আসছে হাবলের উত্তরসূরী জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

প্রায় বিশ বছরের কাজ শেষে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এখন মোটামুটি প্রস্তুত কাজ শুরু করার জন্য। উৎক্ষেপণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ৩১ অক্টোবর, ২০২১। এখন পর্যন্ত বানানো সর্ববৃহৎ নভোমানমন্দির এটি। ধারণা করা হচ্ছে, এই টেলিস্কোপ মহাবিশ্ব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু রহস্য সমাধানের রসদ জোগাবে।

প্রায় ৩০ বছর আগে প্রথম এই টেলিস্কোপ বানানোর কথা ওঠে হাবল টেলিস্কোপের উত্তরসূরী হিসাবে। তারপর নানা ঝামেলা, ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে, ১৬ বার উৎক্ষেপণ বাতিল করে, প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো খরচ হওয়ার পর (পুরোটা এখনো হয়নি, উৎক্ষেপণ পর্যন্ত এ পরিমাণ খরচ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে) অবশেষে উৎক্ষেপণের দ্বারপ্রান্তে জেমস ওয়েব। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার জাতীয় মহাকাশ সংস্থা এর পেছনে একজোট হয়ে কাজ করেছে।

প্রায় ২৫ বছরের ওপর কাজ করছে হাবল টেলিস্কোপ। বিগ ব্যাংয়ের মাত্র ৫০০ মিলিয়ন বছর পরবর্তী মহাবিশ্বের আলোও ধরতে পেরেছে। আশা করা হচ্ছে, হাবলের উত্তরসূরী হিসাবে জেমস ওয়েব আরও আগেকার আলো ধরতে পারবে। এর হাত ধরে আমরা আরও ভালোভাবে জানতে পারব শিশু মহাবিশ্বের কথা।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ব্যাপারে কিছু খুঁটিনাটি তথ্য জেনে নেওয়া যাক। এর সানশিল্ডের আকার দৈর্ঘ্যে ২১ মিটার ও প্রস্থে ১৪ মিটার। নাম শুনেই বোঝা যায়, এটি আলোকরোধী অংশ। কাজ, টেলিস্কোপের মূল অংশকে (মূল আয়না, রিসিভার ইত্যাদি) বিভিন্ন আলোর উৎস (যেমন সূর্য) ও তাপ থেকে রক্ষা করা। পৃথিবী থেকে ১.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে থেকে জেমস ওয়েব পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরবে। ধারণা করা হচ্ছে, এ থেকে প্রথম ছবি পাওয়া যাবে মোটামুটি ২-৩ মাস পর।

মূল আয়নাটি অষ্টদশভুজী (১৮টি বাহুবিশিষ্ট), স্বর্ণাবরণে মোড়া। দ্বিতীয় আরেকটি আয়না আছে। মূল আয়না থেকে প্রতিফলিত আলোকে কেন্দ্রীভূত করবে ইন্টিগ্রেটেড সায়েন্স ইন্সট্রুমেন্ট মডিউলের ওপর। এই মডিউল গৃহীত আলো থেকে তৈরি করবে ছবি। সেই সঙ্গে টেলিস্কোপটিতে আছে স্টার ট্র্যাকার। এগুলো আসলে কিছু ছোট ছোট টেলিস্কোপ, নক্ষত্রদের প্যাটার্ন খেয়াল রেখে মূল টেলিস্কোপটিকে লক্ষ্যের দিকনির্দেশনা দিবে।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মূল নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার কাজ করবে স্পেসক্রাফট বাস। আর, পৃথিবীতে তথ্য পাঠাবে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন 'হাই গেইন এন্টেনা'।

আগেই বলেছি, জেমস ওয়েবের অন্যতম কাজ শিশু মহাবিশ্বকে আরও ভালোভাবে জানার চেষ্টা করা। হাবল যেখানে বিং ব্যাং-এর ৫০০ মিলিয়ন বছর পরের আলো ধরতে পারত, জেমস ওয়েবের সেখানে ২০০ মিলিয়ন বছর পরবর্তী আলো ধরতে পারার কথা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, শিশু মহাবিশ্বের প্রথম দিকের দানব নক্ষত্রগুলো হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামে তৈরি। পরবর্তীতে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে এদের মৃত্যু হয়। এ সময় তৈরি হয় পর্যায় সারণির ভারী সব পদার্থ। এমনিতে বর্তমানে আমরা যেসব তরুণ নক্ষত্রদের দেখতে পাই, এসব নক্ষত্রে এত ভারী পদার্থ তৈরি হওয়ার কথা না। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আগেকার দানব নক্ষত্রদের ধ্বংসাবশেষ ওসব ভারী পদার্থের চিহ্ন-ই বর্তমানের তরুণ নক্ষত্রগুলোর বুকে শনাক্ত করা যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা যাচাই করে দেখা যাবে জেমস ওয়েবের 'চোখ' দিয়ে। পাশাপাশি, জানা যাবে শিশু মহাবিশ্বের ব্যাপারে আরও বিস্তারিতভাবে।

পাশাপাশি, শিশু মহাবিশ্বে তৈরি হওয়া প্রাচীন গ্যালাক্সিদের খোঁজও পাওয়া যাবে জেমস ওয়েবের চোখে। এর মাধ্যমে বোঝা যাবে মহাবিশ্বের ক্রমপরিবর্তনের ব্যাপারে। বোঝা যাবে, গ্যালাক্সিদের মধ্যে এত বৈচিত্র্য কীভাবে এলো। এছাড়াও ডার্ক ম্যাটার, মানে গুপ্তবস্তুর খোঁজ করবে জেমস ওয়েব। গ্র্যাভিটেশনার লেন্সিং ব্যবহার করে দূর, বহুদূরের গ্যালাক্সির ঘূর্ণন পরীক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করবে, সেসব জায়গায় গুপ্তবস্তু আছে কি না, থাকলে সেসব গ্যাল্যাক্সির ওপরে কীরকম প্রভাব ফেলছে।

সৌরজগতের বাইরে প্রাণের উপযোগী গ্রহে প্রাণের সন্ধানও করবে জেমস ওয়েব। এমনকি সৌরজগতের ভেতরে নেপচুন এবং ইউরেনাসকেও আরো ভালোভাবে জানার চেষ্টা করবে। তৈরি করবে এদের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার মানচিত্র (মানে, কোথায় কীরকম তাপমাত্রা সাধারণত থাকে)। তালিকা করবে এদের মধ্যকার রাসায়নিক পদার্থদের। জানতে চেষ্টা করবে, এরা একে অন্যের থেকে এবং এদের প্রতিবেশী শনি ও বৃহষ্পতি থেকে কতটা ভিন্ন।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, আধুনিক প্রযুক্তিবলে জেমস ওয়েব হাবলের যোগ্য উত্তরসূরী হবে। নিকট ভবিষ্যতে জ্যোতির্বিজ্ঞান, মহাবিশ্ব তত্ত্ব ইত্যাদিতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এখন শুধু উৎক্ষেপণের অপেক্ষা।

লেখক : বিজ্ঞানচিন্তা প্রতিবেদক

সূত্র : সায়েন্স ফোকাস, বিবিসি, উইকিপিডিয়া