এলিয়েন শব্দটার আক্ষরিক অর্থ ‘ভিনদেশি’ বা ‘বিদেশি’ হলেও আমরা কিন্তু এলিয়েন বলতে বুঝি অন্য গ্রহের প্রাণী। অবশ্য মার্কিন নাগরিকদের অনেকে নিজের দেশকেই মনে করে সমগ্র পৃথিবী এবং অন্য দেশ থেকে যারা যুক্তরাষ্ট্রে আসে, তাদের তারা ‘এলিয়েন’ বলে ডাকে। কল্পবিজ্ঞান লেখকদের হাতে অতি উন্নত এলিয়েনের জন্ম হয়েছে ঠিক, কিন্তু পৃথিবীতে অন্য গ্রহ-নক্ষত্র থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী আসার ধারণাটা আরও প্রাচীন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোককাহিনিতে অবিশ্বাস্য ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণীর অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা আছে। সেসব কাহিনিতে অন্য গ্রহ থেকে প্রাণী শুধু নয়, পুরো গ্রহ-নক্ষত্রগুলোই পৃথিবীতে চলে আসে মানুষের বেশে। সূর্য, চাঁদ, মঙ্গল, শনি—এসবের বিজ্ঞান জানার পরও এখনো অনেক মানুষ বিশ্বাস করে, এগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। কয়েক হাজার বছর আগে পৃথিবী ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের সঠিক কোনো ধারণা ছিল না, তখন ভয় ও অজ্ঞানতা থেকে অনেক অন্ধবিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল। পরে বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অনেক অন্ধবিশ্বাসের অবসান হলেও কিছু ব্যাপারে মানুষের বিশ্বাস এখনো রয়ে গেছে। এলিয়েনের বিশ্বাস হলো সেগুলোর অন্যতম।
পৃথিবী ছাড়াও অন্য আরও অনেক গ্রহে প্রাণী আছে এবং তারা মানুষের চেয়েও উন্নত—এ রকম কথায় বিশ্বাস করে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক পোস্ট পত্রিকা পৃথিবীর ২৪টি দেশের ২৬ হাজার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদনে দাবি করে যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ বিশ্বাস করে এলিয়েন আছে এবং তারা মানুষের চেয়ে উন্নত। মাত্র ২৬ হাজার মানুষ ৭০০ কোটি মানুষের হয়ে মত দিতে পারে না, সেটা আমরা জানি। কিন্তু জরিপগুলো এ রকমই হয়। নিজেদের চারপাশের মানুষের মতামত নিলেও আমরা দেখব, বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক মানুষ মাঝেমধ্যে দাবি করে যে তাদের সঙ্গে এলিয়েনের দেখা হয়েছে, কিংবা এলিয়েনরা এসে তাদের কোথাও ধরে নিয়ে গেছে, কিংবা অবিশ্বাস্য অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে। অনেক গুপ্তহত্যাকাণ্ডকেও এলিয়েনের কাজ বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকেই ইউএফও বা unidentified flying object বা উড়ন্ত চাকতি দেখেছেন বলে দাবি করেন। এলিয়েনের সঙ্গে মানুষের সাক্ষাৎ ঘটার ব্যাপারটা যে পুরোপুরি বানানো, সেটা মানতে রাজি নন অনেকে। এই অনেকের মধ্যে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও আছেন। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাইকিয়াট্রির প্রফেসর জন ম্যাক বিশ্বাস করতেন, এলিয়েনরা আছে এবং তারা মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করে। এ নিয়ে অ্যাবডাকশান: হিউম্যান এনকাউন্টার উইথ এলিয়েনস নামে একটা ঢাউস বইও লিখেছিলেন তিনি। বইটাতে যেসব ঘটনা উল্লেখ করেছেন, সেগুলো সবই মানুষের সঙ্গে এলিয়েনের সংযোগ, সংঘাত ইত্যাদি নিয়ে এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে এগুলো সত্য ঘটনা।
কিন্তু বিশ্বাস আর প্রমাণ এক জিনিস নয়। প্রমাণ করা না গেলে সেটা আর যা–ই হোক, বিজ্ঞান নয়। কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করলেও কিংবা জন ম্যাকের মতো পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী–লেখক বললেও প্রমাণ না পেলে এলিয়েনকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা এখনো কোনো ইউএফওর প্রমাণ পাননি, খুঁজে পাননি এলিয়েনের অস্তিত্ব।
কিন্তু এত বড় মহাবিশ্বের এত এত নক্ষত্রের কোটি কোটি গ্রহ-উপগ্রহের মধ্যে আমাদের পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও কি প্রাণের উদ্ভব ঘটেনি? মহাবিশ্বে পৃথিবী কি আসলেই একা? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা এলিয়েনের অস্তিত্ব খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন অনেক অনেক বছর থেকে, যখন থেকে মহাবিশ্বের স্বরূপ বুঝতে পেরেছেন, তখন থেকে। আমাদের মহাবিশ্বের আয়তন বিশাল। সবচেয়ে বড় আয়তন কত হতে পারে, তার একটা হিসাব আমরা সহজে করে নিতে পারি। প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৪০০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং থেকে উদ্ভব হওয়ার পর মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। সর্বোচ্চ বেগ আলোর বেগেও যদি এটা প্রসারিত হয়, তাহলে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত সর্বোচ্চ দূরত্ব হতে পারে ১ হাজার ৪০০ কোটি আলোকবর্ষ, অর্থাৎ ১ হাজার ৪০০ কোটি বছরে আলো যত দূর যেতে পারে, ততটুকু। সেভাবে হিসাব করে যে আয়তন পাওয়া যায়, সেখানে আনুমানিক ১০০ বিলিয়ন (মতান্তরে ২০০ বিলিয়ন) গ্যালাক্সি আছে। প্রতিটি গ্যালাক্সিতে আছে প্রায় ১০ হাজার কোটি সূর্য। সুতরাং মহাবিশ্বে যত সূর্য আছে, তাদের মোট সংখ্যা পৃথিবীতে মোট যত বালুকণা আছে, তার চেয়ে শত গুণ বেশি। সেসব সূর্যের সব গ্রহ ও উপগ্রহের মোট সংখ্যা যে কত হবে, তা ভেবে দেখার বিষয়। এত বিশালসংখ্যক গ্রহ-উপগ্রহের মধ্যে শুধু পৃথিবীতেই প্রাণের উদ্ভব হয়েছে আর কোথাও হয়নি, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
কিন্তু প্রশ্ন সেখানেই, অন্য গ্রহের প্রাণীগুলো তাহলে কোথায়? কল্পকাহিনি ছাড়া বাস্তবে তাদের প্রমাণ নেই কেন? নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি এই প্রশ্ন করেছিলেন ১৯৫০ সালে। এলিয়েনের অস্তিত্ব সম্পর্কে ফার্মির মন্তব্য, ‘তারা সব কোথায়?’ ক্রমে পরিণত হয় প্যারাডক্স বা কূটাভাসে, যা ‘ফার্মি প্যারাডক্স’ নামে পরিচিতি লাভ করে। গ্যালাক্সিজুড়ে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মাইক্রোওয়েভ বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করতে শুরু করেন ষাটের দশকের শুরুতে। ১৯৬১ সালে মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ড্রেক মহাবিশ্বে পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজের পাওয়ার সম্ভাবনার একটি যুগান্তকারী সমীকরণ দেন। সেটা ড্রেক সমীকরণ নামে বিখ্যাত। ড্রেক ধারণা দেন যে বিশাল এই মহাবিশ্বের অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব থাকলেই যে আমরা তা খুঁজে পাব, এমন কোনো কথা নেই। খুঁজে পেতে হলে তাদের আমাদের সমান বা আমাদের চেয়েও উন্নত হতে হবে। তাই আমাদের দেখতে হবে, আমাদের মতো সভ্যতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা মহাবিশ্বের আর কোথায় আছে। ড্রেকের সমীকরণটি লেখা হয় এভাবে: N = R* x fp x ne x fl x fi x fc x L—অর্থাৎ মহাবিশ্বে সভ্যতার সম্ভাবনাময় জায়গার সংখ্যা (N) হলো নক্ষত্র সৃষ্টির হার (R*), সেই নক্ষত্রগুলোর মধ্যে গ্রহ থাকার সম্ভাবনা (fp), গ্রহগুলোর মধ্যে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা (fl), প্রাণসম্পন্ন গ্রহগুলোর মধ্যে সভ্যতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা (fc) এবং সেই সভ্যতা কত বছর টিকে থাকবে (L), তার সংখ্যার গুণফলের সমান। এই সমীকরণ অনুযায়ী হিসাব করে দেখা গেল, মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার মতো সভ্যতাসম্পন্ন গ্রহের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। কিন্তু সমস্যা হলো, সমীকরণের প্রতিটি উপাদানই অনুমাননির্ভর। ১৯৬১ সালে ফ্রাঙ্ক ড্রেক এবং আরও কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর উদ্যোগে শুরু হয় সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা সেটি প্রকল্প। ১৯৭৫ সালে নাসা এই প্রকল্পকে স্বীকৃতি দেয় এবং প্রকল্পের অর্থ ও কারিগরি সহায়তা দিতে শুরু করে। নাসার সহায়তার বাইরেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে সেটির বিভিন্ন প্রকল্প চালানো হয়। ১৯৮৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় গঠিত হয় সেটি ইনস্টিটিউট। ১৯৮৮ সালে নাসার উদ্যোগে সেটি প্রকল্পের জন্য যন্ত্রপাতি প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত নাসা সেটি প্রকল্পের সহায়তাকল্পে প্রজেক্ট অরিয়ন, মাইক্রোওয়েভ অবজারভিং প্রজেক্ট, হাই রেজল্যুশন মাইক্রোওয়েভ সার্ভে সিস্টেম–সহ বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেয়, যার সব কটিরই উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া। কিন্তু আশা জাগানোর মতো কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ১৯৯৩ সালে মার্কিন কংগ্রেস সেটি প্রকল্প বাতিল করে দেয়। নাসার সহায়তা না পেলেও সেটি ইনস্টিটিউট তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে। কিন্তু মহাবিশ্বের আর কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি এখনো।
তাই বলে বিজ্ঞানীরা হাল ছেড়ে দেননি, বরং আরও জোরেশোরে কাজ শুরু হয়েছে। মাত্র তিন সপ্তাহ আগে (১১ মার্চ ২০১৯) মার্কিন সরকার নাসার ইউরোপা ক্লিপার মিশনের জন্য ৬০ কোটি ডলার দিয়েছে। এই মিশন বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপায় প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধান করবে। ২০২৩ সালে এই মিশন পাঠানো হবে ইউরোপায়। বৃহস্পতির বরফাচ্ছন্ন উপগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা খুব আশাবাদী। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সিও জুপিটার আইসি মুনস এক্সপ্লোরার বা জুইসি (JUICE) প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২০২২ সালে তারা স্যাটেলাইট পাঠাবে সেখানে। প্রাণের উদ্ভব ঘটার জন্য যা যা দরকার, তার কী কী আছে সেখানে, তা খুঁজে দেখবে জুইসি। এখানেও যদি প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া না যায়, তখন কী হবে? আরও চেষ্টা চলবে। অবশ্য কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, এলিয়েনরা মানুষের চেয়ে এত বেশি চালাক যে মানুষের সাধ্য নেই তাদের খুঁজে বের করে। আবার কেউ কেউ আরও এক কাঠি বাড়িয়ে বলে ফেলেন, এলিয়েনরা এই পৃথিবীতেই আছে মানুষের বেশে, হয়তো আপনার আশপাশেই ঘুরছে, আপনি চিনতে পারছেন না। কিন্তু আপনি যদি বিজ্ঞান চিন্তা করেন, তাহলে আপনি প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছুই বিশ্বাস করবেন না। কারণ, যা প্রমাণ করা যায় না, তা বিজ্ঞান নয়।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, স্কুল অব বায়োমেডিকেল সায়েন্সেস, আরএমআইটি, মেলবোর্ন,অস্ট্রেলিয়া