ইন্টারস্টেলার মুভির নেপথ্যে

ইন্টারস্টেলার মুভিটি অনেকেই দেখেছেন। অত্যন্ত উপভোগ্য সায়েন্স ফিকশন মুভি। মুভিটির প্লট নিয়ে আলোচনা করে স্পয়লার দেওয়া ঠিক হবে না, যদিও যথেষ্ট পুরোনো হয়েছে মুভিটি। তবে মোটাদাগে বলা যায়, অনতিদূর ভবিষ্যতের ছবি আঁকা হয়েছে মুভিটিতে। তখন পৃথিবী পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে। তখনকার মানুষ স্পেস ট্রাভেলে সক্ষম, কিন্তু ঘরের অবস্থা সঙিন বলে স্পেস মিশনগুলো আপাতত নিষ্প্রভ। এমতাবস্থায় ঘটনাচক্রে মুভিটিতে ওয়র্মহোল দিয়ে ভ্রমণ, দানবাকৃতির কৃষ্ণবিবর দর্শন, বিচিত্র বাহ্যগ্রহ বা এক্সোপ্লানেটে ভ্রমণ, দানবাকৃতির কৃষ্ণবিবরের ঘটনাদিগন্তের সীমানায় নায়কের পঞ্চমমাত্রা লাভ, স্পেসটাইমের রহস্যকে কাছ থেকে দেখা, গ্র্যাভিটির কারুকাজ ইত্যাদি মুভিটির আকর্ষণীয় বিষয়।

আসলে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক ধারণার ভিত্তিতে বানানো হয়েছে এ মুভি। কিন্তু কেমন সেই ভিত্তি? কীভাবেই-বা ওয়র্মহোল বা গার্গাঞ্চুয়ার মতো ব্ল্যাকহোল তৈরি হতে পারে, তার আশপাশে স্থান-কালের বক্রতা কেমন রূপ গ্রহণ করে? আর সেই চরম স্পেসটাইমে আমরা আর কী কী ভৌত প্রপঞ্চ আশা করতে পারি? এমন মহাজাগতিক পরিস্থিতিতে কী রকম গ্রহ থাকতে পারে, সেসব গ্রহের আশ্চর্য ঘটনার দু-একটি এই মুভিতে দেখানো হয়েছে।

মুভিটি ক্যালটেকের বিখ্যাত পদার্থবিদ কিপ থর্নের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, কিংবা বলা যায় যাঁর সার্বক্ষণিক বুদ্ধি-পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। মহাকর্ষবিষয়ক একজন জগত্খ্যাত বিশেষজ্ঞ উনি। তাঁর আগের বই ব্ল্যাকহোলস অ্যান্ড টাইম ওয়ার্পসও বিখ্যাত। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান গ্রাভিটেশন নামের ঢাউস বইটি। কেউ যদি মহাকর্ষ শিখতে চায়, তাহলে এই বই পড়তেই হবে। আন্ডারগ্র্যাড থেকে পিএইচডি পর্যন্ত মহাকর্ষ বিষয়ে নানা পর্যায়ের খুঁটিনাটি বিজ্ঞান এই বইয়ে আছে। কিপ বহুদিন ধরে এক্সাক্ট সায়েন্সের ভিত্তিতে একটি মুভি বানানোর চিন্তা করছিলেন। এর আগে কার্ল সাগানের বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন কনট্যাক্ট লেখার সময় ‘সময় ভ্রমণ’-এর ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ চান। তিনি প্রায় ১৬ পাতার সমীকরণ কষে এমন এক সমাধান দিয়েছিলেন যে সাগানকে সেই গল্প নতুন করে লিখতে হয়েছিল। পরে সে গল্প নিয়ে মুভিও হয়েছে। অতএব এসব চিন্তাবীজ আগে থেকেই তাঁর মাথায় ছিল-প্রায় কুড়ি বছর ধরে তাঁর চিন্তার ফসল ইন্টারস্টেলার মুভি। এ মুভিতে পাঁচ মাত্রার কথা, ব্ল্যাকহোলের কোল ঘেঁষে টেসারেক্টের কল্পনার কথা, পাঁচ মাত্রিক সত্তা বাল্ক-বিয়িংয়ের কথা, টাইম ট্রাভেলের কথা, ওয়ার্মহোলের কথা, কক্ষপথের স্ট্যাবিলিটির কথা, ব্রেন বিশ্বের কথা, কম্পিউটার গ্রাফিকসের কথা, আইনস্টাইনের সমীকরণের বিবিধ সমাধানের কথা, জোয়ার বলের কথা। এসব বৈজ্ঞানিক চিন্তার বাস্তব সম্ভাবনা কী? কিপ থর্নের মতে, বাস্তব সম্ভাবনা এক জিনিস আর তাত্ত্বিক সম্ভাবনা আরেক জিনিস। এই মুভিতে সেব ভৌত প্রপঞ্চ দেখানো হয়েছে এর সবই পদার্থবিজ্ঞানের কোনো না কোনো তত্ত্বের আলোকে সম্ভব, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে। তবে বাস্তব হলো সব তত্ত্বের রূঢ় পরীক্ষক। বাস্তবে মিলল তো টিকে গেল, নইলে বাতিল। এই হলো ব্যাপার।

প্রথমে আসা যাক গারগাঞ্চুয়া নামের যে বিশাল ব্ল্যাকহোলটি এখানে দেখানো হয়েছে তার সম্ভাবনা যাচাইয়ে। সৌরভরের মিলিয়ন গুণ কৃষ্ণবিবর প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকে, এ কথা জ্যোতিঃপদার্থবিদেরা নিশ্চিত করেছেন। আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে আছে একটি ৪ মিলিয়ন সৌরভরের দানবীয় ব্ল্যাকহোল, সূর্য থেকে প্রায় ২৭ হাজার আলোকবর্ষ দূরে ধনু রাশির দিকে।

একে আকাশে স্যাজিটারিয়াস এ* বলে চিহ্নিত করা হয়। ‘স্টার’ চিহ্নিত কেননা এটি তুমুল এক্সরশ্মির বিকিরণ দেখায়। এ ছাড়া এটি প্রবল রেডিও তরঙ্গের উত্সও বটে। এ ধরনের ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হয় গ্যালাক্সি সৃষ্টির সময় থেকেই ঘনীভূত গ্যাসপিণ্ডের মহাকর্ষীয় পতন থেকে। অন্যদিকে সূর্যের তুলনায় ২০-৩০ গুণ ভরের নক্ষত্র যখন আয়ুষ্কালের শেষস্তরে পৌঁছায়, তখন সে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। এরা সুপারম্যাসিভ বা দানবীয় ব্ল্যাকহোল থেকে ভিন্ন, তবে ব্ল্যাকহোলের মৌলিক ধর্মাবলি সবারই একই রকম। কেবল অতি দানবীয় ভরের ব্ল্যাকহোলের আশপাশে মহাকর্ষীয় প্রপঞ্চ নাটকীয় গুণে বেশি হবে, এই যা। ফলে গারগাঞ্চুয়ার মতো অতিদানব কৃষ্ণবিবরের কাছে স্থানকালের বঙ্কিমতা এত বেশি হবে যে সেখানে নানা চরম ঘটনা, যাদের কেবল তাত্ত্বিক সম্ভাবনা রয়েছে, মূর্ত হয়ে দেখা দিতে পারে। যেমন টেসারেক্টের ঘটনা। টেসারেক্ট হলো ঘনকের ভেতর ঘনক। অর্থাত্ এমন এক কাঠামো যেটা চতুর্মাত্রিক ঘনক বোঝায়। একটি বর্গক্ষেত্রের একমাত্রিক প্রতিচ্ছায়া যদি নেওয়া যায়, সেটা তবে একটি রেখা হবে, দুই মাত্রায় একটি ঘনকের প্রতিরূপ হবে বর্গাকৃতির। এই জ্যামিতিক যুক্তিতে ধারণা করা যায় যে একটি চতুর্মাত্রিক ঘনকের ত্রিমাত্রিক ছায়া হবে ঘনকের ভেতর ঘনক। এটি কোনো কল্পনার ব্যাপার নয়, এটি একটি জ্যামিতিক প্রতিভাস।

চার মাত্রার কঠিন বস্তু আমরা কল্পনা করতে পারি না। কারণ, আমরা তিন মাত্রায় অভ্যস্ত চতুর্মাত্রিক জীব, তাই টেসারেক্টের গঠন কল্পনা করতে অসুবিধা হয়। এ নিয়ে অবশ্য কার্ল সাগানের একটি চমত্কার ভিডিও আছে (ইউটিউব দেখতে পারেন: Flatland & the 4th Dimension - Carl Sagan)। কাজেই টেসারেক্টের যে কল্পনা এই মুভিতে দেখানো হয়েছে সেটা খুবই সম্ভব, বিশেষ করে দানবাকৃতির কৃষ্ণবিবরের ঘটনা দিগন্তের ধারে স্থানকাল যেভাবে দুমড়ে-মুচড়ে যায় সেখানে। একে কীভাবে দেখাবে সেই অংশটা কাল্পনিক, কিন্তু টেসারেক্টের বৈজ্ঞানিক সম্ভাব্যতা অপরিহার্য।

এই মুভিতে দানবাকৃতির ব্ল্যাকহোলটিকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেটা সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক। যেকোনো ব্ল্যাকহোল আশপাশ থেকে পদার্থ টেনে নেয়। ফলে এর পাশে পদার্থের একটি ঘুরন্ত ডিস্ক তৈরি হয়, একে বলে অ্যাক্রেশন ডিস্ক। দানবাকৃতির ব্ল্যাকহোলের পাশে এই ডিস্কটি আরও নাটকীয়ভাবে দেখা যাবে। একে কেমন দেখা যাবে সেটা নিয়ে কিপ থর্নসহ অন্য বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের গবেষণা আছে। মূলত কম্পিউটার সিমুলেশনভিত্তিক এই গণনায় ব্ল্যাকহোলের চারপাশের এই ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে আসা অ্যাক্রেশন ডিস্কটি অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে দেখা দেবে। ব্ল্যাকহোল যেহেতু আলো শুষে নেয়, তাই এতে দেখার কিছু নেই, কিন্তু ওই ডিস্কটি একটি চোখ ধাঁধানো দৃশ্যের অবতারণা করবে। ইন্টারস্টেলার মুভিতে যেভাবে দেখানো হয়েছে তার আরেকটু জটিল ব্যাখ্যা আছে। ব্ল্যাকহোলের সামনের দিকে যে ডিস্ক থাকবে তাকে তো দেখাই যাবে, কিন্তু সেটি ঘুরে যখন পেছনে যাবে তখন তাকেও দেখা যাবে এই কারণে যে ব্ল্যাকহোল তার পেছনের আলোকে বাঁকিয়ে দেয়। এ জন্য মুভিতে অ্যাক্রেশন ডিস্ককে ধনুকের মতো দেখায়।

মুভিতে আরেকটা জিনিস দেখায় (আরও অনেক জিনিস দেখায়, কিন্তু সব তো এই ছোট প্রবন্ধে শেষ করা যায় না) মিলারের গ্রহ নামের একটি সম্পূূর্ণ জলমগ্ন গ্রহ। সম্পূর্ণ জলমগ্ন গ্রহ কি সম্ভব?

এক্সোপ্লানেট বা বাহ্যগ্রহ নিয়ে কেপলার মিশনের মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু জেনেছি। যেমন হেন রকম ঘটনা নেই, যা বহুবিচিত্র বাহ্যগ্রহে ঘটে না। জ্যোতির্বিদ কালেব শার্ফ বলেন, ‘এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সম্ভাব্য গ্রহগত গঠন ও পরিবেশের এক বিচিত্র রংধনু সমাবেশ খুঁজে পেয়েছেন। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে এমন সব গ্রহ, যাদের বাতাবরণে আছে জলীয় বাষ্প কিংবা আণবিক হাইড্রোজেন, মহাসামুদ্রিক গ্রহ, যাদের কোনো ডাঙাই নেই (শুধুই জলরাশি), কার্বনগ্রহ এবং তাদের বিচিত্র গ্রহবিজ্ঞান, এবং চিরস্থায়ী শৈত্যে আক্রান্ত তুষারিত ধরিত্রী যাদের বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত জমে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়েছে। আছে অতি উত্তপ্ত, অতিশীতল, উষ্ণ কিংবা সামান্য গরম গ্রহ কিংবা এমন গ্রহ, যার মধ্যে এর সবগুলোই দেখা যায়। আছে রসায়নে সমৃদ্ধ গ্রহ, যাদের মধ্যে থাকবে অজানা যৌগের সমুদ্র, অনেকেই থাকবে পৃথিবীর মতোই। এমনকি রসায়নে দুর্বল গ্রহও থাকবে। শনির মতো ধুলা কিংবা বরফের বলয় যুক্ত গ্রহও থাকবে। অনেক গ্রহের উপগ্রহ থাকবে, কারও কারও উপগ্রহ হয়তো পৃথিবী বা মঙ্গলের মতোই বড় হবে, যাদের নিজস্ব বায়ুমণ্ডল, মহাসমুদ্র ও স্থলভাগ থাকবে।’ কাজেই সম্পূর্ণ জলমগ্ন গ্রহের সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জল না হয়ে সেখানে তরল অ্যামোনিয়া বা মিথেনের সাগর থাকতে পারে। শনির উপগ্রহ টাইটানেই তো মিথেনের হ্রদ আছে।

কাজেই মিলারের গ্রহ সম্পূর্ণ জলমগ্ন হতে বাধা নেই। আর সেখানে ১.২ কিলোমিটার উঁচু ঢেউ কীভাবে সম্ভব? সেটা সম্ভব গারগাঞ্চুয়ার প্রবল জোয়ার বলের কারণে। যখন কোনো ছোট বস্তু একটি বৃহত্ বস্তুর মহাকর্ষীয় প্রভাবের মধ্যে তখন একে ওপরের ওপর জোয়ার বল বা টাইডাল ফোর্স প্রয়োগ করে। এর উত্পত্তি হয় মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের ডিফারেন্সিয়াল প্রয়োগের কারণে। চাঁদ পৃথিবীর ওপর, পৃথিবী চাঁদের ওপর, বৃহস্পতি গ্রহ তার উপগ্রহদের ওপর জোয়ার বল প্রয়োগ করে। কাজেই মিলারের গ্রহের ওপরও জোয়ার বল কাজ করবে। তার ফলেই প্রবল জোয়ারের টানে পাহাড়প্রমাণ ঢেউ ছুটে আসে।

মুভিতে দেখানো পঞ্চমাত্রিক বাল্ক-বিয়িং কি সত্য, যারা টেসারেক্ট তৈরি করে ক্যাপ্টেন কুপারকে তাঁর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল? চার মাত্রার অতিরিক্ত আরও মাত্রা আছে কি না সেটা একান্তই কল্পনার ব্যাপার। স্ট্রিং থিওরি ও মাল্টিভার্সের তত্ত্বমতে, একাধিক মাত্রা সম্ভব, কিন্তু তাদের কোনো পরীক্ষণলব্ধ প্রমাণ নেই। চার মাত্রার তুলনায় পাঁচ বা ততোধিক মাত্রায় পদার্থবিজ্ঞান অনেক বেশি কৌতূহলোদ্দীপক হয়, অনেক ইন্টারেস্টিং ফিজিকসের দেখা মিলে। কাজেই তিনের বেশি মাত্রা হতেই পারে। তবে যতক্ষণ না তথ্যপ্রমাণ মিলছে ততক্ষণ বাল্ক-বিয়িংয়ের ধারণা কল্পনাতেই থাকুক।

মুভির একদম শেষে দেখা যায়, কুপারকে উদ্ধার করে এক স্পেসশিপে রাখা হয়েছে। স্পেসশিপটি একটি বহু প্রজন্মের স্টারশিপ, যাতে বহু হাজার লোক থাকতে পারে, সেখানে কৃত্রিম গ্র্যাভিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে মানুষের ভবিষ্যতের স্পেসমিশনের লক্ষ্যে এটা একটা শক্তিশালী বার্তা যেটা ক্রিস্টফার নোলানের চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং অসাধারণ স্ক্রিপ্টের গুণে ভীষণ জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

লেখক: অধ্যাপক, তড়িেকৗশল ও ইলেকট্রনিকস বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: প্রফেসর কিপ থর্ন, দ্য সায়েন্স অব দ্য ইন্টারস্টেলার, ২০১৪

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত