মঙ্গল গ্রহের আকাশ

পৃথিবীর রাতের আকাশে মঙ্গল গ্রহ থাকলে আনাড়ি চোখও একে সহজেই চিনে ফেলে। এমন লাল আর কিছুই যে নেই রাতের আকাশে! বেটলজিউস, অ্যান্টারিস নক্ষত্ররাও লাল। তবে মঙ্গলের কাছে কিছুই নয়। কিন্তু মঙ্গল সব সময় একই রকম উজ্জ্বল থাকে না। একসময় উজ্জ্বল হতে হতে পৃথিবীর আকাশে সব নক্ষত্রের চেয়েও উজ্জ্বল হয়ে যায়। রাতের আকাশে এর চেয়ে বেশি উজ্জ্বল থাকে শুধু চাঁদ (যখন থাকে আরকি) আর শুক্র।

২০১৮ সালের জুলাই ও তার আশপাশের মাসগুলোতে মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীর আকাশে খুব উজ্জ্বল ছিল। এ সময় কোনো তারাও পৃথিবীর আকাশে এতটা উজ্জ্বল ছিল না। ২০১৯ সালে কিন্তু মঙ্গল খুব অনুজ্জ্বল। ২০২০–এর জুনের দিকে আবারও উজ্জ্বল হওয়া শুরু করে। দেখা দিতে শুরু করে ভোরের আকাশে। শিগগিরই এটি উদিত হবে মধ্যরাতে। এবং ক্রমেই সন্ধ্যার পরেই। অক্টোবরে তো মঙ্গল হবে বৃহস্পতির চেয়েও উজ্জ্বল।

কিন্তু কেন? কেন উজ্জ্বলতার এত তারতম্য?

প্রথম কথা হলো, মঙ্গল গ্রহ খুব বেশি বড় নয়। পৃথিবীর অর্ধেকের চেয়ে একটুখানি বেশি চওড়া। ব্যাসার্ধ ৪ হাজার ২১৯ মাইল বা ৬ হাজার ৭৯০ কিমি। এ কারণে বৃহস্পতির মতো একইভাবে এর উজ্জ্বলতার পরিবর্তন ঘটে না। বৃহস্পতি উজ্জ্বল থাকে আকার বড় হওয়ার কারণে। আর মঙ্গলকে উজ্জ্বল লাগে পৃথিবীর কাছে এলে। সূর্যের চারদিকে মঙ্গলের কক্ষপথটা পৃথিবীর পরেই। দুটি গ্রহই সূর্যের চারপাশে কক্ষপথে চলে। কখনো তারা সূর্যের একই পাশে খুব কাছাকাছি থাকে। অনেক সময় তারা থাকে দুই পাশে। ফলে দূরত্ব হয় সবচেয়ে বেশি।

সূর্যকে একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর লাগে এক বছর। মঙ্গলের লাগে প্রায় দুই বছর। তার মানে প্রায় দুই বছর পরপর দুটি গ্রহ কাছাকাছি আসে। ফলে পৃথিবীর আকাশে মঙ্গল উজ্জ্বলও হয় প্রায় প্রতি দুই বছর পরপর। উজ্জ্বলতা আরও বেড়ে যায়, যদি গ্রহ দুটি কাছাকাছি থাকার সময় পৃথিবী মঙ্গল ও সূর্যের মাঝখানে একই রেখা বরাবর চলে আসে। জ্যোতির্বিদ্যায় এ ধরনের ঘটনার নাম অনুসূরীয় প্রতিযোগ (perihelic opposition)। ২০১৮ সালে এটাই হয়েছিল। আমরা চলে যাই পৃথিবী ও মঙ্গলের মধ্যে। আর একই সময় মঙ্গল ছিল সূর্যের সবচেয়ে কাছে। মানে অনুসূর (perhelion) অবস্থানে। এমনটি আবার ঘটবে ২০২০ সালের অক্টোবরে। এ কারণেই মঙ্গলের এমন উজ্জ্বল হওয়া।

পৃথিবীর আকাশ নীল। বায়ুমণ্ডল আছে মঙ্গলের আকাশেও। তবে সেটা খুবই চিকন। বায়ুমণ্ডলে আছে প্রচুর ধুলা। সে কারণে পৃথিবীর আকাশের মতোই আলোর বিক্ষেপণ হয়। মানে ধুলায় ধাক্কা খেয়ে আলো ছড়িয়ে পড়ে সব দিকে। এ কারণে দিনের আকাশ পৃথিবীর মতো এতটা উজ্জ্বল না হলেও ভালোই উজ্জ্বল। তারাও দেখা যায় না দিনে।

মঙ্গলের আকাশের রং নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়ে যান। এর কারণ স্পষ্ট। নাসা বা অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভিডিওতে অনেক সময় মঙ্গলের আকাশকে সাদা বা অন্য রঙে দেখা যায়। তবে আসল রং কিন্তু সাদা নয়। আর মঙ্গলের পৃষ্ঠ থেকে আসলে আকাশ কেমন দেখায়, সেটা জানা সহজও নয়। এ ক্ষেত্রে বড় একটি অসুবিধা করে পারকিঞ্জি ইফেক্ট। সোজা বাংলায় এর মানে হলো: বাহ্যিক আলোর তারতম্যের কারণে লাল গোলাপকেও ক্রমেই কালো দেখায়। মানুষের চোখে আলোর প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে বাহ্যিক আলোর ওপর। মঙ্গলেও এটা হয়। তার ওপর আবার নীলের চেয়ে লাল আলো বাহ্যিক আলোর অনুপস্থিতিতে বেশি দ্রুত কালো হয়।

নানা কারণে তাই মঙ্গলের প্রকাশিত ছবিতে পার্থক্য দেখা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব ছবিতে ফিল্টারিং করে রং পাল্টে ফেলা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো ছবির বৈজ্ঞানিক মান বাড়ানো। সঠিক রং দেখানোর বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা খুব বেশি নেই।

সঠিক রং নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে বিভ্রান্তি থাকলেও এখন বিজ্ঞানীরা লাল গ্রহটির আকাশের সঠিক রং জানেন। দিনের বেলায় এই রং হলো মাখন ও চিনি দিয়ে তৈরি খাবার বাটারস্কচের মতো (চিত্র ১)। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় রং হয় রোজ বা গোলাপের মতো। আরও সঠিক করে বললে ম্যাজেন্টা ও লালের মাঝামাঝি। তবে সূর্য যেখান দিয়ে অস্ত যায়, সেদিকে আবার আকাশ হয় নীল। ব্যাপারটা কিন্তু পৃথিবীর উল্টো।

মঙ্গলের আকাশের অবস্থা নির্ভর করে এর মহাকর্ষের ওপরও। মহাকর্ষ তো পৃথিবীর চেয়ে কম। প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। তাই বায়ুমণ্ডল চিকন হলেও বিস্তৃত কিন্তু অনেক ওপর পর্যন্ত। আর এ কারণে সূর্য অস্ত যাওয়ার অনেকক্ষণ পরও ধুলায় প্রতিফলিত সূর্যের আলোর রেশ চলে আসে ভূমিতে। সে জন্য মঙ্গলে গোধূলি থাকে দীর্ঘ সময়।

মঙ্গলের সূর্যকে পৃথিবীর আকাশের সূর্যের ৮ ভাগের ৫ ভাগ দেখায়। সূর্যের আলো আসে ৪০ ভাগ। পৃথিবীর আকাশে মেঘ থাকলে যেমন হয়, মঙ্গলের নৈমিত্তিক আকাশও তেমন।

মঙ্গলের রাতের আকাশেও পৃথিবীকে দেখা যায়। তবে নিঃসঙ্গ বস্তু হিসেবে নয়, দেখা যায় যুগল তারার মতো। আরেকটি ‘তারা’ আমাদের চাঁদ। দুটি বস্তুর সর্বোচ্চ দৃশ্যমান কৌণিক দূরত্ব প্রায় ২৫ ডিগ্রি। মঙ্গল ও পৃথিবী সূর্যের দুই বিপরীত পাশে থাকলে এমনটা দেখা যায়। ২০১৬ সালে মঙ্গলে পাঠানো যান ম্রো (মার্স রিকনিসিনস অরবিটার) মঙ্গল থেকে পৃথিবী ও চাঁদের যুগল ছবি তোলে। তার আগেই ২০১৪ সালে অবশ্য রোভার কিওরিওসিটি মঙ্গলের বুকে থেকেই এমন ছবি তোলে। মঙ্গলের আকাশে পৃথিবী ও চাঁদের আপাত–উজ্জ্বলতা যথাক্রমে -২.৫ ও +০.৯। উল্লেখ্য, পৃথিবীর আকাশে মঙ্গল ও বৃহস্পতির সর্বোচ্চ উজ্জ্বলতা -২.৯৪। ন্যূনতম উজ্জ্বলতা অবশ্য মঙ্গলের অনেক কম। মনে রাখতে হবে আপাত–উজ্জ্বলতার ক্ষেত্রে মান ছোট হলে উজ্জ্বলতা বেশি বোঝায়। মঙ্গল থেকে শুক্র গ্রহকেও দেখা যায়। আপাত–উজ্জ্বলতা -৩.২।

