাগারে ব্ল্যাকহোল বোমা তৈরি করেছেন যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হেনড্রিক উলব্রিখ্ট ও তাঁর দল। রজার পেনরোজের দেওয়া ধারণার ওপর ভিত্তি করে এ উদ্ভাবন করেন তাঁরা। এতে শক্তিকে প্রতিফলক পৃষ্ঠের সাহায্যে আটকে রাখা হয়। বিস্ফোরণ ঘটলে তাই একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। তাঁদের তৈরি মডেলটি অবশ্য খুবই ছোট, খেলনার মতো। তাই, বিপদ হওয়ার বড় কোনো শংকা নেই। গবেষকদের এ আবিষ্কারের মূল রহস্যটা অবশ্য শক্তির উৎসকে ঘিরে। তাঁরা যে পদ্ধতিতে শক্তি জমা করছেন, সেটি সত্যিকারের ব্ল্যাকহোলের মতোই কাজ করে। অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞানের নীতিগুলো প্রায় একই। তাই বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত এ ব্ল্যাকহোল প্রকৃত ব্ল্যাকহোলের ঘূর্ণন ও নানা রহস্য বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

রজার পেনরোজের ধারণা দেওয়ার দুই বছর পর পদার্থবিদ ইয়াকভ জেলদোভিচ দেখান, একই রকম ফলাফল পাওয়া যায় দ্রুতবেগে ঘুরতে থাকা ধাতব সিলিন্ডারের চারপাশে আলোর গতিবিধি থেকে।

১৯৬৯ সালে পদার্থবিদ রজার পেনরোজ প্রথম ব্ল্যাকহোল থেকে শক্তি সংগ্রহ করার বিষয়ে ধারণা দেন। তিনি দেখান, একটি কণা যদি ঘূর্ণায়মান ব্ল্যাকহোলের খুব কাছ দিয়ে উড়ে যায়, তাহলে সাধারণ আপেক্ষিকতার এক অদ্ভুত প্রভাবের কারণে সেটি শক্তি লাভ করবে। ব্ল্যাকহোল তার চারপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে ফেলে ও ত্বরাণিত্ব করে।

যাহোক, রজার পেনরোজের ধারণা দেওয়ার দুই বছর পর পদার্থবিদ ইয়াকভ জেলদোভিচ দেখান, একই রকম ফলাফল পাওয়া যায় দ্রুতবেগে ঘুরতে থাকা ধাতব সিলিন্ডারের চারপাশে আলোর গতিবিধি থেকে। এ প্রভাবকে বলা হচ্ছে সুপাররেডিয়েন্স। তিনি হিসাব করে দেখান, এই সুপাররেডিয়েন্স প্রভাবটি ঘটবে যদি সিলিন্ডারটি আলোর সমান কম্পাঙ্কে ঘোরে। অর্থাৎ, সিলিন্ডারটিকে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ঘোরাতে হবে। অধ্যাপক উলব্রিখ্টের মতে, ‘এত উচ্চ গতিতে কোনো বস্তু ঘোরানো একেবারেই অসম্ভব’।

জেলদোভিচ তাঁর সেই প্রস্তাবনায় আরও বলেন, যদি এই ঘূর্ণায়মান সিলিন্ডারকে প্রতিফলক পৃষ্ঠ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়, তাহলে বাড়তি শক্তি প্রতিফলিত হয়ে জমা হতে থাকবে। এক পর্যায়ে এটি বিস্ফোরিত হয়ে জমাকৃত সব শক্তি বেরিয়ে আসবে। ঘুর্ণায়মান ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে, এটি এমন এক ‘ব্ল্যাকহোল বোমা’ তৈরি করতে সক্ষম, যেটা সুপারনোভা বিস্ফোরণের মতো বিপুল শক্তি নির্গত করবে। এই প্রক্রিয়া বাইরের কোনো শক্তি ছাড়াই কাজ করবে। কারণ, ব্ল্যাকহোল নিজেই মহাশূন্যে ছোট ছোট বৈদ্যুতিক স্পন্দনকে বাড়িয়ে শক্তি তৈরি করতে পারে।

এতদিন এসব ধারণা ছিল তাত্ত্বিক। অধ্যাপক উলব্রিখ্টে এবং তাঁর সহকর্মীরা একটি ঘূর্ণায়মান অ্যালুমিনিয়াম সিলিন্ডার এবং চৌম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করে জেলদোভিচের শক্তি সংগ্রহের প্রক্রিয়া হাতেকলমে দেখিয়েছেন। ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যের প্রথম কোভিড-১৯ লকডাউনের সময় এর মডেলটি তৈরি করেছিলেন তাঁরা। অধ্যাপক উলব্রিখ্টে তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘তখন সব কিছু বন্ধ ছিল। আমি সত্যিই বিরক্ত ছিলাম। কিছু একটা করতে চাচ্ছিলাম। একসময় আমি এই সেটআপটি তৈরি করে পরীক্ষা শুরু করলাম। দেখলাম, সত্যিই শক্তির পরিমাণ বাড়ছে। আমি এতটা উত্তেজিত হয়েছিলাম যে বলা যায় কোভিডের সময়ে এটি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।’

যদিও গবেষণাগারের এ সংস্করণটি কেবলই পরীক্ষামূলক, তারপরও ব্ল্যাকহোল কীভাবে এর চারপাশের কণাগুলোকে শক্তি দেয়, তা নিয়ে আরও বিশদভাবে জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে এ গবেষণা থেকে।

পরে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি আরেকটি শক্তিশালী সেটআপ তৈরি করেন। একটি ঘূর্ণায়মান অ্যালুমিনিয়াম সিলিন্ডার ও এর চারপাশে তিনটি স্তরের ধাতুর কুণ্ডলী দিয়ে তৈরি করা হয় সেটি। ধাতুর কুণ্ডলীগুলো মিলে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে। কুণ্ডলীগুলো শক্তির প্রতিফলক হিসেবে কাজ করে। আর চৌম্বকক্ষেত্রটি তৈরি করে আলোর মতো বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ।

পুরো প্রক্রিয়াটি হজম করতে বিজ্ঞানীদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। পর্তুগালের লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ও গবেষক, ভিটর কার্ডোসো এ আবিষ্কার সম্পর্কে বলেন, ‘একটি কম ফ্রিকোয়েন্সির বৈদ্যুতিক তরঙ্গ একটি ঘূর্ণায়মান সিলিন্ডারের দিকে ছুড়ে দেওয়া হলে, কে ভাববে যে যা দেওয়া হচ্ছে তার চেয়ে বেশি শক্তি পাওয়া যাবে? এটা বিশ্বাস করা কঠিন!’

উলব্রিখট এবং তাঁর দল দেখিয়েছেন, যদি কুণ্ডলীগুলো শুরুতে কোনো বাহ্যিক চৌম্বকক্ষেত্র না তৈরি করে কাজ করে, তবুও সেটআপটি চারপাশের কুণ্ডলীগুলোতে একটি শক্তিশালী সিগন্যাল তৈরি করে। ঠিক যেমন ব্ল্যাকহোলের মধ্যে হয়। উলব্রিখট বলছেন, ‘আমরা আসলে নয়েজ বা শব্দ থেকে শক্তি তৈরি করছি। তবে এটি এমন এক প্রক্রিয়া, যা ব্ল্যাকহোল বোমার ধারণায় ঘটে।

যদিও গবেষণাগারের এ সংস্করণটি কেবলই পরীক্ষামূলক, তারপরও ব্ল্যাকহোল কীভাবে এর চারপাশের কণাগুলোকে শক্তি দেয়, তা নিয়ে আরও বিশদভাবে জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে এ গবেষণা থেকে। শুধু তাই নয়, অধ্যাপক কার্ডোসো বলেন, ‘আমরা ব্ল্যাকহোলগুলোকে ধীরে ধীরে স্পিন করতে দেখছি। কারণ, তাঁরা তাদের শক্তি এই নতুন কণাগুলোর কাছে দিচ্ছে। সুতরাং বলা যায়, সুপাররেডিয়েন্স প্রভাবটি ব্ল্যাকহোলকে কণা শনাক্তকারী যন্ত্রে পরিণত করেছে। ডার্ক ম্যাটার শনাক্ত করার জন্য সিএনআরএনের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার থেকেও অনেক ভালো যন্ত্র হতে পারে ব্ল্যাকহোল’।

ব্ল্যাকহোল বোমার এ গবেষণা ভবিষ্যতে ব্ল্যাকহোলের আচরণ এবং শক্তি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এতে জানা যেতে পারে মহাবিশ্বের অজানা অনেক রহস্যের সমাধান।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট