যে কারণে মরণফাঁদ হয়ে উঠছে মহাকাশ
ঢাকার রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম দেখেছেন তো? গাড়ি চলছে, থামছে, আবার ডানে-বামে কেটে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। মহাকাশেও প্রায় একই অবস্থা হতে চলেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির গবেষকেরা এক নতুন গবেষণায় এমনই ভয়াবহ সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথ এতই মহাকাশীয় বর্জ্যে ঠাসা যে, সেখানে স্যাটেলাইট চালানো এখন রীতিমতো বিপজ্জনক।
পরিসংখ্যানটা শুনলে আঁতকে উঠবেন। ২০১৯ সালেও মহাকাশে স্যাটেলাইট বা আবর্জনার টুকরো ছিল প্রায় ১৩ হাজার ৭০০টি। আর ২০২৫ সালের শুরুতে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ১৮৫ তে! মাত্র কয়েক বছরেই মহাকাশে বস্তুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এই দশকের শেষে অর্থাৎ ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। সোজা কথায়, মহাকাশে আর তিল ধারণের জায়গা থাকবে না।
রাস্তায় যেমন অন্য গাড়ি বা গর্ত দেখলে আমরা পাশ কাটিয়ে যাই, মহাকাশে স্যাটেলাইটেরও ঠিক তা-ই করতে হয়। একে বলে কলিশন-অ্যাভয়েডেন্স ম্যানুভার বা সংঘর্ষ এড়ানোর কসরত।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালে মাত্র ০.২ শতাংশ স্যাটেলাইটকে মাসে ১০ বারের বেশি পাশ কাটাতে হতো। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে সেই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৪ শতাংশে। সংখ্যাটা শুনতে ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে প্রায় ৩৪০টি স্যাটেলাইটকে এখন তাদের মূল কাজ বাদ দিয়ে সারাক্ষণ শুধু ধাক্কা এড়ানোর কাজেই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে!
এই গবেষণার সহ-লেখক মায়া হ্যারিস বলছেন, ‘স্যাটেলাইট অপারেটররা চান না তাদের মূল্যবান জ্বালানি শুধু পাশ কাটাতে গিয়েই ফুরিয়ে যাক। স্যাটেলাইটের আসল কাজটা তাঁরা করতে চান।’
স্টারলিংক একাই গত ছয় মাসে ১ লাখ ৪৫ হাজার বার ধাক্কা এড়ানোর কসরত করেছে। তারা হয়তো এটা সামলে নিচ্ছে, কিন্তু বাকিদের জন্য মহাকাশ ক্রমেই এক মরণফাঁদ হয়ে উঠছে।
গবেষকেরা আরও বলছেন, ‘মহাকাশে দুটি বস্তু যদি একে অপরের ২০০ মিটারের মধ্যে চলে আসে, তখনই লাল বাতি জ্বলে ওঠে।’
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা অবশ্য একটু বেশি সতর্ক। সংঘর্ষের ঝুঁকি ১০ হাজারে ১ ভাগ হলেই তারা স্যাটেলাইট সরিয়ে নেয়। অন্যদিকে স্পেসএক্সের স্টারলিংক স্যাটেলাইটগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। ওদের ঝুঁকি ৩৩ লাখে ১ ভাগ হলেই সরে যায়।
কিন্তু সমস্যা হলো, এভাবে বারবার সরে যেতে থাকলে স্যাটেলাইটের সেবায় ব্যাঘাত ঘটে। বিশেষ করে যেসব স্যাটেলাইট পৃথিবীর ছবি তোলে বা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে, সেগুলোর জন্য নির্দিষ্ট কক্ষপথে থাকাটা খুব জরুরি। একটু এদিক-সেদিক হলেই ছবির মান নষ্ট হয়ে যায়। স্টারলিংকের মতো ইন্টারনেট স্যাটেলাইটের জন্য এটা খুব বড় সমস্যা না হলেও অন্যদের জন্য এটা মাথাব্যথার কারণ।
মহাকাশের সব জায়গায় কিন্তু সমান ভিড় নয়। গবেষকরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি জট লেগে আছে ৪০০-৬০০ কিলোমিটার ও ৭০০-৮০০ কিলোমিটার উচ্চতায়। মহাকাশ বর্জ্য বিশেষজ্ঞ হিউ লুইস সতর্ক করে বলেছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে কক্ষপথে বড় কোনো সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ১০ শতাংশ! আর একবার যদি দুটো বড় স্যাটেলাইটের ধাক্কা লাগে, তবে হাজার হাজার নতুন টুকরো তৈরি হবে। সেই টুকরোগুলো আবার অন্য স্যাটেলাইটকে ধাক্কা দেবে। শুরু হবে এক ধ্বংসাত্মক চেইন রিঅ্যাকশন।
এই সমস্যার থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় একটাই—সব দেশকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। কে কোন কক্ষপথে স্যাটেলাইট বসাবে, তা নিয়ে সমন্বয় করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা কি সম্ভব? যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো কি এক টেবিলে বসে এই জট সামলাবে? হিউ লুইস মনে করেন, সেই সম্ভাবনা খুব কম।
স্টারলিংক একাই গত ছয় মাসে ১ লাখ ৪৫ হাজার বার ধাক্কা এড়ানোর কসরত করেছে। তারা হয়তো এটা সামলে নিচ্ছে, কিন্তু বাকিদের জন্য মহাকাশ ক্রমেই এক মরণফাঁদ হয়ে উঠছে।