দূরপথে রক্তিম দীপশিখা

একলা কিছু মুহূর্ত নিজের সঙ্গে কাটাতে চাইছেন? চাইছেন বন্ধ ঘরের কোলাহল থেকে বেরিয়ে কিছুটা সময় নিজের মতো কাটাতে? কী করবেন তখন? হয়তো গিয়ে দাঁড়ালেন ব্যালকনি কিংবা খোলা স্থানে। বেড়াতে গিয়েও হয়তো কখনো কখনো রাতে খোলা প্রকৃতির সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন অনেকেই। আর তখন? একবারের জন্য হলেও তারাভরা আকাশের দিকে আমাদের চোখ যায়, নাকি? অবশ্যই যায়। আর সেসব মনে প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা, মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্র বলে কি কিছু ছিল? প্রথম জ্যোতিষ্ক? নাকি সৃষ্টির আদি মুহূর্ত থেকেই নক্ষত্রের আলোয় আমাদের মহাবিশ্ব আলোকিত?

সে কোন অতীতকাল থেকে এই প্রশ্নগুলোর জন্ম হচ্ছে মানবমনে। আর এর জবাব? এর উত্তর সহজে মেলেনি। মানা কয়েক দশক হলো এই প্রশ্নের মীমাংসার একটা আভাস খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সে এক বেশ বড় সাফল্য। তবে সে আভাসই। নিশ্চিত প্রমাণ নয়। নিশ্চিত প্রমাণের জন্য তাই পাঠানো হচ্ছে এক নতুন নভোদুরবিন। নাম জেমস ওয়েব দূরবীক্ষণ যন্ত্র। মহাবিশ্বের প্রথম যুগের জ্যোতিষ্ঠ নিয়ে গবেষণা করাই হবে এই যন্ত্রের অন্যতম প্রধান কাজ।

প্রায় এক শতাব্দী আগে এডুইন হাবল আবিষ্কার করেছিলেন, মহাবিশ্ব ক্রমশ বড় হচ্ছে। দূরের গ্যালাক্সি আরও দূরে চলে যাচ্ছে। তারপর আইনষ্টাইনের মহাকর্ষসংক্রান্ত নতুন তত্ত্ব থেকে বোঝা গেল যে এটা স্বাভাবিক। সৃষ্টির মুহূর্ত, যাকে আমরা বিগ ব্যাং বলি, সেই সময় থেকেই মহাবিশ্ব প্রসারমাণ। যদি মহাবিশ্বে যথেষ্ট পরিমাণ তর থাকে, তাহলে একসময় আবার ছোট হতে শুরু করবে। না হলে এভাবেই বড় হতে থাকবে। আমরা যখন ওপরের দিকে পাথর ছুড়ি, তখন তার গতিবেগ ও পৃথিবীর ভর ঠিক করে দেয়, সেটি কীভাবে এগোবে। গতিবেগ খুব বেশি হলে ওপরের দিকেই যেতে থাকবে (যেমন করে আমরা রকেট পাঠাই), আর না হলে একসময় মাটিতে ফিরে আসবে। প্রায় এই রকমই ঘটনা ঘটে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে। সম্প্রতি দেখা গেছে যে মহাবিশ্বের প্রসারে বাধা দেওয়ার মতো শক্তি নেই। মহাবিশ্ব আরও বড় হতে থাকবে ভবিষ্যতে।

আইনস্টাইনের তত্ত্ব আরও একটি কথা বলে। মহাবিশ্ব যত বড় হয়, তার মধ্যে আলোর তরঙ্গও পাল্লা দিয়ে বড় হতে থাকে। আজ যা নীল আলো, সেটি ভবিষ্যতে কখনো লাল আলোয় পরিণত হবে। কারণ, লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নীলের তুলনায় বেশি। আরেকভাবে বলা যায়, অতীতে যা নীল আলো ছিল, বর্তমানে সেটা লাল রঙের দিকে ঘেঁষবে। যত বেশি অতীতের দিকে তাকাব, এই 'লোহিতসরণ" তত বেশি প্রকট হবে। অতীতের জ্যোতিষ্কের আলোয় লালিমা এঁকে দেয় মহাবিশ্বের প্রসারণ। সেগুলো দূরের জ্যোতিষ্কও বটে। কারণ, যত দূরের জিনিস, তত বেশি সময় লাগে সেখান থেকে আলো এসে পৌঁছাতে। আমাদের চোখে যখন সূর্যের আলো ধরা পড়ে, তখন আমরা দেখি সাড়ে আট মিনিট আগেকার সূর্য। নক্ষত্রগুলোর ক্ষেত্রে দেখি কয়েক আলোকবর্ষ আগেকার চেহারা। সুদূর গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে কয়েক কোটি বছর আগের বিকিরিত আলো।

অর্থাৎ আলোর সীমিত গতিবেগ আমাদের বলে দেয়, দূরের জ্যোতিষ্ক দেখার সময় আমরা অতীতের চেহারা দেখি। এর সঙ্গে আইনষ্টাইনের তত্ত্ব ও হাবলের আবিষ্কার যোগ করলে যা দাঁড়ায়, সেটা হলো, বহু দূরের জ্যোতিষ্কের আলো লালচে হয়। সেই জন্যই দূরপথের জ্যোতিষ্কের আলো রক্তিম। সুতরাং মহাবিশ্বের সুদূর অতীতে প্রথম জ্যোতিষ্কের গবেষণার জন্য চাই লাল অথবা অবলোহিত আলো ধরার উপযুক্ত যন্ত্র। আর জেমস ওয়েব নভোদুরবিন ঠিক সেই কথা মনে রেখেই তৈরি করা হয়েছে।

একবার মহাবিশ্বের অতীতের দিকে কল্পনা করা যাক। একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখতে গেলে মোটামুটি এ রকম দাঁড়াবে। মহাবিশ্বের বয়স যখন মিনিট তিনেক, তখন ফিউশন বিক্রিয়া হয়ে হিলিয়াম ও ডিউটেরিয়াম তৈরি হয়েছিল। যত সময় পেরিয়েছে, মহাবিশ্ব তত বড় হয়েছে। আর ধীরে ধীরে শীতল হয়েছে পদার্থ। সঙ্গে বিকিরণও। কারণ, অতীতে মহাবিশ্বের ঘনত্ব ছিল বেশি এবং পদার্থ ও বিকিরণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পদার্থকণা বিকিরণ শুষে নিত, তারপর ছড়িয়েও দিত।

এর প্রায় পৌনে চার লাখ বছর পর মহাবিশ্বে প্রথম পরমাণু তৈরি হলো। বেশির ভাগ হাইড্রোজেন, সিকি ভাগ হিলিয়াম। তখন মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ছিল প্রায় চার হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিকিরণের সিংহভাগ ছিল দৃশ্যমান বেশির ভাগ আলোর রং ছিল লাল। তারপর যখন মহাবিশ্ব আরও বড় ও শীতল হলো, তখন বিকিরণের রং লাল পেরিয়ে অবলোহিতের দিকে চলে গিয়েছিল (এখন সেটা মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে পরিণত হয়েছে)। তখন শুরু হয়েছিল মহাবিশ্বের অন্ধকার যুগ।

অন্ধকার হলে কী হবে, এর মধ্যেই মহাকর্ষ সবার অলক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিল। যেসব জায়গায় পদার্থকণা খানিকটা পরস্পরের কাছে এসেছে, সেখানে পদার্থের জমাট বাঁধার কাজ আরও উসকে দিয়েছে মহাকর্ষ। মহাকর্ষের ধর্মই তাই। কাছে টানা। তাই মহাবিশ্বের স্থানে স্থানে পদার্থ জমাট বাঁধে। গ্যাস জড়ো হয়। এসব জায়গাতেই প্রথম নক্ষত্র জন্ম নিয়েছিল। অন্ধকার সরিয়ে আলোয় আলোকিত হয়েছিল মহাবিশ্ব।

কখন ঘটেছিল এই ঘটনা? হিসাব করে দেখা গেছে, খুব সম্ভবত মহাবিশ্বের বয়স তখন ছিল ১০ থেকে ২০ কোটি বছর। আরেকভাবে বলা যায়, সেই সময় থেকে মহাবিশ্বের আকার এখন পর্যন্ত ১০ থেকে ২০ গুণ বড় হয়েছে। অর্থাৎ সেই প্রথম নক্ষত্র থেকে আসা আলোর তরঙ্গও এখন ১০ থেকে ২০ গুণ দীর্ঘ হবে। সাধারণত নক্ষত্রের আলো যদি নীল থেকে লাল রঙের অন্তর্বর্তী হয়, তাহলে সেই আলো আমাদের কাছে এখন অবলোহিত আলো হয়ে ধরা দেবে।

প্রসঙ্গত, বলে রাখা উচিত যে এই হিসাব বোঝাতে অনেক জায়গায় লেখা থাকে, অমুক গ্যালাক্সি থেকে আলো এত হাজার কোটি বছর পর আমাদের কাছে এসেছে। এই অঙ্কে অনেক সূক্ষ্ম কথা লুকানো থাকে, ফলে বিভ্রান্তি হতে পারে। কারণ, আইনস্টাইনের তত্ত্ব খুব সহজ নয়। তবে সেই সময় থেকে মহাবিশ্ব বড় হয়ে বর্তমানে কত গুণ হয়েছে, এই হিসাব সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের একেকটা যুগ বোঝাতে তার 'রেডশিফট' ব্যবহার করেন, যাকে আমরা বলতে পারি 'লোহিতসরণকাল। যদি লোহিতসরণকাল ১০-এর কোনো জ্যোতিষ্কের কথা বলা হয়, তাহলে সেই সময় থেকে মহাবিশ্ব এখন পর্যন্ত কত গুণ বেড়েছে, তার একটা সহজ হিসাব আছে। সেটি হলো ১০+১=১১ গুণ। বিজ্ঞানীরা তাঁদের পর্যবেক্ষণের সময় এ হিসাবই লিখে রাখেন। মোট কথা, প্রথম নক্ষত্রের জন্ম হয়েছিল লোহিতসরণকাল (রেডশিফট) ১০-২০, এই সময়ে।

