আলবার্ট আইনস্টাইনের শেষ নিশ্বাস ও থিওরি অব এভরিথিং

শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। দিনটি ছিল ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল। মৃত্যুশয্যায় তাঁর পাওয়া গেল একটি খাতা। দেখা গেল, জীবনের শেষ সময়টুকুতেও তিনি কাজ করছিলেন সমন্বিত ক্ষেত্রতত্ত্ব নিয়ে। সেই তত্ত্বটিই আজ থিওরি অব এভরিথিং নামে পরিচিত। বিশ শতকের অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানী কী ভেবেছিলেন এ তত্ত্ব নিয়ে? তাঁর প্রচেষ্টা ও থিওরি অব এভরিথিংয়ের কথা...

১৯৫৫ সাল। ১৭ এপ্রিল। রোববার সকাল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন হাসপাতাল।

হাসপাতালের এক বিছানায় জবুথবু হয়ে বসে আছেন অসুস্থ আলবার্ট আইনস্টাইন। বিজ্ঞান জগতের সুপারস্টার। হাতে ধরা কাগজ-কলম। মৃত্যুশয্যাতেও বিজ্ঞানের প্রতি আজন্ম ভালোবাসা কমেনি একরত্তি। জীবনের শেষ মুহূর্তেও বিজ্ঞানের জটিল হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত।

পরিচ্ছন্ন হাতের লেখায় লাইনের পর লাইন বীজগাণিতিক হিসাব কষছেন। তবে অসুস্থতার কারণে কিছুক্ষণেই হাঁপিয়ে উঠলেন। খাতা-কলম পাশে রেখে একসময় বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। সেদিনই রাতের দিকে বিড়বিড় করে মাতৃভাষা জার্মানে কী যেন বললেন। সেটাই ছিল তাঁর শেষ কথা। তারপরই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় আইনস্টাইনের। পরদিন সকালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন বিশ শতকের অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানী। দুর্ভাগ্য, ডিউটিতে থাকা নার্স জার্মান ভাষা জানতেন না। তাই জানা গেল না, আইনস্টাইন মৃত্যুশয্যায় কী কথা বলেছিলেন। তবে তাঁর মৃত্যুশয্যায় পড়ে থাকা সেই খাতা পরীক্ষা করে দেখা গেল, জীবনের শেষ সময়টুকুও তিনি ব্যয় করেছেন 'ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি' নিয়ে। বাংলায় যাকে বলা যায় ‘সমন্বিত ক্ষেত্রতত্ত্ব’।

পরদিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান দৈনিকে তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছাপা হলো বেশ গুরুত্বের সঙ্গে। কেউ কেউ ছাপল তাঁর ডেস্কের একটা ছবিও। ডেস্কটার ঠিক পেছনেই হিজিবিজি সমীকরণে ভর্তি একটা ব্ল্যাকবোর্ড। ছবির ক্যাপশনে লেখা: এই ডেস্কেই রয়েছে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের খসড়া। কিন্তু সেটি অসমাপ্ত।

আইনস্টাইনের এলোমেলো ডেস্ক

ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরির কথাই বলা হলো সেখানে। এ তত্ত্বের মাধ্যমে আসলে জীবনের সুদীর্ঘ ৩০ বছর মহাবিশ্বের জানা সব বল একত্র করে একটি একক ব্যাখ্যা হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন আইনস্টাইন। বলা বাহুল্য, ব্যর্থ হন তিনি। আইনস্টাইনের স্বপ্ন ছিল, চূড়ান্ত তত্ত্বটি মহাবিশ্বের বলগুলোর ব্যাখ্যা দিতে পারবে। শুধু তা–ই নয়, যে কণার ওপর ওই বলটি ক্রিয়াশীল, তারও ব্যাখ্যা দিতে পারবে এবং স্থান ও কালের প্রকৃতির ব্যাখ্যাও দিতে পারবে। বর্তমানে আইনস্টাইনের স্বপ্নের সেই তত্ত্বের পোশাকি নাম থিওরি অব এভরিথিং বা সার্বিক তত্ত্ব।

মজার ব্যাপার হলো, থিওরি অব এভরিথিং শিরোনামটা বিজ্ঞানজগতে পাকাপাকি আসন পাতলেও এর উৎপত্তি এক সায়েন্স ফিকশন গল্প থেকে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে একটা সাইফাই গল্প লেখেন বিজ্ঞানী মেরি কুরির দেশি ভাই স্টেইনসল লেম। পোলিশ সেই গল্পেই এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছিল প্রথমবার। এরপর ১৯৭৭ সালে জার্মান পদার্থবিদ হ্যারল্ড ফ্রিৎজ শব্দটি এক লেকচারে ব্যবহার করেন। পরের দশকে শব্দগুচ্ছটি জায়গা পায় বিখ্যাত নেচার জার্নালে। তারপর থেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানজগতে জনপ্রিয় উঠতে শুরু করে এটি। আর এখন তো স্টিফেন হকিং থেকে শুরু করে হালের সব তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী বা অধ্যাপক সবকিছুর ফাইনাল বা চূড়ান্ত তত্ত্ব বোঝাতে এ শব্দগুচ্ছের দিকে হাত বাড়ান হরহামেশা।

মোটা দাগে বললে, থিওরি অব এভরিথিং বলতে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বকে একীভূত করে একটিমাত্র তত্ত্বে প্রকাশ করা বোঝায়। সে কথা বিস্তারিত বলার আগে আরও কিছু কথা শুনুন।

১৯১৫ সালের শেষ দিকে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেন আইনস্টাইন। এরপর অনেকে আইনস্টাইনের পিঠ চাপড়ে দিল বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। শুধু তো তত্ত্ব প্রকাশ করলেই চলবে না, তার সপক্ষে প্রমাণ কই? প্রমাণও এসে গেল কিছুদিন পর। ১৯১৯ সালে সাধারণ আপেক্ষিকতার এক চমকপ্রদ প্রমাণ হাজির করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন। মহাকর্ষের প্রভাবে বক্র স্থানকালে আলোর বেঁকে যাওয়া। সূর্যগ্রহণ থেকে তার প্রমাণ মিলল। তারপরই বিশ্বের প্রধান প্রধান দৈনিকে মূল শিরোনামে ঠাঁই পান আইনস্টাইন। রাতারাতি বিখ্যাত হলেন তিনি। ১৯২১ সালে পেলেন নোবেল পুরস্কার। তবে সেটা আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কারণে নয়, ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট বা আলোক তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যার কারণে। কিন্তু নোবেল পুরস্কার বলে কথা। তাই স্বভাবত খ্যাতির উত্তাপ পোহাতে থাকেন আইনস্টাইন। দেশে-বিদেশে সভা-সেমিনার করে বেড়ালেন বেশ কিছুদিন। কয়েক বছর এভাবে চলার পর হঠাৎ ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি প্রণয়নের জন্য উঠেপড়ে লাগেন। সেটাই একসময় হয়ে উঠল তাঁর ধ্যানজ্ঞান, প্রেম।

জেনে হয়তো খুশি হবেন, আমাদের লন্ডনের প্রধান একটি দোকানের জানালায় আপনার গবেষণাপত্রের (ছয় পৃষ্ঠা) লটকে দেওয়া হয়েছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পথচারীরা যাতে সবটুকু পড়তে পারেন, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। এটা পড়ার জন্য বিপুল লোকসমাগম হয়

তারকা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের প্রতি তখন নিয়মিত নজর রাখছিল বিজ্ঞানী–সমাজ এবং গণমাধ্যম। ফিল্ড থিওরি ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে খবরের কাগজে আরেকবার প্রধান শিরোনামে পরিণত হবেন, তা বলা বাহুল্য। তাই সাংবাদিকেরা বলতে গেলে তাঁর পেছনে আঠার মতো লেগে থাকতেন। সেসবে মাঝেমধ্যে বিরক্ত হতেন আইনস্টাইন। ১৯২৮ সালে নিউইয়র্ক টাইমস চটকদার হেডলাইন করেছিল, ‘আইনস্টাইন অনেক বড় আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে; অনুপ্রবেশে ক্ষুব্ধ’। এ খবর গণমাধ্যমে থিওরি অব এভরিথিং নিয়ে সাধারণের উন্মাদনা উসকে দিল। শিরোনামে বেশ জোরের সঙ্গে বলা হলো, ‘তত্ত্ব সম্পর্কে আলোড়ন দেখে আইনস্টাইন বিস্মিত। এক সপ্তাহ ধরে সাগরতীরে ১০০ সাংবাদিক অপেক্ষমাণ।’ এ খবরে বোঝা যায়, আইনস্টাইনের সংবাদমূল্য তখন কতটা।

আসলে সে সময় বার্লিনে তাঁর বাড়ির চারপাশে দঙ্গল বেঁধে ছিলেন কয়েক শ সাংবাদিক। এই জিনিয়াস বিজ্ঞানীকে শুধু একঝলক দেখার জন্য এবং একটা চটকদার শিরোনাম বাগাতে নিদ্রাহীনভাবে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা। তাঁদের কাছ থেকে বাঁচতে সেবার আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন আইনস্টাইন। আইনস্টাইনকে এডিংটন লিখলেন, ‘জেনে হয়তো খুশি হবেন, আমাদের লন্ডনের প্রধান একটি দোকানের জানালায় আপনার গবেষণাপত্রের (ছয় পৃষ্ঠা) লটকে দেওয়া হয়েছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পথচারীরা যাতে সবটুকু পড়তে পারেন, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। এটা পড়ার জন্য বিপুল লোকসমাগম হয়।’

আলবার্ট আইনস্টাইন

এই এডিংটন নিজেও ১৯২৩ সালে তাঁর নিজের আরেকটা ক্ষেত্রতত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন। সেটি নিয়ে ১৯৪৪ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে গেছেন তিনি। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ। শুধু আইনস্টাইন কিংবা এডিংটন নয়, ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরির মোহ থেকে বাঁচতে পারেননি বিশ শতকের পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীও। একটি ঐক্যবদ্ধ ফিল্ড থিওরি প্রণয়নে আদাজল খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন অনেকে।

১৯৩০-এর দশকের দিকে কোয়ান্টাম বিড়ালের খপ্পর থেকে এ তত্ত্বের ভূতের আসর পড়েছিল আরউইন শ্রোডিঙ্গারের ওপর। দীর্ঘদিন পর ১৯৪৬ সালে তিনিও একটা কিছু আবিষ্কার করে বসেন। সেটাকে বহুল আলোচিত ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি বলে মনে হয়েছিল তাঁর। আমজনতাকে জানাতে অস্বাভাবিক এক কাজ করে বসেন তিনি। একটা প্রেস কনফারেন্স ডাকেন শ্রোডিঙ্গার। ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইমোন ডি ভ্যালেরা। শ্রোডিঙ্গারকে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করলেন, শেষ পর্যন্ত ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি আবিষ্কার করতে পারার ব্যাপারে তিনি কতটা নিশ্চিত? উত্তরে আত্মবিশ্বাসী শ্রোডিঙ্গার বললেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমি সঠিকই আছি।’

এই সংবাদ সম্মেলনের খোঁজ পেয়ে নিউইয়র্ক টাইমস পাণ্ডুলিপি জোগাড় করে তা আইনস্টাইন ও অন্যদের কাছে পাঠায় মন্তব্যের আশায়। সব খুঁটিয়ে দেখে আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন, আসলে পুরোনো একটা তত্ত্ব নতুন করে আবিষ্কার করে বসেছেন শ্রোডিঙ্গার। সেই তত্ত্ব তিনি নিজেই অনেক আগে প্রস্তাব করেছিলেন। সেটা তখন নাকচও হয়ে গিয়েছিল। আইনস্টাইন ভেতরে-ভেতরে বেশ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হলেও বেশ ভদ্রভাবে প্রতিক্রিয়া জানালেন। তবু বেশ অপমানিত হন শ্রোডিঙ্গার। অবশেষে নিজের ভুল বুঝে এ কাজে ক্ষান্ত দেন তিনি।

ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের সবচেয়ে কঠোর সমালোচক ছিলেন পদার্থবিদ উলফগ্যাং পাউলি। আইনস্টাইনকে তিরস্কার করে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর যা ছিন্ন করেছেন, তা কোনো মানুষের একত্র করার সাধ্য নেই।’ যেকোনো অর্ধসমাপ্ত তত্ত্বকে তিনি নির্দয়ভাবে বিদ্রূপ করে বলতেন, ‘এটা এমনকি ভুলও নয়।’ সেই তিনিই কিনা ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের জ্বরে আক্রান্ত হলেন। তাতে শুধু আইনস্টাইন কেন, কারোরই অবাক না হয়ে উপায় রইল না। অবশ্য তিনি একা নন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন অনিশ্চয়তার নীতির জনক বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। ১৯৫০-এর দশকে তাঁদের যৌথ ঐক্যবদ্ধ ক্ষেত্রতত্ত্বের প্রস্তাব করেন পাউলি।

১৯৫৮ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে হাইজেনবার্গ-পাউলি একীভূত তত্ত্ব উত্থাপন করেন তিনি। দর্শকসারিতে সেদিন বসেছিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের গডফাদার পদার্থবিদ নিলস বোর। কিন্তু তিনিও মুগ্ধ হতে পারলেন না। কারণ, তত্ত্বটা তাঁর কাছে খুবই উদ্ভট বলে মনে হচ্ছিল। সেটা আর যা–ই হোক, কোনো ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি হওয়ার যোগ্য নয়। একসময় আর সহ্য করতে পারলেন না বোর। চরম বিরক্তিতে চট করে উঠে দাঁড়ালেন। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে বোর বলে বসলেন, ‘পেছনে বসে থাকা আমরা নিশ্চিত হয়েছি, তোমার তত্ত্বটি বেশ উদ্ভট। কিন্তু তত্ত্বটি যথেষ্ট উদ্ভট কি না, তা নিয়ে আমরা দ্বিধাবিভক্ত।’

নিলস বোর কী বলতে চাইছেন, তা বুঝতে আর বাকি রইল না পাউলি-হাইজেনবার্গের। সমালোচনাটি ছিল এক বিপর্যয়ের মতো। কারণ, এর আগে নিশ্চিত দাবি করা সব কটি তত্ত্ব একে একে বাতিল করা হয়েছিল। তাই সত্যিকার একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্বটিকে অবশ্যই অতীতের তত্ত্বগুলো থেকে আলাদা কিছু হতে হবে। কিন্তু হাইজেনবার্গ-পাউলির তত্ত্বটি এতই গতানুগতিক ছিল যে তা কোনোভাবেই ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি হতে পারে না।

সে বছরেই পাউলিকে বাদ দিয়ে একাই আরেকটা ক্ষেত্রতত্ত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন হাইজেনবার্গ। সে সম্পর্কে রেডিওতে এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করলেন, তাঁদের তত্ত্বে শুধু কয়েকটি তাত্ত্বিক বিবরণ যোগ করা বাকি আছে। তা শুনে পাউলি বেশ বিরক্ত হন। পাউলি তাঁর বন্ধুকে ফাঁকা আয়তক্ষেত্র এঁকে চিঠি পাঠান। তাতে ক্যাপশন লেখা ছিল, ‘বিশ্ব দেখুক, আমি ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী টিটিয়ানের মতো আঁকতে পারি। এখানে শুধু তাত্ত্বিক বিবরণ নেই।’

আবার আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হতে থাকে নিত্যনতুন কণা। তাতে একটা পুরো বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়েছিল মৌলিক কণাপদার্থবিজ্ঞান।

কিন্তু বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী হয়েও সবাই একে একে ব্যর্থ হলেন কেন? তাঁদের ব্যর্থতার কারণ এখন স্পষ্ট বোঝা যায়। আসলে আইনস্টাইন যে সময় ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন মহাবিশ্বকে শাসন করা প্রাকৃতিক বল মাত্র দুটি বলে ধারণা করা হতো। সেগুলো মহাকর্ষ ও বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল। কিন্তু আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর একে একে উদ্‌ঘাটিত হলো প্রকৃতির আরও কিছু রহস্য। দেখা হলো, মহাকর্ষ আর বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলই শেষ কথা নয়, পরমাণুর গহিনে লুকিয়ে আছে আরও দুটি প্রাকৃতিক বল। সেগুলো হলো সবল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। তাই তাদের বাদ দিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ বা চূড়ান্ত তত্ত্ব দাঁড় করানো সোনার পাথরবাটির মতো। মোটেও সহজ কম্ম নয়। সে কারণে ১৯৫০ সালের দিকে একটা একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্বের লক্ষ্য চরম হতাশাজনক বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক।

আবার আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হতে থাকে নিত্যনতুন কণা। তাতে একটা পুরো বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়েছিল মৌলিক কণাপদার্থবিজ্ঞান। পদার্থের মৌলিক গাঠনিক উপাদান খুঁজতে অ্যাটম স্ম্যাশার দিয়ে নিউক্লিওকে ছিন্নভিন্ন করতে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কণাপদার্থবিদেরা। এভাবে শতাধিক কণার জঙ্গল খুঁজে পাওয়া গেল। এসব কারণে মৌলিক কণাপদার্থবিজ্ঞান হয়ে ওঠে পরিভাষাগতভাবে পরস্পরবিরোধী। যেন একটা কসমিক জোক। গ্রিকরা ধারণা করেছিল, কোনো বস্তুকে যতই তার মৌলিক এককে ভাঙা হবে, ততই সরলতর হবে সেটা। কিন্তু এসব বিজ্ঞানীর কৃতকর্মে বাস্তবে ঘটতে লাগল তার উল্টোটা। আবিষ্কৃত কণার জন্য গ্রিক বর্ণমালা থেকে অক্ষর খুঁজতে হয়রান হতে হচ্ছিল পদার্থবিদদের। তাই তো মার্কিন পরমাণু বোমার জনক জে রবার্ট ওপেন হাইমার একবার রসিকতা করে বলেছিলেন, চলতি বছর যে পদার্থবিদ নতুন কোনো কণা আবিষ্কার করবেন না, তাঁকেই নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত। আরেক বিজ্ঞানী তো নতুন কণা খুঁজে পেলে ওই বিজ্ঞানীকে জরিমানা করারও প্রস্তাব দিয়ে বসেছিলেন।

যাহোক, পদার্থ ও শক্তির প্রকৃতি নিয়ে দুই হাজার বছর তদন্তের পর মাত্র চারটি মৌলিক বলই যে এই মহাবিশ্বকে শাসন করছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হন পদার্থবিদেরা। প্রথম বলটি হলো মহাকর্ষ। এ বলটি সূর্যকে একত্রে ধরে রেখেছে। পাশাপাশি গ্রহগুলোকে সৌরজগতে তাদের নিজ নিজ কক্ষপথে নিয়ন্ত্রণ করছে। মহাকর্ষ যদি হুট করে অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে মহাকাশের নক্ষত্রগুলো বিস্ফোরিত হবে। খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে আমাদের প্রিয় পৃথিবীও। আবার আমরা বাইরের মহাকাশে ঘণ্টায় প্রায় এক হাজার মাইল বেগে ছিটকে পড়ব।

দ্বিতীয় বলটি হলো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বা বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল। এ বলের কারণে বিভিন্ন শহর আলোকিত হয়। আবার পুরো বিশ্বে এখন টিভি, সেলফোন, রেডিও, লেজার রশ্মি ও ইন্টারনেটে ভরে গেছে এ বলের কারণেই। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে সভ্যতা তাত্ক্ষণিকভাবে এক শতক বা দুই শতক পেছনের অন্ধকার আর নীরবতায় নিক্ষিপ্ত হবে। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল আণুবীক্ষণিকভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, এটা একধরনের অতি ক্ষুদ্র কণা বা কোয়ান্টা দিয়ে গঠিত। এ কণাকে বলা হয় ফোটন।

মহাবিস্ফোরণের অতি অল্প সময় পর বলগুলো একে একে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। তাই মহাবিশ্বকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে, আদিম মুহূর্তের মতো করে চারটি বলকে একত্র করে বুঝতে হবে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন

তৃতীয় বলটির নাম উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স বা দুর্বল পারমাণবিক বল। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের জন্য দায়ী এই বল। পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ধরে রাখার মতো দুর্বল বল যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। তাই পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে যায় বা ক্ষয় হয়। হাসপাতালে নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভীষণভাবে এই নিউক্লিয়ার বলের ওপর নির্ভর করে। তেজস্ক্রিয় পদার্থের মাধ্যমে পৃথিবীর কেন্দ্রকে উষ্ণ রাখতেও সহায়তা করে দুর্বল বল। ফলে অতি শক্তিশালী আগ্নেয়গিরি নিয়ন্ত্রণে থাকে। দুর্বল বলের ভিত্তি ইলেকট্রন ও নিউট্রিনোর মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া। নিউট্রিনো একধরনের ভুতুড়ে কণা, যারা প্রায় ভরহীন। এ কণা কোনো কিছুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া না করেই ট্রিলিয়ন মাইল পুরু কঠিন সিসার দেয়াল ভেদ করে চলে যেতে পারে। ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো মিথস্ক্রিয়া করে ডব্লিউ ও জেড বোসন কণার বিনিময়ের মাধ্যমে।

অন্যদিকে পরমাণুর নিউক্লিওগুলোকে একত্রে ধরে রাখে চতুর্থ বল স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স বা শক্তিশালী পারমাণবিক বল। তাই পারমাণবিক বল ছাড়া চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত পরমাণুর নিউক্লিও। ফলে স্বভাবতই পরমাণু ভেঙে যেত এবং আমরা যে বাস্তবতা সম্পর্কে জানি, তা চোখের সামনে থেকে স্রেফ অদৃশ্য হয়ে যেত। মহাবিশ্বের প্রায় ১০০ মৌল গঠনের পেছনে দায়ী শক্তিশালী পারমাণবিক বল। দুর্বল ও শক্তিশালী পারমাণবিক বল একত্রে আইনস্টাইনের সমীকরণ E = mc2 অনুযায়ী নক্ষত্র থেকে আলো নিঃসরণের জন্য দায়ী। পারমাণবিক বল ছাড়া গোটা মহাবিশ্ব ডুবে যেত গাঢ় অন্ধকারে। আবার পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে যেত এবং জমাট বেঁধে কঠিন হয়ে যেত সাগর-মহাসাগর।

এই চারটি বলের সবচেয়ে বিস্ময়কর ধর্ম হলো, সেগুলো প্রতিটি একে অপরের চেয়ে একেবারে আলাদা। এমনকি তাদের শক্তি ও ধর্মও আলাদা। যেমন মহাকর্ষের কথাই ধরা যাক। চারটি বলের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল হলো মহাকর্ষ। এটি বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলের চেয়ে ১ হাজার ৩৬ গুণ দুর্বল। পৃথিবীর ওজন ৬ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কিলোগ্রাম। তারপরও পৃথিবীর ওজন ও তার মহাকর্ষকে খুব সহজে হারিয়ে দিতে পারে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল। যেমন স্থির বিদ্যুতের মাধ্যমে আপনার চিরুনি কাগজের ছোট টুকরা টেনে তুলতে পারে। আসলে এর ফলে গোটা পৃথিবীর মহাকর্ষের বিরুদ্ধে কাজ করে চিরুনির স্থিরবিদ্যুৎ। তবে মহাকর্ষ চরমভাবে আকর্ষীধর্মী। অন্যদিকে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল কণার চার্জের ওপর নির্ভর করে আকর্ষী ও বিকর্ষীধর্মী দুই রকমের হতে পারে।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানমতে, মহাবিস্ফোরণের পর এই চারটি বল আসলে একটি বল হিসেবে বিরাজ করছিল। মহাবিস্ফোরণের অতি অল্প সময় পর বলগুলো একে একে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। তাই মহাবিশ্বকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে, আদিম মুহূর্তের মতো করে চারটি বলকে একত্র করে বুঝতে হবে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। তাই চারটি বল একীভূত করে একক তত্ত্ব প্রণয়নের প্রতি এতটা জোর দেন তাঁরা।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দুটি প্রধান ভিত্তি আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব। প্রথমটির কাজ–কারবার বৃহৎ পরিসরের জগৎ নিয়ে, তথা মহাকর্ষ বল নিয়ে। আর কোয়ান্টাম তত্ত্বের কাজ–কারবার ক্ষুদ্র পরিসরের পরমাণুর জগৎ নিয়ে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল, সবল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল নিয়ে কাজ করে এই তত্ত্ব। কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলে এই তিনটি বলকে এরই মধ্যে একত্র করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সেখানে মহাকর্ষের জন্য কোনো জায়গা বরাদ্দ নেই।

তাই মোটা দাগে, থিওরি অব এভরিথিং বোঝাতে এখন পদার্থবিদেরা বোঝেন আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম মেকানিকসের মধ্যে একটা সমঝোতা, একটা গাঁটছড়া বাঁধা; যা দিয়ে একই সঙ্গে বিপুল পরিসরের মহাবিশ্ব আর ক্ষুদ্র পরিসরের পরমাণুর রাজ্যকে একসুতোয় গাঁথা যাবে। কিন্তু নানাভাবে চেষ্টা করেও এখনো এতে সফল হওয়া যায়নি। আদৌ সেটি সম্ভব কি না, তা–ও বোঝা যাচ্ছে না। তবে হাল ছাড়েননি বিজ্ঞানীরা। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের ভাষায়, এমন কোনো তত্ত্ব বা সূত্র যদি আমরা শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারি, তাহলে সেটিই হবে মানবজাতির চূড়ান্ত বিজয়।

সূত্র: বিবিসি ফোকাস,

দ্য থিওরি অব এভরিথিং/স্টিফেন হকিং;

প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস/ মিচিও কাকু,

ফিজিকস অব দ্য ইমপসিবল/মিচিও কাকু,

উইকিপিডিয়া