গ্রহাণুতে সোনার খনি

কলম্বিয়ার এলডোরাডো নাকি সোনায় মোড়ানো শহর ছিল। কিন্তু সেই শহরের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এলডোরাডো আসলেই বাস্তব নাকি পুরোটাই মিথ, সে প্রশ্ন আজ থাক। তবে ২০২০ সালে নাসা এমন একটি গ্রহাণুর সন্ধান পেয়েছিল, যেটা মহামূল্যবান ধাতুতে ঠাসা।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নাসার আবিষ্কৃত গ্রহাণুটির নাম ১৬ সাইকি। প্রায়ই মহাকাশে গ্রহাণুর সন্ধান পান বিজ্ঞানীরা। তবে সেই সব গ্রহাণু থেকে ১৬ সাইকির গুরুত্ব অনেক বেশি। সাধারণত গ্রহাণুগুলো পাথুরে হয়। কিন্তু নতুন পাওয়া গ্রহাণুটি অন্যান্য গ্রহাণু থেকে আলাদা। এই গ্রহাণুতে আছে প্রচুর লোহা ও নিকেল। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই গ্রহাণুতে পাওয়া যাবে বহু মূল্যের সোনাও। তাই অন্য সব গ্রহাণু থেকে এর কদর বেশি পৃথিবীবাসীর কাছে। ১৬ সাইকির বর্তমান অবস্থান মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝামাঝি।

১৬ সাইকির আকার আমাদের চাঁদের ১০০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। এর প্রশস্ততা প্রায় ২২৫ কিলোমিটার। গ্রহাণুটি প্রতি ৫ বছরে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে।

গ্রহাণুটিতে কী পরিমাণ লোহা আছে, তার ধারণা দিয়েছেন নাসার গবেষকেরা। তাঁদের মতে, ১৬ সাইকিতে ১০ হাজার কোয়াড্রিলিয়ন (১০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০) লোহা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া আছে নিকেল ও সোনার মতো মূল্যবান সম্পদ। অতি-উৎসাহী কিছু মানুষ এই সম্পদের বাজারমূল্য নির্ধারণ করেছেন। যদি পুরো গ্রহাণুটির সম্পদ পৃথিবীতে নিয়ে আসা যায়, তাহলে পৃথিবীর প্রত্যেকে ১০ হাজার কোটি ডলারের মালিক হবে।

কিন্তু নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই গ্রহাণুকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। তাহলে উপায় কী? আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ইন্টারপ্ল্যানেটারি ইনিশিয়েটিভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সাইকির প্রধান অনুসন্ধানী লেন্ডি এলকিন্স-ট্যান্টন বলছেন, পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানীরা গিয়ে এই সম্পদ নিয়ে আসতে পারেন। এ জন্য গ্রহাণুটিকে প্রথমে চাঁদের পৃষ্ঠে নেওয়া হবে মহাকাশযানের সাহায্যে। তারপর চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে কয়েক ধাপে সম্পদ পৃথিবীতে আনা সম্ভব হতে পারে। তবে কীভাবে পৃথিবীতে এই সম্পদ আসবে, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পারেননি।

ট্যান্টন আরও বলেছেন, ‘সাইকি মিশনে এই গ্রহাণু খুঁজে পাওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। তবে আমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। আমরা গবেষণা করছি, যদিও এই গ্রহাণু থেকে মূল্যবান পদার্থ পৃথিবীতে আনা সহজ হবে না।’

গবেষণার কাজ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হওয়ার কথা ছিল। যেহেতু এই গ্রহাণুতে নিকেল ও লোহা আছে, তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই গ্রহাণু কোনো নক্ষত্রের ছিটকে পড়া অংশ। যদি তা–ই হয়, তাহলে গ্রহাণুটি বিস্তর গবেষণা করে আদি পৃথিবীর ধারণা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ধারণা পাওয়া যাবে আদি নক্ষত্র সম্পর্কেও।

সাইকি মিশনের বাজেট ৮৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গ্রহাণুকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে তিনটি যন্ত্র ব্যবহার করা হবে। একটি মাল্টিস্পেক্ট্রাল ইমেজার, একটি ম্যাগনেট্রোমিটার এবং একটি গামা রশ্মি ও নিউট্রন স্পেকট্রোমিটার। সাইকি মহাকাশযানে ডিপ স্পেস অপটিক্যাল কমিউনিকেশন নামে একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। সাইকি টিমের সদস্যরা বলছেন, এই যন্ত্র ফোটন ব্যবহার করে পৃথিবীতে ডেটা পাঠাবে। বিজ্ঞানীদের দাবি, প্রচলিত রেডিও তরঙ্গ পদ্ধতির চেয়ে এই পদ্ধতি আরও বেশি কার্যকর হবে।

সাইকি মিশনে নাসা ও ইলন মাস্কের প্রাইভেট কোম্পানি স্পেস এক্স যৌথভাবে কাজ করবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২২ সালের আগস্টে স্পেস এক্সের ফ্যালকন হেভি রকে সাহায্যে সাইকি মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করা হবে। ২০২৩ সালের মে মাসে মঙ্গলে ফ্লাইবাই সম্পন্ন করে ২০২৬ সালে ১৬ সাইকি গ্রহাণুর কাছে পৌঁছাবে সাইকি মহাকাশযান। এই সম্পদ আসলেই কি পৃথিবীতে নিয়ে আসা সম্ভব? এই সম্পদ ব্যবহার করে ভাগ্য ফিরবে মানুষের? সময়ই সেই কথা বলে দেবে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: স্পেস ডট কম