এর খানিকটা এদিক-ওদিকও হতে পারে। কারণ, প্রথম প্রজন্মের নক্ষত্রগুলো আজকের মহাবিশ্বে যেসব নক্ষত্র দেখা যায়, তার মতো ছিল না। যেমন সূর্য। আমরা জানি, সূর্যে আমাদের পরিচিত অনেক মৌল পদার্থ রয়েছে। কার্বন, অক্সিজেন, সোডিয়াম ইত্যাদি। কিন্তু প্রথম নক্ষত্রের বেলায় এসব পদার্থ ছিল না। তখন মহাবিশ্বে ছিল শুধু হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও সামান্য পরিমাণে লিথিয়াম। ফলে সেই নক্ষত্রগুলোর গঠন ছিল ভিন্ন। সেগুলোর কেন্দ্রে ফিউশন বিক্রিয়ার হার আজকের মতো ছিল না। তাই সেগুলোর। ঔজ্জ্বল্য নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়ে গেছে। প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। প্রথম প্রজন্মের নক্ষত্রের গঠন ও বিবর্তন নিয়ে।

আরও কিছু অজানা প্রসঙ্গ চলে আসে এই হিসাবে। নক্ষত্রের জন্ম প্রক্রিয়ায় মহাকাশের ধুলাবালু খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধুলাবালুর গায়ে লেগে পরমাণু থেকে অণু তৈরি হয়। সেই অণু থেকে বিকিরিত আলো সাহায্য করে। গ্যাসকে ঘন হতে। একসময় ঘন হতে হতে এই গ্যাস থেকেই। নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এখানেই সমস্যা। ধুলাবালু তৈরি হয়। কার্বন ও সিলিকন দিয়ে। কিন্তু প্রথম নক্ষত্রের বেলায় তো মহাবিশ্বে কার্বন, সিলিকন ছিল না। সেগুলো তৈরি হয়েছে। নক্ষত্রগুলোর কেন্দ্রে। অর্থাৎ তখন ধুলাবালু ছিল না মহাবিশ্বে। তাহলে প্রথম নক্ষত্র কীভাবে জন্ম নিয়েছিল?

এই প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানীরা ধুলাবালু ছাড়াই অণু তৈরির হিসাব করেছেন। সেই অঙ্কে বেশ কিছু ধাপ এখনো ভালো করে জানা নেই। কিছুটা অনুমান করে নিতে হয়েছে। সেই অনুমানগুলো যথার্থ কি না, জানতে গেলে হাতেনাতে পরীক্ষা করা দরকার। পর্যবেক্ষণ করে বের করতে হবে। প্রজন্মের নক্ষত্র দেখা গেলেই সেটা সম্ভব।

সে জন্যই জেমস ওয়েব দূরবীক্ষণ যন্ত্র অবলোহিত আলো পর্যবেক্ষণের কথা ভেবে তৈরি করা হয়েছে। প্রথম নক্ষত্রের আলো দেখার জন্য। এই পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যাবে, প্রথম নক্ষত্রের জন্ম নিয়ে তাত্ত্বিক ধারণাগুলো সত্যি কি না। কে জানে, তাত্ত্বিক হিসাবগুলো করার সময় যা কিছু অনুমান করা হয়েছিল, সেগুলো আদৌ যথার্থ কি না। এমনও হতে পারে যে প্রথম নক্ষত্রের জন্মের সময় দেখা গেল হয়তো মোটামুটি ঠিক, কিন্তু সেগুলোর ঔজ্জ্বল্য যদি হিসাবমতো না। হয়, তাহলে জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের সাহায্যে দেখা না-ও যেতে পারে। তাই এই গবেষণার ফল নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। আর সেখানেই রয়েছে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ।

এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই হাবল নভোদুরবিনের সাহায্যে অতি প্রাচীন গ্যালাক্সির সন্ধান পেয়েছেন। যেমন একটি গ্যালাক্সি, যার সময় থেকে এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের আকার প্রায় ১০ গুণ বড় হয়েছে। হাবল নভোদুরবিনের সাহায্যে কয়েকটি এমন গ্যালাক্সি ধরা পড়লেও সেগুলোর সংখ্যা হাতে গোনার মতো। জেমস ওয়েব নভোদুরবিন এ রকম অনেক গ্যালাক্সি দেখতে পারবে অনায়াসে। তাই প্রাচীন গ্যালাক্সি, প্রথম নক্ষত্র ইত্যাদি বিষয়ের গবেষণায় এক নতুন জোয়ার আসবে। সেই প্রতীক্ষায় রয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

• এই গবেষণার বিশদ বিবরণের জন্য লেখকের 'মহাবিশ্বের প্রথম আলো' (অনুষ্টুপ, কলকাতা, ২০১৭) দ্রষ্টব্য।

লেখক : অধ্যাপক, রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বেঙ্গালুরু, ভারত