একজন শ্যানন কারি

মার্স অ্যাটমোস্ফিয়ার অ্যান্ড ভোলাটাইল ইভোলিউশন। সংক্ষেপে ম্যাভেন। নাসার মঙ্গলগ্রহ বিষয়ক তিনটি স্যাটেলাইট মিশনের একটি। এই মুহূর্তে লাল গ্রহটির কক্ষপথের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবিরাম ঘুরপাক খাচ্ছে এই স্যাটেলাইট। এই গুরুত্বপূর্ণ মিশনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন শ্যানন কারি। এ ধরনের মিশনে এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী প্রধান। আবার এখন পর্যন্ত এরকম মিশনে সবচেয়ে কমবয়সী প্রধান।

শ্যানন কারি মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ম্যাভেনের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর বা প্রধান গবেষকের দায়িত্ব নিয়েছেন। মিশন প্রধান হিসেবে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় তিনি ছিলেন সাড়ে ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সাত বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলের স্পেস সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে যোগ দেওয়ার সময় ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি এমন একটা কঠিন কাজের দায়িত্ব নিতে হবে একদিন। যদিও তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল মঙ্গল এবং বুধ। যুক্তরাষ্ট্রের টাফট্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোফিজিকসের স্নাতক এই মেধাবী বিজ্ঞানী পিএইচডি করেছেন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পেস ফিজিকসে বিষয়ে। মাঝে অবশ্য কিছুদিন সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন বিমাননির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনে। কিন্তু খোদ নাসার স্পেস মিশনের নেতৃত্ব! এ যে স্বপ্নেই ছিল কেবল। কিন্তু শ্যানন কারির মেধা আর পরিশ্রম তাঁকে এই জায়গায় ঠিকই এনে দিয়েছে।

ম্যাভেন মিশনের প্রথম প্রধান গবেষক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি অফ অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যান্ড স্পেস ফিজিকসের গবেষক ব্রুস জ্যাকস্কি। মজার বিষয় হলো, মিশনের প্রধান গবেষক বা প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর নাসার কোনো কর্মকর্তা হতে পারবেন না, তাঁর নিয়োগ হবে নাসার বাইরে থেকে। এই প্রধান গবেষকের কাজ নানাবিধ। অরবিট এবং অপারেশনগুলোকে নিখুঁতভাবে ম্যানেজ করা, ডেটা পাইপলাইন মেনটেইন করা, ডেটা প্রসেসিং, জ্বালানি ব্যবহার ব্যবস্থাপনা, রোভারের মাধ্যমে ডেটা কীভাবে মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে রিলে হবে তার ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে আরও এক দশক যেন স্যাটেলাইটটি জায়গামত বসে ঠিকঠাক কাজ করে যেতে পারে, তা দেখা। মঙ্গলের সঙ্গে পৃথিবীর ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক বজায় রেখে চলে ম্যাভেন। ম্যাভেন বাদে আরও দুটি মঙ্গল মিশন আছে নাসার। বিশ বছর ধরে চলা মার্স ওডিসি আর পনেরো বছর ধরে এমআরও। ২০৩০ সালের আগেই ওই দুটি মিশন সমাপ্ত হয়ে যাবে; টিকে থাকবে কেবল ম্যাভেন। সব ঠিক থাকলে আশা করা যায় ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত তথ্য পাঠাতে থাকবে ম্যাভেন। তার মানে, শ্যানন কারির হাতে বিরাট আর দীর্ঘমেয়াদী এক দায়িত্ব বর্তেছে। কিন্তু তাতে পৃথিবীবাসী কীভাবে লাভবান হবে?

বিজ্ঞানীরা এখন জানেন, এক সময় মঙ্গলের শতভাগ পৃষ্ঠ ঢাকা ছিল পানি বা তরলে। আজ থেকে ৪ বিলিয়ন বছর আগে মঙ্গল তার পানির তল হারাতে শুরু করে। গবেষকদের একটা বড় প্রশ্ন কোথায় গেল এই পানি? একই প্রক্রিয়ায় কি আমাদের প্রিয় পৃথিবীও একদিন পানিশূন্য ধূসর মরু হয়ে যেতে পারে? অনেকের অনুমান, যখন মঙ্গলে পানি ছিল, তখন সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়, কেননা পৃথিবীতেও প্রথম প্রাণ এসেছিল পানিতেই, কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল তারা?

প্রতি মুহূর্তে মঙ্গলপৃষ্ঠ থেকে কী পরিমাণ গ্যাস মহাশূন্যে হারিয়ে যাচ্ছে তা মনিটর করছে ম্যাভেন। এই ডেটা থেকেই গ্লোবাল ইকুইভেলেন্ট লেয়ার অফ ওয়াটার হিসেব করছে প্রতিনিয়ত, যা দিয়ে বোঝা যাবে, কী পরিমাণ পানি ছিল এখানে আর কীভাবেই বা নদী-সমুদ্রগুলো শুকিয়ে গেল।

এর বাইরে ম্যাভেন এক্সট্রিম কন্ডিশন বা চূড়ান্ত খারাপ অবস্থায় মঙ্গলের আবহাওয়া কীভাবে প্রতিক্রিয়া করে, তা গবেষণা করে চলেছে। এই চূড়ান্ত খারাপ পরিণতির জন্য দায়ী নতুন সোলার চক্র। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই এটি চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছবে। তখন শুরু হবে মঙ্গলের ধুলিঝড়। ২ সপ্তাহ থেকে ২ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এই ধুলিঝড় বা গ্লোবাল ডাস্ট স্টর্ম। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সৌরজগতের প্রথম বিলিয়ন বছরে এই ধুলিঝড়ই মঙ্গলের পানি বা ইতিবাচক জলবায়ুকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। অথচ সেসময় কোনো এক বিচিত্র উপায়ে বেঁচে গিয়েছিল পৃথিবী আর বুধ। কী সেই উপায়—তা জানাটা আমাদের টিকে থাকার জন্য জরুরি। নয়তো এমন ভয়াবহ সোলার স্টর্ম ভবিষ্যতে আবার হানা দিলে ধ্বংস হতে পারি আমরাও।

শ্যানন দায়িত্ব নেবার পর ওপরের কার্যক্রমের বাইরে ম্যাভেনের আরেক নতুন কার্যপ্রণালী ঠিক করেছেন—তা হলো, মঙ্গলপৃষ্ঠে চুম্বকীয় ক্ষেত্রের শক্তি এবং বিস্তার গবেষণা করা। কারণ শ্যাননের ধারণা এই চুম্বকীয় ক্ষেত্রই ধুলিঝড় বা আগ্নেয়গিরির মতো বিপর্যয় থেকে একটা গ্রহকে রক্ষা করে।

অবসরে যাওয়া জ্যাকস্কি বলেন, ‘নতুন প্রধান গবেষক শ্যানন কারি একাধারে গণিতবিদ, পরিসংখ্যানবিদ, স্পেস পদার্থবিদ এবং সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার। এই সব দক্ষতা তাকে ম্যাভেনের জন্য অপরিহার্য এবং সেরা নেতায় পরিণত করবে।’ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সেরা সমন্বয় ঘটাতে জানে সে, তাঁর চিন্তার দক্ষতা বা থট প্রসেস চমৎকার—অনুজ সম্পর্কে এই মন্তব্য ম্যাভেনের প্রাক্তন প্রধান গবেষক এবং জন্মদাতাদের একজন জ্যাকস্কির।

গবেষণা আর কাজের বাইরে শ্যানন কারি নামে এই তরুণীর সময় কাটে পর্বতারোহণ বা দৌড়ানোর ট্রেইলে। রক ক্লাইম্বং জিমেই স্বামীর সঙ্গে পরিচয় তাঁর। আগেই বলেছি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় নাসার প্রস্তাব গ্রহণ করতে একটুও দ্বিধা করেননি শ্যানন, বর্তমানে এক বছর বয়সী শিশুকে নিয়েই নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন নাসার অন্যতম মিশন ম্যাভেনকে।

লেখক: চিকিৎসক গ্রিনলাইফ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা