৪৬ বছর। গত ছেচল্লিশ বছর ধরে নভোযানটি পৃথিবীর গান বুকে নিয়ে ছুটছে মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে। পেরিয়ে গেছে সৌরজগতের সীমা, পাঠিয়েছে বহু তথ্য। সেই ভয়েজার ১ সম্প্রতি তথ্য পাঠাতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। অবশ্য তথ্য গ্রহণ করতে পারছে, তবে নভোযানটির কম্পিউটারে কিছু সমস্যা হয়েছে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
যেকোনো গড়পড়তা মানুষের তুলনায় মধ্যবয়সী বলা চলে, নাকি? মিডলাইফ ক্রাইসিস? আবার ফিরতে পারবে স্বরূপে ভয়েজার ১? জানা নেই এসব প্রশ্নের উত্তর।
নভোযানটির ফ্লাইট ডেটা সিস্টেম বা এফডিএস এর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। তারপর সেটা ঠিকঠাক করে পাঠায় টেলিযোগাযোগ ইউনিট বা টিএমইউতে। টিএমইউ সেটা সম্প্রচারণ করে পৃথিবীতে। এই এফডিএস অংশেই সমস্যা হয়েছে। এ তথ্য জানা গেছে নাসার গত ১২ ডিসেম্বরের ব্লগ পোস্টে। এ পোস্টের তথ্য বলছে, সংকেতটা আটকে গেছে এক জায়গায়। একই প্যাটার্নের শূন্য ও একে লেখা বার্তা পাঠাচ্ছে বারে বারে। ভয়েজারের প্রকৌশলীরা সমস্যা শনাক্ত করতে পারলেও সমাধান করতে পারবে কি না, নিশ্চিত হতে পারেনি। সমাধান করতে পারলেও লেগে যাবে অন্তত কয়েক সপ্তাহ।
ভয়েজার ১ উৎক্ষেপণ করা হয় ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট যাত্রা শুরু করে এর সহোদর ভয়েজার ২। নভোযান দুটি ইতিমধ্যে মহাকাশে কাটিয়েছে ৪৬ বছর, পেরিয়ে গেছে সৌরজগতের সীমা। এই দুই সহোদর মিলে ৪টি গ্রহ, ৪৮টি উপগ্রহ, তাদের চৌম্বকক্ষেত্র এবং বলয় পর্যবেক্ষণ করে সৌরজগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়েছে বিস্ময়করভাবে
তবে এবারই কিন্তু ভয়েজার প্রথমবারের মতো এ ধরনের সমস্যায় পড়েনি। এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সমস্যা হয়েছে, টেলিমেট্রি ডেটায়ও সমস্যা দেখা দিয়েছিল ২০২২ সালের মে মাসে। সেগুলোর সমাধান মিলেছে পরে।
তবে নাসার সেই ব্লগপোস্ট বলছে, এ ধরনের সমাধান পাওয়া বড় কঠিন। কারণ, সে কালের প্রকৌশলীরা এসব সমস্যার কথা ভাবেনওনি। এতদিন পর আগের সব ডকুমেন্ট ঘেঁটে, সেগুলো বারবার যাচাই করে, সে অনুসারে সমাধান বের করা বেশ কঠিন।
ভয়েজার ১ উৎক্ষেপণ করা হয় ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট যাত্রা শুরু করে এর সহোদর ভয়েজার ২। নভোযান দুটি ইতিমধ্যে মহাকাশে কাটিয়েছে ৪৬ বছর, পেরিয়ে গেছে সৌরজগতের সীমা। এই দুই সহোদর মিলে ৪টি গ্রহ, ৪৮টি উপগ্রহ, তাদের চৌম্বকক্ষেত্র এবং বলয় পর্যবেক্ষণ করে সৌরজগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়েছে বিস্ময়করভাবে।
এ নভোযান নিয়ে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত ইবরাহিম মুদ্দাসসেরের ‘ভয়েজার মিশন: মহাকাব্যিক যাত্রায় মানবসভ্যতার নিদর্শন’ থেকে একটা অংশ তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।
‘বৃহস্পতির মাত্র কয়েক লাখ কিলোমিটার ওপর দিয়ে উড়ে যায় ভয়েজার ১। এর পাঠানো ছবি থেকে জানা যায় বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে বয়ে চলা বিশাল বিশাল ঝড়ের কথা। আরও চমৎকৃত হতে হয়, যখন এর পাঠানো তথ্যেই জানা যায় সৌরজগতের মুকুট শনির বলয়ের মতো বলয় আছে বৃহস্পতিরও। তবে এ দফায় সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য ছিল বৃহস্পতির সবচেয়ে ভেতরের উপগ্রহ আইয়ো সম্পর্কে। গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা চারটি গ্যালিলিয়ান উপগ্রহের একটি এই উপগ্রহ আইয়োতে দেখা যায় সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। পৃথিবীর বাইরে প্রথমবারের মতো জানা যায় আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব। শুধু তা-ই নয়, পর্যবেক্ষণ করা ৯টি আগ্নেয়গিরির কোনোটার গতি ছিল এত বেশি যে তার লাভা পৌঁছে যাচ্ছিল ৫০০ কিলোমিটার ওপরে।
সালফারের আধিক্য থাকা এই লাভার উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের নতুন চিন্তার খোরাক দিয়েছিল আশির দশকে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য প্রায় ৪০০ সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আবিষ্কৃত হয়েছে এই উপগ্রহে, এটি পেয়েছে সৌরজগতের সবচেয়ে সক্রিয় ভূপ্রকৃতির মর্যাদা।’
এটিই সৌরজগতের সীমা পেরিয়ে যাওয়া মানবনির্মিত প্রথম বস্তু। ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট পেরিয়ে গেছে সৌরজগতের হেলিওপজ অঞ্চল। সূর্য তার চারপাশের যেটুকু অঞ্চলে আয়নিত প্লাজমা কণা ছড়িয়ে দেয়, তার শেষ সীমা, অর্থাৎ সৌরজগতের সীমানা এটিই।
এই ভয়েজার নভোযানে রয়েছে গোল্ডেন রেকর্ড। এতে রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন শব্দ ও ছবি। দেওয়া আছে মানবসভ্যতার কিছু নিদর্শন। নির্দেশ করা আছে বিভিন্ন পালসারের অবস্থানের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান। রেকর্ডের সঙ্গে চালানোর নির্দেশনাও দেওয়া আছে। এই রেকর্ড তৈরি করা হয়েছে স্বর্ণ দিয়ে। এ জন্যই অমন নাম, গোল্ডেন রেকর্ড। এর ওপর দিয়ে দেওয়া হয়েছে ইউরেনিয়াম-২৩৮, যাতে গোল্ডেন রেকর্ডের বয়স কত হলো তা বিশ্লেষণ করা যায় গোল্ডেন রেকর্ড থেকেই। কারণ, ইউরেনিয়াম-২৩৮ এর অর্ধজীবন শতকোটি বছর।
সেই ভয়েজারের বার্তাপ্রেরণ যখন থমকে যায়, তখন বিষন্নতাবোধে আচ্ছন্ন হওয়াই স্বাভাবিক।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, নাসা
বিজ্ঞানচিন্তা/ভয়েজার মিশন: মহাকাব্যিক যাত্রায় মানবসভ্যতার নিদর্শন, ইবরাহিম মুদ্দাসসের