পৃথিবীর আকাশের মতোই মঙ্গলের আকাশেও আছে একটি ধ্রুবতারা। পৃথিবীর আকাশের ধ্রুবতারাটির নাম পোলারিস। যদিও আমরা এখন পোলারিসকে ধ্রুবতারা হিসেবে চিনি, আসলে কিন্তু ধ্রুবতারা একেক সময় একেক তারা হতে পারে। পৃথিবীর মেরু অঞ্চল থেকে ঠিক মাথার ওপরের যে তারাটি রাতের আকাশের অন্য তারাদের মতো পশ্চিমে সরে না, সেটিই ধ্রুবতারা। দেখে মনে হয়, অন্য তারারা বুঝি একে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। আসলে পৃথিবী নিজের অক্ষের চারপাশে আবর্তন করছে বলেই এমন মনে হয়। আর দুই মেরু যে পৃথিবীর অক্ষরেখার দুই প্রান্ত।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ সাল থেকে ৩০০ সালের কিছুদিন পর পর্যন্ত কোচাব ও ফেরকাড নক্ষত্র দুটি ছিল পৃথিবীর উত্তর আকাশের যমজ ধ্রুবতারা। তাত্ত্বিকভাবে ধ্রুবতারা হওয়া উচিত দুটি—উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর সোজা ওপরে আকাশে। তবে বাস্তবে শুধু পৃথিবীর উত্তর মেরুর ওপরেই একটি উজ্জ্বল তারা আছে। নাম পোলারিস। আরও কেতাবি নাম আলফা আরসা মাইনোরিস। সপ্তর্ষীমণ্ডলের একটি তারা। দক্ষিণ মেরুর ওপরের কাছাকাছি জায়গায়ও একটি তারা আছে। বেশ অনুজ্জ্বল। নাম পোলারিস অস্ট্রালিস।

মঙ্গলেও আছে একটি উত্তর ধ্রুবতারা। নাম ডেনেব বা পুচ্ছ। পৃথিবীর আকাশেও তারাটিকে দেখা যায়। পরিচিত তারাভুজ সামার ট্রায়াঙ্গেল বা গ্রীষ্মের ত্রিভুজের তিন তারার একটি এটি। অবশ্য মঙ্গলের প্রকৃত মেরু আলডেরামিন (আলফা সিফিয়াই) নক্ষত্রের বেশি কাছে। সিগনাসমণ্ডলের ওপরের দিকে দুটি নক্ষত্র সদর ও পুচ্ছ নিয়ে আঁকা রেখা বরাবর মঙ্গলের উত্তর মেরু বলাটাই বেশি ভালো। দক্ষিণ মেরুর দিকেও আছে একটি তারা। কাপ্পা ভেলোরাম নক্ষত্রটি দক্ষিণ মেরুর সোজা ওপর থেকে মাত্র কয়েক ডিগ্রি ব্যবধানেই আছে!

মঙ্গলের আছে দুটি চাঁদ। তবে এদের আচরণ আমাদের চাঁদ থেকে ভিন্ন। ফোবোস ওঠে পশ্চিমে। ডোবে পূর্বে। ১১ ঘণ্টা পরই আবার ওঠে। মানে এক দিনেই দুবার উদিত হয়। উল্লেখ্য, মঙ্গলে ১ দিন ২৪ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড। ডিমোস ওঠে পূর্ব দিকে। ফোবোসকে আমাদের চাঁদের তিন ভাগের এক ভাগের মতো লাগে। তবু পৃষ্ঠে ছায়া ফেলার মতো যথেষ্ট উজ্জ্বল এর প্রতিফলিত আলো। ডিমোসকে সাধারণ তারার মতোই লাগে। পৃথিবীর চাঁদের মতো দুটি উপগ্রহের দশা পরিবর্তন হয়। তবে ডিমোস ছোট হওয়ার ক্ষেত্রে সেটা বোঝা যায় না। মজার ব্যাপার হলো এক দিনের দশার পরিবর্তন ধরা পড়ে। যেটা আমাদের চাঁদের ক্ষেত্রে হয় না। মঙ্গলে বসে চাঁদ দুটির গ্রহণও দেখা সম্ভব।

পৃথিবীর মতোই মঙ্গলেও মাঝেমধ্যে ধূমকেতুর দেখা মেলে। দেখা যায় উল্কাপাতও।

লেখক: প্রভাষক, পরিসংখ্যান বিভাগ, পাবনা ক্যাডেট কলেজ

সূত্র: আর্থস্কাই ডট অর্গ, একনেন্ট ডট কম, প্ল্যানেটারি ডট অর্গ