ইলন মাস্কের স্বপ্ন

গত মাসের ১৯ তারিখ ফ্লোরিডায় নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাড থেকে ফ্যালকন হেভি নামের একটি রকেট সাফল্যের সঙ্গে মহাকাশে গিয়েছে। এরকম আজকাল হর হামেশাই যায়। তবে, এটি বিশেষভাবে ঐতিহাসিক, কেননা এটির মালিক স্পেসএক্স। মানে ইলন মাস্কের স্পেসএক্স। আরও একটা কারণ হলো ফ্যালকন হেভি রকেট তিনটির সবগুলোকেই পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, যা আবারও ব্যবহার করা যাবে। এই স্পেসএক্স এবং টেসলা দিয়ে ইলন আমাদের ভবিষ্যতের একটা রূপরেখা গড়তে চান। মহাকাশে কেবল সরকারি লোক নয়, যার খুশি সে যেতে পারবে এমন একটা স্বপ্ন নিয়েই তিনি কাজ করছেন। এই ঘটনা তার পথে বড় একটি ধাপ। এমন স্বপ্নবাজ লোক ইলন কেমন করে হলেন?

তিনি নিজে বলেন−আমি পড়ি। যখনই সুযোগ পাই তখনই পড়ি। ইলনের বয়স যখন নয় তখন তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা সম্পূর্ণ পড়ে ফেলেছিলেন! সে সময় তিনি দিনে গড়ে ১০ ঘণ্টা বিজ্ঞান কল্পকাহিনী পড়তেন!

ফ্যালকন হেভিই কিন্তু এযাবত্কালের সবচেয়ে বড়ো নভোতরী। ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে এই বিশাল মহাকাশযানটি কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই উড্ডয়নে সক্ষম হয়েছে। এই সাফল্য যে খুব সহজে এসেছে তা নয়। ২০০২ সালে স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইলন একটার পর একটা রকেট আকাশে পাঠিয়েছেন। এর অনেকগুলোই সাফল্যের মুখ দেখেনি। এসবে তো আর দমে যাওয়ার পাত্র নন ইলন মাস্ক। তিনি আমাদের যুগের টমাস আলভা এডিসন। তাই মজা করে কিছুদিন আগে একটা ভিডিও বানিয়েছিলেন, হাউ নট টু ল্যান্ড অ্যান অরবিটাল রকেট বুস্টার। এই ভিডিওতে দেখা যায় তাদের পাঠানো অনেকগুলো রকেট বুস্টার ল্যান্ড করতে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে, হতোদ্যম না হয়ে একটার পর একটা চেষ্টা করে গেছেন, এবং প্রতিটা চেষ্টা থেকে শিখেছেন কীভাবে সফলতার সঙ্গে ব্যর্থ হওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সক্ষম হয়েছেন তিন স্তরের রকেট বুস্টারকে সাফল্যের সঙ্গে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে, এবারের ফ্যালকন হেভি লঞ্চ করে।

এর আগে পৃথিবীর সবচেয়ে হেভি রকেট উেক্ষপণ করা হয়েছে ডেল্টা ফোর হেভি। মাস্কের বক্তব্য অনুসারে ফ্যালকন হেভি সেটির দ্বিগুণ ওজনের কিন্তু তিনভাগের একভাগ খরচের। এটিকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে পৃথিবীর কাছাকাছি কক্ষপথে ৬৪ টন পে-লোড দিতে পারে। এর মানে হলো ঢাকার বন্ধ হয়ে যাওয়া ৫টা ডাবল ডেকার বাসকে মহাকাশে পাঠানো। এবারের অনিশ্চিত এই যাত্রায় মাস্ক অবশ্য এতো ওজনদার জিনিস সেখানে দেননি। ফ্যালকন হেভি নিয়ে গেছে মাস্কের পুরাতন চেরি লাল রঙের টেসলা স্পোর্টস কারটি। স্পেসস্যুট পরা একটি ম্যানিকুইনকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ওর চালকের আসনে। আর গাড়ির রেডিওতে বাজিয়ে দিয়েছেন ডেভিড বউয়ির স্পেস অডিটি। ফ্যালকন হেভি গাড়িটাকে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে বসিয়ে দিয়েছে যাতে এক সময় সেটি মঙ্গল গ্রহের কাছে পৌঁছাতে পারে।

ফ্যালকন হেভি লঞ্চ করার পরদিন সকালে এই লেখাটা লেখার সময় রুবাইকে বলছিলাম মাস্কের এই কীর্তির কারণ কী? ও বললো, ‘শোনো নাই। ইলন মাস্ক আসলে এলিয়েন। পৃথিবীতে আটকা পড়েছে। এখন নিজের বাড়িতে ফেরার জন্য এতসব কাজ কর্ম করে বেড়াচ্ছে।’ ইলন মাস্কের এতসব কীর্তি দেখে মনে হয়, অসম্ভব কী!

মাস্কের এই টেসলা রোডস্টার গাড়ির সঙ্গে একটা ক্যামেরা ছিল। সেটি ঘণ্টাকয়েক ছবি পাঠিয়েছে, অসাধারণ সব দৃশ্য। তবে, এখন যদি সেই গাড়ি আর তার ড্রাইভিং সিটে বসা ম্যানিকুইন স্টারম্যানকে ট্র্যাক করতে চান? হ্যা, সে উপায়ও বের করে ফেলেছে এক অতি উত্সাহী। বেন পিয়ারসন নামের এক প্রকৌশলী তৈরি করেছেন একটি ওয়েবসাইট, whereisroadster.com। তাঁর ছোটবেলা থেকেই, মানে গ্রেড থ্রি থেকে মহাকাশ নিয়ে আগ্রহ। ভার্জ ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছে, ‘আমার ছোট্ট লাইব্রেরির মহাকাশ সম্পর্কিত সব বই আমি পড়েছি।’ তিনি লক্ষ করেছেন অনলাইনে অনেকেই টেসলা রোডস্টারের খোঁজ করছে। তখন তিনি ভাবলেন, আমি তাহলে একটা ট্র্যাকার বানাই না কেন। যেই ভাবা সেই কাজ।

রোডস্টার এ লেখা লেখার সময় (৮ মার্চ ২০১৮) আছে পৃথিবী থেকে ৮৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে। উল্লেখ্য, চাঁদের দূরত্ব পৃথিবী থেকে তিন লক্ষ কিলোমিটার। পিয়ারসনের ওয়েবসাইট প্রতিমুহূর্তের হিসাবটা প্রকাশ করে যাচ্ছে। নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবের ডেটা ব্যবহার করে পিয়ারসন এই কাজটা করছেন।

উৎক্ষপনের পর থেকে পিয়ারসন রোডস্টারের মডেলিং শুরু করেন। কিন্তু দেখা গেল তার হিসাব আর ইলন মাস্কের হিসাব মিলছে না। প্রথমে হতোদ্যম হলেও পরে দেখা গলে বেনের হিসাবই ঠিক। মাস্কেরটা নয়। ‘আপনি যখন জানলেন আপনারটাই ঠিক, মাস্কেরটা নয়, তখন কেমন লেগেছে?’ এ প্রশ্নের জবাবে বেন বলেছেন, ইলন একজন ভিশনারি এবং রিস্ক নিতে পছন্দ করেন। এজন্য তিনি মাস্কের ভক্ত। ২০২০ সাল পর্যন্ত রোডস্টারকে ফলো করা যাবে বেনের ওয়েবসাইট থেকে। এবং দেখা যাবে কখন গাড়িটি পৃথিবী বা মঙ্গলের খুব কাছে এসে পড়বে। ২০৯১ সালে আবার রোডস্টার পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে এসে পড়বে। তখন সেটিকে আবার পৃথিবীতে নিয়ে এসে একটি জাদুঘরে রাখা যাবে বলে মনে করেন বেন পিয়ারসন! ততদিন হয়ত আমি থাকব না, তবে এই জীবনেই ইলন মাস্কের আরও নানান কীর্তি দেখতে পাবো। ভবিষ্যতে মানুষের অন্য গ্রহে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা ইলনের হাত ধরে হবে বলেই আশা করি।

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত