আর্দ্রা হবে সুপারনোভা

কিছুদিন ধরে জ্যোতির্বিজ্ঞান মহলে একটি নক্ষত্রকে ঘিরে আলোচনা হচ্ছে। নক্ষত্রটি মূলত একটি লোহিত অতিদানব। হঠাৎ করেই গত কয়েক মাসে ২ দশমিক ৫ গুণ উজ্জ্বলতা হারিয়েছে নক্ষত্রটি। এ ধরনের নক্ষত্রের বেলায় উজ্জ্বলতার এমন কমে যাওয়াকে সুপারনোভায় পরিণত হওয়ার পূর্বাভাস হিসেবে ধরা হয়। নক্ষত্রটির নাম আর্দ্রা বা বেটেলজিউস। কালপুরুষ তারকামণ্ডলের অন্যতম সদস্য আর্দ্রা। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৬৪০ আলোকবর্ষ। ভর প্রায় সূর্যের ১২ থেকে ২০ গুণ। ভর এত বেশি হওয়ায় অনেক আগেই জ্বালানি ফুরিয়ে এটি রূপান্তরিত হয়েছে লোহিত অতিদানব নক্ষত্রে। ১৪ শতক থেকে যেকোনো মুহূর্তে এর সুপারনোভায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যেমনটা রয়েছে এখনো।

প্রতিটি নক্ষত্র মহাকাশের এক একটি শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র। নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় এই বিপুল পরিমাণ শক্তি তৈরি হয়। প্রাথমিক এগুলোর অবস্থায় জ্বালানি, হাইড্রোজেন। আর একটা পর্যায়ে এই জ্বালানি শেষ হয়ে সব নক্ষত্রই পৌঁছায় অন্তিম দশায়।

একটি নক্ষত্রের মৃত্যু কখন এবং কীভাবে হবে, তা নির্ভর করে এর ভরের ওপর। ভর যত বেশি হয়, তত দ্রুত এর জ্বালানি শেষ হতে থাকে। সূর্য বা সূর্যের মতো নক্ষত্রগুলোর হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ হওয়ার পর সরাসরি লোহিত দানবে পরিণত হয়। পরে তা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে শ্বেত বামন হয়ে যায়।

কিন্তু সূর্যের চেয়ে ৮ থেকে ১৫ গুণ ভরের নক্ষত্রের অন্তিম দশা এত সহজে আসে না। ফিউশন বিক্রিয়া চলতেই থাকে। হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম, হিলিয়াম থেকে কার্বন, কার্বন থেকে আরও ভারী মৌলে রূপান্তরিত হয় এসব নক্ষত্রের কেন্দ্র। এরপর একসময় পরিণত হয় লোহিত অতিদানব নক্ষত্রে। এরও প্রায় এক লাখ বছর কিংবা তার বেশি সময় পার হওয়ার পর একটি লোহিত অতিদানব নক্ষত্র, পরে সুপারনোভায় রূপান্তরিত হয়। আমাদের দৃশ্যমান আকাশে এমন লোহিত অতিদানব নক্ষত্র অনেক রয়েছে। তবে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম লোহিত অতিদানবটি হচ্ছে আর্দ্রা!

আর্দ্রা একটি স্পন্দনশীল নক্ষত্র। সে কারণে এর সঠিক ব্যাস ও ভর নির্ণয় করা যায় না। তবে আমরা জানি, ১২ থেকে ২০ সৌর ভরের এটি একটি ভারী নক্ষত্র (massive star)। এ ধরনের নক্ষত্রগুলোর ক্ষেত্রে, যখন এর কেন্দ্রে থাকা সিলিকন ও সালফার ফিউশন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে লোহা, নিকেল ও কোবাল্টে পরিণত হওয়া শুরু করবে। তখন বিস্ফোরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। এ সময় নক্ষত্রটি অতি–অস্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রায় পৌঁছাবে। তবে তখন আর লোহা, নিকেল ও কোবাল্ট ফিউশন করে আর অন্য মৌলে রূপান্তরিত হতে পারবে না। মহাকর্ষ বল তখনো চেষ্টা করবে নক্ষত্রের কেন্দ্রটিকে চেপে আরও সংকুচিত করতে। কিন্তু এই সংকোচন ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন নিউক্লিয়ার ফিউশনের। কিন্তু নক্ষত্রের অভ্যন্তরে যথেষ্ট পরিমাণ বহির্মুখী চাপ না থাকায় এটি মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বলকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ফলে প্রচণ্ডভাবে সংকুচিত হয়ে পড়বে নক্ষত্রটি এবং এর বেশিরভাগ ভরই জমা হবে কেন্দ্রে। পাশাপাশি বাইরেই গ্যাসীয় আবরণটি প্রচণ্ড বেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আর এভাবেই আর্দ্রা পরিণত হবে টাইপ টু সুপারনোভায়।

মানুষের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যতগুলো সুপারনোভার দেখা পাওয়া গেছে, তাদের চেয়ে আর্দ্রার উজ্জ্বলতা হবে বহুগুণ বেশি। কারণ, মাত্র ৬০০ আলোকবর্ষ দূরের কোনো নক্ষত্র এর আগে কখনোই সুপারনোভায় পরিণত হয়নি। সৌভাগ্যক্রমে এই দূরত্বটুকু যথেষ্ট নিরাপদও বটে! এর উচ্চ শক্তি বিকিরণ এই দূরত্বের কারণে পৃথিবীর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারবে না বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

আর্দ্রা সুপারনোভাতে পরিণত হলে এটি হবে চাঁদের পর আকাশের দ্বিতীয় উজ্জ্বলতম বস্তু। তাই শুধু রাতের আকাশেই নয়, আর্দ্রার প্রভাব চোখে পড়বে দিনের আকাশেও। এবং এক বছরের বেশি সময় রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম বস্তু হয়ে থাকবে এটি।

কবে নাগাদ নক্ষত্র আর্দ্রা সুপারনোভাতে পরিণত হবে, এর কোনো সঠিক উত্তর নেই বিজ্ঞানীদের কাছে। এ সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলতে প্রয়োজন অতি শক্তিশালী নিউট্রিনো টেলিস্কোপ, যা আর্দ্রার মতো শত শত আলোবর্ষ দূরের নক্ষত্র থেকে বিকিরিত নিউট্রিনো শক্তি বর্ণালি কার্যকরভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হবে। সে রকম টেলিস্কোপ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই, এটি সুপারনোভা হতে আর কত পথ বাকি।

রাতের আকাশ নিয়ে আমরা যখন গবেষণা করি, তখন আসলে অতীতকে নিয়ে গবেষণা করি। লাখ লাখ আলোকবর্ষ দূরের তারার যে আলো আমরা দেখি, তা ওই তারা থেকে রওনা হয়েছিল লাখো বছর আগে। সেই হিসাবে ৬০০ বছর আগে যদি আর্দ্রা সুপারনোভায় পরিণত হয়ে থাকে, তবে আমরা এটাকে পাব আরও ৪০ বছর পর। তাই ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে এর দেখা মিলতে পারে আমাদের জীবদ্দশাতেই। নয়তো অপেক্ষা করতে হবে আরও শত সহস্র বছর।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা