এলিয়েনের ‌ইতিকথা

খোদ বিজ্ঞানীমহলেই এলিয়েনের অস্তিত্ব নিয়ে রয়েছে তুমুল আগ্রহ, সেখানে সাধারণ মানুষের উৎসাহ প্রবল হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। রূপকথা বা পৌরণিক চরিত্রগুলোর মতোই এলিয়েনকে মানুষ সত্যসত্ত্বা হিসেবে কল্পনা করতে ভালোবাসে। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানরসিক লেখকরাও তাই এ নিয়ে প্রতি বছর ফেঁদে চলেছেন হাজার হাজার গল্প-উপন্যাস। কেউ কেউ এলিয়েন দেখার দাবিও করে বসেন, কেউ কেউ আবার ভালোবাসেন নিজেকেই এলিয়েন হিসেবে পরিচয় দিতে। অনেকে আবার পিরামিড বা স্টোনহেঞ্জের মতো প্রাকৃতিক রহস্যকেও এলিয়েনের কারসাজি বলে মনে করেন। আসলেই কি তাই...

সহজ আভিধানিক অর্থে ইংরেজিতে ‘এলিয়েন’ শব্দের অর্থ বহিরাগত বা ভিনদেশি, যা অনাত্মীয় বা স্বভাবের দিকে আলাদা হলেও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার বা প্রভাব যথেষ্ট। তবে তা আমরা যত সহজে এটাকে আমাদের দৈনন্দিনের ব্যবহার বা বিজ্ঞানচর্চার আওতায় ঢেলে সাজিয়েছি, তা মোটেই ততটা সহজসাধ্য নয়। কেননা আদি সমাজের চিন্তাবিদেরা এলিয়েনের বাস্তব অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। ড্রাগন-মারমেইড-সিসার্পেন্ট যতই আমাদের দৈনন্দিনের আলোচনায় আসুক না কেন, বাস্তবে এগুলো উপকথা, রূপকথা হিসেবেই আজ প্রতিষ্ঠিত।

জীবাশ্ম আলামতের ভিত্তিতে সাধারণভাবে জানা যায়, পৃথিবীতে মনুষ্য প্রজাতির আগমন ঘটেছিল ৩০ থেকে ৩৫ লাখ বছর আগে। তবে বিজ্ঞানী মহল আফ্রিকার এক প্রাচীনতম মনুষ্য প্রজাতির জীবাশ্ম পেয়েছেন, যার বয়স ৪২ লাখ বছর। যেকোনো প্রাণীর মতো সেসব প্রাচীন মানুষের প্রধান কাজ ছিল খাদ্য ও খাদ্য সংগ্রহপ্রক্রিয়া উদ্ভাবন। তা হলেও ‘মাথায় বড় মানুষ’ যে কল্পনাবিলাসী ছিল, তা–ও ঠিক। তারা অবসরে বসে আকাশে তাকিয়ে দেখেছে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা, হয়তো আরও অনেক কিছু। কল্পলোকে বিচরণ করেছে আরও বেশি।

আদি কল্পলোক—সেসব আদি মানুষ আকাশের চন্দ্র-তারা-সূর্য, হয়তো আরও কিছু ক্ষুদ্র আলোর সূত্র ধরে কল্পনাবিলাসী হয়েছে। হয়তো ভেবেছ, আমাদের পৃথিবীর মতো আরও অন্য গ্রহ-উপগ্রহ বা সেখানকার কোনো অন্য বসতির কথা। সেই রকম সব বানানো কথার সূত্র ধরে আমরা পাই, চাঁদে বসে এক বুড়ি সুতা কেটে চলেছে। এমনই সব কথামালা ও উপাখ্যানের সূত্রে আমরা গ্রিক লেখক অ্যালিস ও অ্যাক্সিমেন্দার ধ্যানধারণার সঙ্গে পরিচিত হই। তারা খ্রিষ্টপূর্ব ৬ থেকে ৭ শতাব্দীতেই অগণিত জনবসতি ভরা অন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থাকার কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে হয়তো আমাদের আজকের এই এলিয়ন খোঁজার যাত্রা শুরু। কিন্তু পরে অ্যারিস্টটল তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং টলেমিও জানান যে পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো মানুষের মতো প্রাণী থাকার সম্ভাবনা নেই। তবে আরও পরে ইহুদি লেখকেরা বহির্জগতীয় উৎসের সন্ধান দিয়েছিলেন। তালমুদ-এ প্রায় ১৮ হাজার পৃথিবীর উল্লেখ রয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে অষ্টাদশ শতাব্দীতে সেই সূত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, বহির্জগতে জীবন আছে এবং শুধু তা–ই নয়, এর মধ্যে কারও কারও মেধাবৃত্তিও রয়েছে, যা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তুলনীয়।

এরপর টেলিস্কোপ আবিষ্কার ও কোপারনিকাসের চিন্তাধারা ও প্রমাণাদির কারণে জ্যোতির্বিদ্যায় বহির্জাগতিক জীবনের অস্তিত্ব প্রসঙ্গটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। প্রাক্‌–আধুনিক এই ধ্যানধারণার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন ইতালীয় দার্শনিক ব্রুনো। ১৬০৯ সালে গ্যালিলিওর টেলিস্কোপীয় পর্যবেক্ষণে এ ধারণা সুদৃঢ় হয়।

সপ্তদশ শতাব্দীতে চেক জোতির্বিজ্ঞানী সিরলেকটস বলেন, বৃহস্পতিতে প্রাণ আছে। সেখানে বসবাসকারী প্রাণীর আকার-আকৃতিরও বর্ণনা দেন তিনি। পরে ইউরেনাস আবিষ্কারের পরে উইলিয়াম হার্সেল ঘোষণা দেন, আমাদের সৌরমণ্ডল ছাড়াও অন্য গ্রহপুঞ্জে বহিরাগত জনবসতি রয়েছে। সেই সময়কার প্রখ্যাত দার্শনিক কান্ট ও ফ্রাঙ্কলিন এই ধারণাকে সমর্থন করেন। এমন কল্পনাপ্রসূত ধ্যানধারণা শুধু প্রাচীন গ্রিক, রোমান ও অন্যান্য ধর্মীয় দেব-দেবতার বর্ণনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। বিখ্যাত লেখক এইচজি ওয়েলসের ১৮৯৭ সালে লেখা ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ড এবং ১৯৩৮ সালে ওরসন ওয়েলসের ইনভ্যাশন, ফ্রম মার্শ বই দুটিতেও এলিয়নের কাহিনিই প্রধান হয়ে উঠেছে।

এরপর এলিয়ন নিয়ে টিভি-শো-সিনেমা-সিরিয়ালে নানা কল্পকাহিনির হিড়িক পড়ে যায়।

সব মিলিয়ে বহির্বিশ্বের এলিয়েন বা উন্নত বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমাদের মধ্যে আরও বাড়ে। আর বাণিজ্যিকভাবে সেসব ছবি তৈরির মাত্রা প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। এসব নিয়ে তৈরি ছবি অস্কারের মতো সর্বোচ্চ স্বীকৃতিও পাচ্ছে। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড প্রচারণার মধ্য দিয়ে লক্ষণীয় হলো, প্রায় সর্বক্ষেত্রে ‘বহিরাগতরা’ আমাদের পৃথিবীতে আসে। তাহলে কি বহিরাগতরা আমাদের চেয়ে উন্নত ও বেশি সফল বা সক্ষম? অবশ্য মানুষের চাঁদে অবতরণ একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা।

এলিয়েনের বর্তমান ধারণা

বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা অন্য গ্রহ-গ্রহান্তরে ‘বহিরাগতের’ সম্ভাব্য উপস্থিতি নিয়ে উত্সাহী হয়ে পড়েন। ET (Extra-Terrestrial) প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড্রেক জানিয়েছেন, মহাবিশ্বের ছায়াপথে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন তারকারাজি রয়েছে, যারা বয়স ও গঠন আঙ্গিকের দিক দিয়ে সূর্যের কাছাকাছি। সেই হিসাব পরিসংখ্যানে ধরে নেওয়া যায় যে মহাবিশ্বে ৪০ বিলিয়ন তারকারাজিতে জীবনের অস্তিত্বের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ধরনের বিপুল অঙ্কের হিসাব বাদ দিয়ে তখনকার চিন্তাবিদেরা আমাদের সৌরমণ্ডলের চন্দ্র, শুক্র ও মঙ্গল গ্রহকে ‘বহিরাগত জীবন’-এর সম্ভাব্য স্থান হিসেবে ধরে নিয়েছেন। চাঁদে মানুষের পদার্পণের কারণে তা বাদ দিয়ে পর্যবেক্ষক দল এখন শুক্র ও মঙ্গলকে সম্ভাব্য স্থান হিসেবে ধরে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাসা (NASA), ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ESA) এবং পৃথিবীর বড় বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারগুলো এই লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। নানা জায়গায় তারা বসাচ্ছে অত্যন্ত শক্তিধর রেডিও টেলিস্কোপ। তবে এই গবেষণার লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রধান অন্তরায় হচ্ছে এদের সীমাহীন দূরত্ব।

এর মধ্যে ‘মঙ্গল গ্রহে প্রাণ’ আছে, এমন একটি সূত্র বিজ্ঞানীদের হাতে এসে পড়ে ১৯৮৮ সালে। ১৩ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে একটি উল্কাপিণ্ড (কোড নাম: ALH800) এসে পড়ে, যার বয়স ৩৬০ কোটি বছর। অণুবীক্ষণীয় পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তাতে স্থলচরে থাকা ব্যাকটেরিয়ার মতো বস্তু রয়েছে। এ পর্যায়ে নাসা ও স্ট্যানফোর্ড গবেষক দল ১৯৯৭ সালে জানায়, ‘মঙ্গল গ্রহে প্রাচীন জীবন থাকার সূত্রের যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। এর একটা কারণ, মঙ্গলে পানির অস্তিত্ব আছে বা ছিল বলে অনেক প্রমাণ আছে। পরীক্ষায় জানা গেছে, এই সূত্রকে কেন্দ্র করে নাসার ‘কিওরিসিটি’র বিশেষজ্ঞ মিশন আশা করছিল, ২০১৮ সাল নাগাদ মঙ্গলের মানব-মিশনের যথেষ্ট অগ্রগতি হবে।

এসব তথ্য-উপাত্ত অনুসরণ করে সাধারণভাবে একমত হয়েছেন যে পানিই জীবনের মৌলিক উপাদান। তাঁরা আরও বিশ্বাস করেন যে জটিল রাসায়নিক জীবনকথা (molecule life) সেই আদি পৃথিবীর পরিবেশের সাধারণ রাসায়নিক যৌগ ও পানি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল।

স্ট্যানলি মিলােরর (১৯৫৩) পরীক্ষণ ও সোভিয়েত গবেষক অপারিনের পর্যবেক্ষণে পাওয়া যায় যে প্রাচীন পরিবেশে পানিসহ নাইট্রোজেন, মিথেন, অ্যামোনিয়ার অস্তিত্ব ছিল। শক্তির আধার হিসেবে সূর্য, আগ্নেয়গিরিকে ধরে ‘আমিষ’ কণার সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা জানি, জীবনের মূল উপাদান কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন। এসব রাসায়নিক বস্তু দীর্ঘ সময়ে সন্নিবেষ্টিত হয়ে জীবনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ‘কোষের মতো’ আকৃতির সূত্রপাত হয়। এই অঙ্গাণুগুলো শিশু পৃথিবীর ‘আদি-সুপ’ থেকে খাদ্য-রসদ সংগ্রহ করে বেড়ে ওঠে এবং বিভক্ত বা প্রজননক্ষম হয়। পৃথিবীতে প্রায় ৪০০ কোটি বছরের আগে ‘এককোষী’ প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেছিল বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে DNA/RNA-এর সংগঠনই জীবনের প্রধান মৌলিক অণু, যার একটি ডিএনএ দ্বিসূত্রক অন্য আরও দুটি সূত্রক তৈরি করতে সক্ষম। আমাদের জানামতে, আর অন্য কোনো অণুও তা পারে না। একই প্রসঙ্গে এক সুতিকাবিশিষ্ট আরএনএ-এর বিভক্তির কথাও এসে যায়।

মহাবিশ্বে জীবনের সন্ধান করতে গেলে এ সত্যটি আমাদের মনে রাখতে হবে। অর্থাৎ জীবন সৃষ্টি ও এর পরবর্তী সংস্করণ যেমন যেখানেই হোক না কেন, তা হতে হবে সেখানকার রাসায়নিক ও জৈব রাসায়নিক খনিজ বস্তুকণা দিয়ে। তবে সেখানকার জীবনের সাংঘটনিক চক্রে পৃথিবীর খনিজ কণার ছাড়া অন্য কিছুও হতে পারে। অন্যদিকে বুদ্ধিমান বহিরাগতের আচার-আচরণ বা রূপান্তর ধারার পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা, লাখো–কোটি–কোটি তারকা বা গ্রহপুঞ্জের অনেক কিছুই এখনো আমাদের অজানা। তবে কার্ল সাগানের ভাষায় ‘দ্য ইউনিভার্স অ্যাবান্ডস উইথ দ্য কেমিস্ট্রি অব লাইফ। ’

বহিরাগত বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণী সন্ধানের নানা প্রকল্প যেমন, ET, SETI, META, BETA ইত্যাদি দল অতি উন্নত মানের বিজ্ঞান গবেষণা ও অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমে আমাদের সৌরমণ্ডলের কাছাকাছি কিছু গ্রহাণপুঞ্জের সন্ধান দিয়ে চলেছে। কেননা সেসবে পানির সন্ধান পেয়েছেন বলে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রের সবকিছুই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

এসব গবেষণা সূত্রে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসার ৫০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেন, ‌‘বহির্বিশ্বে প্রাচীনতম জীবন রয়েছে, তবে বুদ্ধিদীপ্ত জীবন যথেষ্ট বিরল ক্ষেত্রে হতে পারে। তবে সেই বহিরাগতের ডিএনএ যদি আমাদের চেয়ে আলাদা হয়, সে ক্ষেত্রে পৃথিবীতে থাকা প্রাণের ক্ষেত্রে তা ভয়ের কারণ হতে পারে। যেমন রোগবালাই, মসিবত অন্য রকমের হওয়ায়ও স্বাভাবিক।’

মহাবিশ্বের এই গবেষণা শাখা আপাতত তেমন সফলতা না পেলেও হাইটেক বিজ্ঞানের নানা শাখা ও নতুন নতুন প্রযুক্তিগত যে উদ্ভাবন হচ্ছে, এর মূল্যই বা কম কী? লেগে থাকলে সফলতা আসে, এটা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা।

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন