ইউরেনাস ও নেপচুন সম্ভবত বরফের নয়, পাথরের তৈরি

নেপচুন এবং এর প্রতিবেশী ইউরেনাসছবি: মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

সৌরজগতে সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরের দুটি গ্রহ ইউরেনাস ও নেপচুন। এত দিন জানা ছিল, এরা আইস জায়ান্ট। মানে দৈত্যাকার বরফের গোলা। কিন্তু নতুন এক গবেষণা অন্য কথা বলছে। সাম্প্রতিক এক কম্পিউটেশনাল মডেল ইঙ্গিত দিচ্ছে, এই গ্রহগুলো হয়তো বরফে ভরা না। বরং এগুলো পাথুরে উপাদান দিয়ে তৈরি। মানে এরা পৃথিবী বা মঙ্গলের মতো পাথুরে গ্রহও হতে পারে।

চলতি বছর ১০ ডিসেম্বর অ্যাস্ট্রনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস জার্নালে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে জানা গেছে, এই গ্রহগুলো পাথুরে হওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই, পাশাপাশি এদের রহস্যময় চৌম্বকক্ষেত্রের ব্যাখ্যাও নতুন করে পাওয়া যেতে পারে। এত দিন এই গ্রহ দুটির ভেতরের গঠন নিয়ে বিজ্ঞানীরা তেমন কিছু জানতেন না। কারণ, সংগৃহীত তথ্যের বড় অংশই ১৯৮০-এর দশকের। ভয়েজার-২ এই দুই গ্রহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেসব তথ্য সংগ্রহ করেছিল।

ভয়েজার ২ ১৯৮৯ সালে নেপচুনের এই স্ন্যাপশট নিয়েছিল।
ছবি: নাসা

সূর্য থেকে গড়ে ২৮০ কোটি মাইল দূরে ঘুরে বেড়ানো নেপচুন এবং এর প্রতিবেশী ইউরেনাস। এই দুই গ্রহে তীব্র ঠান্ডা। প্রচলিত ধারণা ছিল, এই ঠান্ডার কারণে পানি, হাইড্রোজেন, হিলিয়ামের মতো গ্যাস জমাট বেঁধে ঘন বরফের মতো স্তরে পরিণত হয়েছে। এ কারণেই এদের আইস জায়ান্ট বলা হতো। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল গবেষক লুকা মর্ফ এবং তাঁর তত্ত্বাবধায়ক রাভিত হেল্ডের নতুন মডেল দেখাচ্ছে, বিষয়টি অত সরল নয়।

আরও পড়ুন
নেপচুন এবং এর প্রতিবেশী ইউরেনাস, এই দুই গ্রহে তীব্র ঠান্ডা। প্রচলিত ধারণা ছিল, এই ঠান্ডার কারণে পানি, হাইড্রোজেন, হিলিয়ামের মতো গ্যাস জমাট বেঁধে ঘন বরফের মতো স্তরে পরিণত হয়েছে।

মর্ফের মতে, ইউরেনাস ও নেপচুনকে আইস জায়ান্ট বলে চিহ্নিত করা একধরনের অতিসরলীকরণ। কারণ, এই গ্রহগুলোর ভেতরটা আমরা এখনো ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। একদিকে পদার্থবিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করা মডেলগুলোতে অনেক অনুমান করা হয়, অন্যদিকে পর্যবেক্ষণভিত্তিক মডেলগুলো অনেক সময় অতিরিক্ত সরল হয়। তাই তাঁরা এই দুই পদ্ধতির সমন্বয়ে একটি হাইব্রিড মডেল তৈরি করেছেন। উদ্দেশ্য, এটি যেন একই সঙ্গে নিরপেক্ষ ও ভৌতভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়।

ইউরেনাস (বামে) এবং নেপচুনের (ডানে) ছবি
ছবি: নাসা

গবেষণায় প্রথমে গ্রহের কেন্দ্র থেকে দূরত্বের সঙ্গে কেন্দ্রের ঘনত্ব কীভাবে বদলায়, তা অনুমান করা হয়েছে। এরপর গ্রহের মহাকর্ষীয় প্রভাব যুক্ত করে কেন্দ্রের তাপমাত্রা ও উপাদান সম্পর্কে নেওয়া হয়েছে ধারণা। এই তথ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি ঘনত্বের প্রোফাইল। তারপর সেই প্রোফাইল মডেলে বসানো হয়েছে। যতক্ষণ না বর্তমান পর্যবেক্ষণের তথ্যের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে, ততক্ষণ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে বিভিন্নভাবে।

এই পদ্ধতিতে ইউরেনাস ও নেপচুনের জন্য মোট আট ধরনের সম্ভাব্য কেন্দ্রের ছবি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তিনটি কেন্দ্রে পাথরের পরিমাণ পানির তুলনায় অনেক বেশি। মানে, এই গ্রহগুলোর ভেতরটা কেবল বরফ দিয়েই ভর্তি নয়। পাথুরে উপাদানও এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

আরও পড়ুন
মর্ফ বলেছেন, এত উচ্চ চাপ ও তাপমাত্রায় বিভিন্ন উপাদান ঠিক কীভাবে আচরণ করে, তা পদার্থবিদ্যায় এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। এই অনিশ্চয়তা ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে।

সব কটি মডেলেই কেন্দ্রের ভেতরে এমন অঞ্চল পাওয়া গেছে, যেখানে পানি থাকে আয়নিক রূপে। অতি চাপ ও তাপে পানির অণু ভেঙে প্রোটন ও হাইড্রোক্সাইড আয়নে বিভক্ত হয়। গবেষকদের ধারণা, এই স্তরগুলোই হয়তো ইউরেনাস ও নেপচুনের অদ্ভুত চৌম্বকক্ষেত্রের উৎস। যে কারণে এই গ্রহগুলোর চৌম্বক মেরুর সংখ্যা দুইয়ের বেশি। মডেল আরও ইঙ্গিত দেয়, ইউরেনাসের চৌম্বকক্ষেত্র সম্ভবত নেপচুনের তুলনায় গ্রহের কেন্দ্রের আরও কাছাকাছি কোনো অঞ্চল থেকে সৃষ্টি হয়েছে।

ইউরেনাস ও নেপচুন উভয় গ্রহই পাথুরে উপাদান দিয়ে তৈরি
ছবি: নাসা

এই গবেষকেরা কিছু সতর্কতাও দিয়েছেন। মর্ফ বলেছেন, এত উচ্চ চাপ ও তাপমাত্রায় বিভিন্ন উপাদান ঠিক কীভাবে আচরণ করে, তা পদার্থবিদ্যায় এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। এই অনিশ্চয়তা ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে। ভবিষ্যতে তাঁরা মিথেন ও অ্যামোনিয়ার মতো আরও অণু মডেলে যুক্ত করে এটিকে আরও বাস্তবসম্মত করতে চান।

রাভিত হেল্ডের মতে, কোন মডেলটি বেছে নেওয়া হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করেই ইউরেনাস ও নেপচুনকে রক জায়ান্ট বা আইস জায়ান্ট বলা যায়। কিন্তু সত্যিটা জানতে হলে বর্তমান তথ্য যথেষ্ট নয়। ভয়েজার-২-এর কয়েক দশকের পুরোনো তথ্য দিয়ে এই গ্রহগুলোর আসল অবস্থা পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। তাই ইউরেনাস ও নেপচুনে আলাদা করে নতুন মহাকাশ মিশন পাঠানো জরুরি বলে মনে করছেন এই গবেষকরা।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন