অনন্তের পানে একমুঠো ছাই

১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্যের লোভেল অবজারভেটরিতে ক্লাইড টমবো নামের এক তরুণ জ্যোতির্বিদ প্লুটো আবিষ্কার করেন। ছোটবেলা থেকে টমবো জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহী ছিলেন। চাচার একটি টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। একসময় নিজেই টেলিস্কোপ বানানোর কৌশল শিখে ফেললেন। ধীরে ধীরে নিজের বানানো টেলিস্কোপের মানও উন্নত হতে লাগল। ১৯২৮ সালে ভালো মানের একটি ৯ ইঞ্চি রিফ্লেকটর টেলিস্কোপ তৈরি করলেন। এটি দিয়ে আকাশপটের ছবি অনেক পরিষ্কার দেখা যায়।

সে বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল টমবোর। বিষয়ও ছিল তাঁর স্বপ্নের জ্যোতির্বিজ্ঞান। কিন্তু কপাল খারাপ ছিল তাঁর। পারিবারিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জোগানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে টমবো থেকে গেলেন তাঁর পরিবারের সঙ্গে। শুরু করেন কৃষিকাজ, কিন্তু আগ্রহী মনটা তখনো রয়ে গিয়েছিল তাঁর ভেতরে। কাজ শেষে রাতের বেলায় সেই টেলিস্কোপ দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন আকাশে। বৃহস্পতি ও মঙ্গল গ্রহকে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে নিখুঁতভাবে সেগুলোর ছবি এঁকে পাঠিয়ে দিলেন অ্যারিজোনার লোভেল অবজারভেটরিতে।

এর আগে পার্সিভাল লোভেল নামের এক বিজ্ঞানী অনেক দিন ধরে প্লুটোকে খুঁজছিলেন। এর পেছনেও কারণ আছে। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, ইউরেনাস ও নেপচুনের কক্ষপথে একটা ঝামেলা হচ্ছে। কক্ষপথের বাইরের কোনো একটা বস্তু তাদের গতিপথকে প্রভাবিত করছে। তার মানে নেপচুনের সীমানার বাইরে আরও একটা গ্রহ আছে। একে খুঁজে বের করা দরকার।

১৯৯৪ সাল থেকে এই অজানা গ্রহকে খুঁজে বের করতে ব্যাপক পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই কাজের প্রধান ছিলেন লোভেল। তাঁর নামেই অ্যারিজোনার অবজারভেটরির নামকরণ করা হয়। কিন্তু ১৯১৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর এ কাজে ভাটা পড়ে যায়। তখন এই অবজারভেটরির পক্ষে পেশাদার জ্যোতির্বিদ নিয়োগ দেওয়ার সামর্থ্যও ছিল না। টমবোর কাছে সেই চিঠি আসে। বেশি বেতন দিয়ে পেশাদার জ্যোতির্বিদ নিয়োগ দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই তরুণ টমবোকেই নিয়োগ দেওয়া হয় অজানা গ্রহটির অনুসন্ধানে। তিনি আকাশের বুকে সুই ফুঁড়ে ফুঁড়ে আকাশের প্রতিটা কোণের বিন্দুর ছবি তুলে প্লুটোকে খুঁজতে লাগলেন। অবশেষে সাফল্য ধরা দেয় ১৯৩০ সালে। আকাশের বিশেষ একটি অঞ্চলে এমন একটি বিন্দুর দেখা পেলেন, যেটি তার অবস্থান পরিবর্তন করছে। সেটাই আজকের প্লুটো। আবিষ্কারের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি গ্রহ হিসেবেই পরিচিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে এটিকে গ্রহের তালিকা থেকে সরিয়ে বামন গ্রহ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

প্লুটোর আবিষ্কারক ক্লাইড টমবো

তরুণ বয়সে আস্ত একটি গ্রহ আবিষ্কার করে ফেলেছেন—এ খবরে সারা বিশ্বে ক্লাইড টমবো বিখ্যাত হয়ে গেলেন। স্কলারশিপ নিয়ে লেখাপড়াও শেষ করলেন। বাকি জীবন জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেই কাটিয়েছিলেন। অনেক গ্রহাণু ও ধূমকেতুর পাশাপাশি কয়েক শ বিষম তারা, তারার ক্লাস্টার, গ্যালাক্সির ক্লাস্টার ও সুপারক্লাস্টার আবিষ্কার করেন। ১৯৯৭ সালে মারা যান তিনি। তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল, তাঁর দেহাবশেষ যেন সৌরজগতের সীমানা পেরিয়ে চলে অনন্ত মহাকাশের দিকে।

প্লুটোসহ সৌরজগতের অন্যান্য বস্তু সম্পর্কে ধারণা পেতে ২০০৬ সালে নিউ হরাইজন স্পেস প্রোব পাঠানো হয় মহাকাশে। টমবোর শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানাতেই প্রোবের বোর্ডের ওপর জুড়ে দেওয়া হয় তাঁর দেহের অবশেষ। সেখানে লেখা হয়েছে একটা এপিটাফ—এখানে প্রোথিত আছে আমেরিকান নাগরিক ক্লাইড ডব্লিউ টমবোর দেহাবশেষ, যিনি ছিলেন সৌরজগতের থার্ড জোন ও প্লুটোর আবিষ্কারক, আদেল ও মোরনের পুত্রসন্তান, প্যাট্রিশিয়ার স্বামী, অ্যানেট ও অ্যালডেনের পিতা, জ্যোতির্বিদ, শিক্ষক, রসিক ও বন্ধুবত্সল ক্লাইড ডব্লিউ টমবো (১৯০৬-১৯৯৭)।

প্লুটোর আবিষ্কারকের দেহের ছাই নিয়ে নিউ হরাইজন ২০১৫ সালে প্লুটো গ্রহের সবচেয়ে কাছ দিয়ে উড়ে যায়। ব্যাপারটা অনেক কাব্যিক। কোটি কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্লুটোর আবিষ্কারকের দেহাবশেষ উড়ে গিয়েছে প্লুটোর খুব কাছ দিয়ে। ক্লাইড টমবোই প্রথম ব্যক্তি, যাঁর দেহ সৌরজগতের এত দূরে প্লুটো পর্যন্ত পৌঁছেছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিদ্যা বিভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ

সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ; আরও একটুখানি বিজ্ঞান/ মুহম্মদ জাফর ইকবাল

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত।