গ্রহের আকাশ, গ্রহের বাতাস

একটি গ্রহ বাসযোগ্য বা প্রাণধারণের উপযোগী কি না কিংবা সেখানে প্রাণ বিকশিত হয়েছে কি না, সেটা দূর থেকে পৃথিবীতে বসে জানার উপায় কী? এত দূর থেকে অন্য নক্ষত্রের অন্য গ্রহকে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। তদুপরি বর্ণালি বিশ্লেষণের বিবিধ আধুনিক কারবার থেকে যদিও-বা খুঁজে পাই, অত দূরের গ্রহকে ‘দেখা’ যায়? তাহলে সেখানে প্রাণের অস্তিত্বের খবর পাবেন কী করে? মহাশূন্য থেকে, এমনকি লো আর্থ অরবিট থেকেও পৃথিবীর বড় দালান-কোঠা, চীনের প্রাচীর দেখা মুশকিল। চাঁদ থেকে কিছুই দেখা যায় না, শুধু খুব বড় মাত্রার উদ্ভিজ্জ, সমুদ্র বা পর্বতমালা ব্যতীত। তাহলে দূরান্তের আগন্তুক এলিয়েন জানবে কী করে যে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব আছে? সৌভাগ্যবশত এই কাজে গ্রহের বায়ুমণ্ডল বা বাতাবরণ সাহায্য করতে পারে। দূর গ্রহের বাতাস আপনি পরখ করবেন কী করে?

আমরা জানি, বুধ বা শুক্র গ্রহ সূর্যের বর্ণমণ্ডলের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে এবং পৃথিবী থেকে আমরা সেটা পর্যবেক্ষণ করি। এটি একটি স্বাভাবিক মহাজাগতিক ঘটনা। এই একই ঘটনা যখন মহাজাগতিক গ্রহের বেলায় ঘটে, তখন গ্রহটি তার নক্ষত্রের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে। এবার পৃথিবী থেকে যদি ঘটনাটি এমন সুবিধাজনকভাবে দেখা যায়, তাহলে নক্ষত্রের আলোকরশ্মি গ্রহের বাতাবরণ ভেদ করে আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারে। তখন সে আলোর বর্ণালি বিশ্লেষণ করে আমরা ওই গ্রহের বাতাবরণে কী আছে তার হদিস পাই।

ফলে দূর গ্রহের বাতাসে কী ঘটছে, তার একটি চমত্কার বিশ্লেষণ আমরা এভাবে করতে পারি। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আমরা ধরে নিচ্ছি পৃথিবীতে আমরা যে পদার্থবিদ্যা বা রসায়ন পর্যবেক্ষণ করি, দূর গ্রহান্তরেও ঠিক তা-ই কাজ করে, সেভাবেই কাজ করে। কাজেই পৃথিবীতে প্রাণের যে জৈব-রাসায়নিক প্রপঞ্চ আমরা প্রত্যক্ষ করি, তার নিরিখেই, পৃথিবীতে প্রাণ বলতে আমরা যা বুঝি, সেই একই প্রপঞ্চ দূর গ্রহের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। কাজেই পৃথিবীতে যেমন অক্সিজেন এবং ওজোনকে প্রাণের উপস্থিতির আবশ্যক স্বাক্ষর হিসেবে আমরা জানি; অতএব, ধরে নিতে পারি, দূরান্তের গ্রহের বাতাসে যদি এদের দেখা যায়, তবে প্রাণের সপক্ষে কিছু একটা পাওয়া গেল। অন্তত প্রাণের সন্ধান যে সোনার পাথরবাটি গোছের কিছু নয়, সেটা অন্তত প্রতীয়মান হয়।

প্রশ্ন হলো, এসব বিশেষ মৌল বা যৌগের উপস্থিতি কি সত্যিই প্রাণের আবশ্যক স্বাক্ষর, নাকি অজৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও এদের উপস্থিতি সম্ভব? ষাটের দশকে এসব রাসায়নিক প্রশ্ন নিয়ে যারপরনাই ভাবিত ছিলেন জেমস লাভলক। বহির্বিশ্বে প্রাণের একটি গ্রহণযোগ্য এবং বাস্তবতাভিত্তিক সংজ্ঞায়নে তাঁর প্রবন্ধগুলো আজও দিশারি হয়ে আছে। অবশ্য তাঁর এই অনুসন্ধিত্সার মূলে ছিল নাসার ভাইকিং মিশন, যা মঙ্গলে গিয়ে অনুসন্ধান চালাবে বলে ভাবা হচ্ছিল। সেই সময়ের মিশন সায়েন্টিস্টরা নানাবিধ যান্ত্রিক নকশা নিয়ে উত্সাহী ছিলেন, যা মঙ্গলের মাটি খোঁড়াখুঁড়ি কিংবা পোকামাকড় ধরার কৌশল হবে। কিন্তু লাভলক জোর দিয়েছিলেন মঙ্গলের লঘু বাতাবরণকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের ওপরে। বলেছিলেন, মাটি খুঁড়ে পোকা খোঁজার চেয়ে মঙ্গলের বাতাসকে বোঝার চেষ্টা করলেই মোক্ষ সিদ্ধি হবে। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখান, যে মঙ্গলের লঘু বাতাবরণ রাসায়নিক সুস্থিতির খুব কাছাকাছি (পরে সেটা ভাইকিং ১ ও ২ খুঁজে পায়)। এটা সেখানে কোনো প্রাণবন্ত সত্তার ইঙ্গিতবহ নয়। অর্থাৎ সেখানে এমন কোনো কৌতূহলোদ্দীপক রাসায়নিক ঘটনা ঘটছে না, যেটার জন্য কোনো প্রাণের উপস্থিতি দায়ী।

পৃথিবীতে যেমন ঘটেছে, বহুকোষী প্রাণীর আবির্ভাবের ফলে বাতাসে অক্সিজেন এবং ওজোনের পরিমাণ ক্রমশ বেড়েছে। তাই পৃথিবীর বাতাবরণের এই কমপোজিশন প্রাণের উপস্থিতি নির্দেশ করে। এই প্রাণ যদি কোনোক্রমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তবে বাতাসের অক্সিজেন এবং ওজোনও দ্রুতই হারিয়ে যাবে। কেননা এরা বাতাসের অন্যান্য মৌল এবং যৌগের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে দ্রুতই সাম্যাবস্থায় পৌঁছাবে। আমাদের আবহাওয়ায় যেহেতু এটা হয় না, তার অর্থ কিছু একটা কাজ করছে, যা প্রতিনিয়ত এই গ্যাসগুলো সাপ্লাই দিয়েই যাচ্ছে, এই সতত কর্মশীল ইঞ্জিন জীবন্ত প্রাণসত্তা ভিন্ন আর কী হতে পারে? আরও দেখা গেছে, পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্বের ঋতুভেদে তারতম্য ঘটে। গ্রীষ্মকাল প্রচুর গাছগাছালি, বৃক্ষগুল্ম দ্বারা বেষ্টিত থাকে, কিন্তু শীতকালে অনেক গাছই পাতা ঝরিয়ে দেয় (পর্ণমোচী বৃক্ষ)। ফলে CO2 ঘনত্ব ওঠানামা করে, যেটা প্রাণের উপস্থিতির আবশ্যক স্বাক্ষর।

দুই

আরও একটা মজার ব্যাপার আছে। উদ্ভিদে সালোকসংশ্লেষণ যখন ঘটে, সূর্যের আলোর বর্ণালির দৃশ্যমান অংশে বেশি শোষণ ঘটে, অবলোহিত বা ইনফ্রারেড অংশে প্রায় শোষণই হয় না বলতে গেলে। ফলে বর্ণালির অবলোহিত অংশ (ইনফ্রারেড আলো বিদ্যুৎ-চুম্বক বর্ণালির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দীর্ঘতম অংশ; কিন্তু কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য যাদের, তারা নীলচে আলোর; বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্য যাদের, তারা লালচে বা লালের দিকের আলো, অবলোহিত আলো আমরা চোখে দেখি না) প্রতিফলিত হয়। মহাশূন্য থেকে স্যাটেলাইট দিয়ে যদি পর্যবেক্ষণ করা হয়, প্রতিফলিত আলোর তীব্রতাকে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সাপেক্ষে প্লট করলে দেখা যাবে তরঙ্গদৈর্ঘ্য যখন দীর্ঘতর (অবলোহিত) থেকে হ্রস্বতর (নীল আলোর দিকে) অংশে যায়, তখন তীব্রতা হঠাৎ কমে যায়। যেহেতু এই তীব্রতা লাল আলোর কাছাকাছি গিয়ে ঝপ করে পড়ে যায়, তাই এর নাম লাল-খাঁড়ি (Red edge)। গাছের পাতার এই প্রতিফলন প্রপঞ্চ প্রাণের সুস্পষ্ট স্বাক্ষর।

মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বাতাবরণ পর্যবেক্ষণের কয়েকটি উদাহরণ এ বিষয়ে শিক্ষণীয় হতে পারে। এপ্রিল ১৯৬৯-এ নিম্বাস-৩ নামের একটি কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়। তার কাজ ছিল ১,০০০ কিলোমিটার ওপর থেকে পৃথিবীর বাতাবরণ পরীক্ষা করা। স্যাটেলাইটটিতে যেসব যন্ত্রপাতি ছিল, তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হলো IRIS নামের বর্ণালিমাপক যন্ত্র। পৃথিবীর থেকে প্রতিফলিত আলো বিশ্লেষণ করে কী কী রাসায়নিক মৌল ও যৌগ পাওয়া গেল, তা বিশ্লেষণ করাই এই যন্ত্রটির কাজ। যন্ত্রটির সাহায্যে পানি-বাষ্প, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ওজোন ইত্যাদির অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। তার কারণ হলো এই মৌল বা যৌগদের সুনির্দিষ্ট শোষণরেখা বর্ণালির ইনফ্রারেড অংশে পাওয়া যায়।

কিন্তু অন্য মৌল, যেমন নাইট্রোজেন (৭৮% উপস্থিত) বা অক্সিজেন (২১% উপস্থিত) এই যন্ত্রে ধরা পড়ে না, কেননা এই দুটি মৌল অবলোহিতে কিছু নিঃসরণ করে না। IRIS যন্ত্রটির মূল লক্ষ্য হলো পৃথিবী থেকে প্রতিফলিত আলোর বিশ্লেষণ। এই প্রতিফলন থেকে গ্রহের বাতাবরণের গভীরে কী প্রক্রিয়া-বিক্রিয়া চলছে, তার স্বাক্ষর পাওয়া সম্ভব হয়। ফলে দূর থেকে অন্য গ্রহের বাতাবরণ থেকে প্রতিফলিত বা প্রতিসৃত আলোর বর্ণালি বিশ্লেষণ করে আমরা গ্রহের পৃষ্ঠে কী ঘটনা চলে তার সম্ভাবনা আন্দাজ করতে পারি। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘গ্যালিলিও’ নভোযানটি পৃথিবীর পাশ দিয়ে উড়ে যায়। এ ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে এই নভোযানটি পৃথিবীকে কীভাবে দেখেছে, সেটা অন্য কোনো গ্রহ/উপগ্রহে প্রাণী আছে কি না, থাকলে আমরা কী ধরনের সংকেত পেতে পারি—সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আভাস দিয়ে থাকে। বিদ্যুৎচুম্বক বর্ণালির বিভিন্ন অংশে ‘গ্যালিলিও’ নভোযানটি পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করে। এখানে আমরা সেই পর্যবেক্ষণগুলো লিপিবদ্ধ করছি—

এক. ০.৭৬ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে পৃথিবীর উজ্জ্বলতার প্রাবল্য আকস্মিক হ্রাস পায়। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্য আণবিক অক্সিজেনের শোষণরেখা নির্দেশ করে। এই শোষণের পরিমাণ অন্য যেকোনো গ্রহের চেয়ে অনেক বেশি। তার অর্থ এই যে পৃথিবীর বাতাবরণে প্রচুর অক্সিজেন আছে। এটা আমরা সবাই জানি। পৃথিবীর ভূত্বকে যে শিলাস্তরগুলো আছে, তা অক্সিজেনের সাহায্যে জারিত হয়। এই জারণক্রিয়ায় অক্সিজেন শোষিত হয়। এ ছাড়া আরও কিছু প্রক্রিয়া আছে, যাদের সাহায্যে অক্সিজেন শোষিত হতে পারে। কিন্তু বাতাবরণে অক্সিজেনের এই বিপুল সম্ভারের জন্য চাই সবুজ জীবন, যা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অক্সিজেন সরবরাহ করছে।

দুই. পৃথিবীর মহাদেশগুলোর বর্ণালি রেখায় ০.৭ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে একটি শক্তিশালী শোষণরেখা দেখা যায়। এটি সবুজ রঙের ক্লোরোফিল, যাকে ব্যবহার করে দৃশ্যমান বর্ণালির আলোককণা বা ফোটন পানিকে ভেঙে আণবিক অক্সিজেন বিমুক্ত করে। এটাই সবুজ জীবন; এরা সবুজ, কেননা ক্লোরোফিল লাল ও নীল তরঙ্গ শোষণ করে, কিন্তু সবুজ তরঙ্গ প্রতিফলন করে। ক্লোরোফিলের উপরিউক্ত লাল আলোর শোষণরেখাটি তাই একই সঙ্গে অক্সিজেনের প্রাধান্য এবং ‘সবুজ জীবনের’ প্রতিনিধিত্ব করে।

তিন. ‘গ্যালিলেও’ নভোযানের অবলোহিত স্পেক্ট্রোমিটারে অতিসামান্য (এক মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ) মিথেনের আস্তিত্ব ধরা পড়ে। বাতাবরণে যে মিথেন থাকে, তা অক্সিজেনের দ্বারা জারিত হয়ে পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করে। তাই সাধারণ অবস্থায় বায়ুমণ্ডলে একটু ফোঁটাও মিথেন থাকার কথা নয়। কিন্তু তাহলে এরা আসছে কোত্থেকে? আজ আমরা জানি, বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার বিপাকক্রিয়ার অংশ হিসেবে মিথেন তৈরি হয়। এরাই বায়ুমণ্ডলে মিথেন ছড়িয়ে দেয়। তাই মিথেনের এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ উপস্থিতি প্রাণের অস্তিত্ব বোঝায়।

চার. নভোযানটির প্লাজমা-ওয়েভ যন্ত্র ন্যারো-ব্যান্ড এএম রেডিও-সংকেত ডিটেক্ট করেছে। এটি আর কিছুই নয়, আমাদের সর্বজনীন রেডিও সম্প্রচার। আয়নমণ্ডল ভেদ করে এসব সম্প্রচারের কিছু অংশ মহাশূন্যে ছাড়িয়ে পড়ে। কাজেই পৃথিবীর পাশ দিয়ে কোনো নভোযান গেলে সে এসব কৃত্রিম রেডিও তরঙ্গ ধরতে পারবে এবং বুঝবে এই গ্রহে রেডিও সম্প্রচারে সক্ষম বুদ্ধিমান সভ্যতার অস্তিত্ব আছে।

কাজেই ‘গ্যালিলিও’ নভোযান যে নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষাটি পৃথিবীর ওপর করল, তা থেকে প্রাণের উপস্থিতির চারটি সুন্দর লক্ষণ আমরা জানতে পারলাম।

তিন

প্রথমেই মঙ্গল গ্রহের কথা মনে আসে। মঙ্গলে একাধিক নভোযান, ল্যান্ডার, অরবিটার পাঠিয়ে প্রাণ সম্পর্কে সুনিশ্চিত কোনো তথ্য বা প্রমাণ আমরা পাইনি। প্রথমত, এর বাতাবরণে এমন কোনো রাসায়নিক স্বাক্ষর পাওয়া যায় না, যার পরিমাণ স্বাভাবিক রাসায়নিক সাম্যাবস্থায় যেটুকু থাকার কথা তার বিপরীত। দ্বিতীয়ত, এর পৃষ্ঠের বর্ণালিতে আমরা লালচে রং শোষণকারী কোনো পিগমেন্টের উপস্থিতি পাইনি। তৃতীয়ত, মঙ্গল থেকে কোনো মডুলায়িত রেডিও বার্তা আমরা পাইনি। শেষত, মঙ্গলে প্রেরিত ল্যান্ডার ও অরবিটারসমূহ এমন কোনো রাসায়নিক সংকেত দেখায়নি, যা প্রশ্নাতীতভাবে জীবনের উপস্থিতি নির্দেশ করে। মঙ্গলের পর বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা এবং শনির উপগ্রহ টাইটানে সম্ভাব্য জীবনের উত্স খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত আছে। ইউরোপার পৃষ্ঠ বরফাচ্ছাদিত। কিন্তু বরফাচ্ছাদিত ভূত্বকের অভ্যন্তরে একটি ঈষদুষ্ণ তরল সমুদ্র আছে বলে মনে হয়। বৃহস্পতি গ্রহের প্রবল টানাপোড়েনে যে জোয়ার-বলের সৃষ্টি হয়, সেটা ইউরোপাকে ভূগাঠনিকভাবে সক্রিয় রাখে। তাই এই উপগ্রহে টেকটোনিক সক্রিয়তা বেশি। এই সক্রিয়তাই এর ভূ-অভ্যন্তরকে গরম রাখে। এ রকম পরিবেশে প্রাথমিক জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব।

শনির উপগ্রহ টাইটানের বাতাবরণ পৃথিবীর তুলনায় প্রায় দেড় গুণ বেশি চাপ দেয়, এতে আণবিক নাইট্রোজেনের আধিক্য দেখা যায়, সর্বোচ্চ প্রায় দশ শতাংশের মতো নাইট্রোজেনের উপস্থিতি দেখা যায়। এর আকাশ লালচে-কমলা রঙের অস্বচ্ছ কুয়াশায় আচ্ছন্ন দেখা যায়। এর পৃষ্ঠ তাপমাত্রা মাইনাস ১৭৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, বাতাবরণে হাইড্রোকার্বন ও নাইট্রাইল যৌগের উপস্থিতি দেখা যায়। এ রকম একটি পরিবেশে জটিল জৈব যৌগ তৈরি হতে বাধ্য এবং কার্ল সেগান ও তাঁর সহযোগীরা দেখিয়েছেন যে বিশেষ একধরনের জটিল জৈব যৌগের উপস্থিতি টাইটানের বর্ণালি রেখার সুন্দর ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম। দেখা গেছে, টাইটানের বায়ুমণ্ডলের হাইড্রোজেন নিচের দিকে অর্থাৎ ভূত্বকের দিকে পড়তে থাকে। হাইড্রোজেনের এই নিম্নমুখী প্রবাহ কিন্তু পৃষ্ঠে এসে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যায়।

ড্যারেল স্ট্রোবেল দেখিয়েছেন, টাইটানের হ্রদগুলোতে যদি মিথেনখেকো প্রাণী থাকে, তবেই হাইড্রোজেনের এই হারিয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। এ বিষয়ে আরও প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। মঙ্গল, ইউরোপা ও টাইটান ছাড়া সৌরজগতের অন্যত্র প্রাণের সম্ভাবনা বিরল। যদিও গ্রহাণু ও উল্কাতে জৈব যৌগ পাওয়া গেছে কিন্তু এরপরও মনে হয় না এরা প্রাণের বসবাসের উপযোগী। আন্তনাক্ষত্রিক ধূলিতে চার ডজনের বেশি জৈব যৌগের নিশ্চিত উপস্থিতি পাওয়া গেছে—বিভিন্ন ধরনের পলিসাইক্লিক অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোজেন, ফরমালিন অ্যামাইন, অ্যালকোহল ইত্যাদি।

গ্রহের বাতাবরণ থেকে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও মডেল নির্ধারণে গ্রহটির গঠন, রাসায়নিক প্রকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে আগেভাগেই কিছুটা জানা থাকা দরকার। যেমন পৃথিবীর বাতাবরণ সম্পর্কে আমরা যতটুকু জেনেছি সেটাও বিশ্লেষণ জরুরি। ৪৫০ কোটি বছর পূর্বে যখন পৃথিবী প্রথম তৈরি হয়েছিল, তখন সম্ভবত তার বায়ুমণ্ডল পূর্ণ ছিল হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামে। যে ভ্রূণ-গ্রহ ডিস্ক (Proto-planetary disc) থেকে পৃথিবীসহ সৌরজগতের অন্যান্য বাসিন্দার জন্ম, সেই ডিস্কে সম্ভবত এই দুই গ্যাসই প্রধান ছিল। আদিম এই বাতাবরণ বেশি দিন টিকে থাকার কথা নয়। কেননা এই গ্যাসদ্বয় উদ্বায়ী গ্যাস এবং কিছুদিন পর এদের উড়ে যাওয়ার কথা। কেননা এই সময়ে পৃথিবী এমন ভারী গ্রহ ছিল না যে তার মহাকর্ষীয় আকর্ষণ ওই গ্যাসগুলোকে আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট হবে। তা ছাড়া ওই সময়ের জোরালো সৌরবায়ুর তোড়েও এই গ্যাসগুলোর উড়ে যাওয়ার কথা। সূর্য থেকে নিঃসৃত সৌরবায়ুতে থাকে উচ্চশক্তির কণা। তা ছাড়া আদিম দশায় ভ্রূণ-সূর্যের সক্রিয়তাও বেশি ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্যোতিষ্কের (গ্রহাণু কিংবা উল্কা) নিরন্তর সংঘর্ষের ফলেও উদ্বায়ী গ্যাসসমূহের উড়ে যাওয়ার কথা। ফলে সেই আদিম বাতাবরণ বড়ই ক্ষণস্থায়ী ছিল। সেই সময়ে আদিম পৃথিবী যথেষ্ট সক্রিয়ও ছিল। যার দরুন ওই সময়ে প্রচুর অগ্ন্যুত্পাতও হতো। পৃথিবীর ভেতরভাগও খুব উত্তপ্ত ছিল। এই ঘন ঘন সুবিপুল অগ্ন্যুত্পাতের ফলে প্রচুর পরিমাণে পানি-বাষ্প, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফারের যৌগ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণেই এদের আজও পৃথিবীর বাতাবরণে দেখা যায়।

এ ছাড়া বিজ্ঞানীরা এখন মনে করেন নাইট্রোজেন আর পানির উত্স সম্ভবত বহিরাগত গ্রহাণু ও উল্কা। বহু বহু যুগ পূর্বে পৃথিবীর সঙ্গে এদের সংঘর্ষও হতো প্রচুর পরিমাণে। শুধু পৃথিবী কেন, সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের সঙ্গেও তা-ই হয়েছে। চাঁদের পৃষ্ঠদেশ দেখলেও এই সংঘর্ষের ব্যাপারটি হূদয়ঙ্গম হবে। হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের তুলনায় কার্বন ডাই-অক্সাইড, আণবিক নাইট্রোজেন ও পানি-বাষ্প ভারী বিধায় বাতাবরণে এদের টিকে থাকারই কথা। পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্রেরও একটি প্রভাব আছে। চুম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতি গ্রহের বাতাবরণকে সৌরবায়ুর আয়নঝড়ের ক্ষতিকর প্রভাব থেকেও রক্ষা করে। তাপমাত্রা ও চুম্বকক্ষেত্রের যুগপৎ উপস্থিতির কারণে পৃথিবীতে একটি স্থায়ী বাতাবরণের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এর একটি পানিচক্রও আছে। পানিচক্র থাকার ফলে সমুদ্র ও ভূপৃষ্ঠ থেকে পানি বাষ্পাকারে উড়ে গিয়ে ঊর্ধ্বাকাশের একটি উচ্চতায় পৌঁছে ঘনীভূত হয়ে মেঘ তৈরি করে। এই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। শুক্র গ্রহে তাপমাত্রা এত বেশি যে পানি বাষ্পাকারে উড়ে যায় বটে, কিন্তু তা আর ঘনীভূত হতে পারে না। শুক্রের আবার ম্যাগনেটোস্ফিয়ারও নেই। ফলে যে পানি হারিয়ে যায়, তা আর ফিরে আসে না। এভাবে গ্রহটি ক্রমে জলশূন্য হয়ে গেছে।

চার

পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক গঠন, সক্রিয়তা ও ইতিহাস থেকে এর বাতাবরণে কী কী গ্যাস থাকতে পারে, তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু বাতাসে অক্সিজেন আর ওজোন থাকবে কেন, তার ব্যাখ্যা নেই। কেননা আণবিক অক্সিজেন খুবই সক্রিয় এবং দ্রুতই তা অন্য মৌলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ফেলতে পারে এবং এভাবে রাসায়নিক সাম্যাবস্থায় চলে আসার কথা। ফলে বাতাসে খুব সামান্যই অক্সিজেন থাকার কথা, অথবা থাকারই কথা নয়। তাই পৃথিবীর বাতাসের এক-পঞ্চমাংশের কিছুটা বেশি কেন অক্সিজেন, যেটা গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক অসাম্যাবস্থা, তার ব্যাখ্যার জন্য প্রাণের উপস্থিতির প্রয়োজন।

পৃথিবীর বাতাবরণে অক্সিজেনের এই অসাম্য অবস্থানের ব্যাখ্যা হলো সালোকসংশ্লেষণ বিক্রিয়া। একমাত্র জীবন্ত কোষই পারে আণবিক অক্সিজেন (O2) এবং ওজোন (O3)-এর নিরন্তর প্রবাহ নিশ্চিত করতে। অন্তত পৃথিবীর কেমিস্ট্রিতে। ভূপৃষ্ঠের বড় ও উঁচু গাছ এবং ফুলদায়ী উদ্ভিজ্জের প্রতিনিয়ত সালোকসংশ্লেষণের ফলে বাতাসে অক্সিজেনের প্রাধান্য সূচিত হয়। আণবিক অক্সিজেন উচ্চাকাশে বিয়োজিত হয়ে পুনরায় সংযোজিত হয়ে ওজোন তৈরি করে। ফলে উচ্চাকাশে ওজোনের নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতি বায়ুমণ্ডলের গভীরে অক্সিজেনের নিরন্তর সরবরাহের ইঙ্গিত দেয়। এই অক্সিজেন এল কোত্থেকে?

বয়সে খুব প্রাচীন, এমন সব পাথরের রাসায়নিক গঠনোপাদান বিশ্লেষণ করে আদিম পৃথিবীর বাতাসে কী পরিমাণ অক্সিজেন ছিল সেটা জানা গেছে—খুবই নগণ্য। প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন বা ৩৮০ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে সরলতম এককোষী প্রাণী প্রোক্যারিয়টের আবির্ভাব হয়। পরবর্তী ৬০ কোটি বছর এরাই পৃথিবীজুড়ে রাজত্ব কায়েম করেছিল। ইত্যবসরে এরা বহু বিচিত্র রাসায়নিক বিক্রিয়া খুঁজে ফিরেছে, নানা বিচিত্র ‘খাবার’ পরখ করেছে; যা করা যায় না, তা-ও করেছে। এমনকি লোহা খেয়ে হজম করেছে। শেওয়ানেলা পুত্রেফেসিনস (Shewanella putrefaciens) নামের অণুজীবটি ফেরিক লোহা (Fe3+) খেয়ে ফেরাস লোহা (Fe2+) বর্জ্যাকারে নির্গত করে এবং এই প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত রাসায়নিক শক্তি সংরক্ষণ করে। অন্যরা সালফেট, নাইট্রেট, সায়ানাইডও হজম করে ফেলার বিপাকীয় কর্মকাণ্ড রপ্ত করে ফেলেছিল। কেউ কেউ মিথেন গ্যাস উত্পাদ হিসেবে নির্গমন করত (এদের সামষ্টিক নাম মিথানোজেন)। ওই সময়কার পৃথিবীতে বাতাসের ইনফ্রারেড বর্ণালি গ্রহণ করার উপায় থাকলে বাতাসে পানি-বাষ্প, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কিছুটা মিথেন, নাইট্রোজেন ও সালফার যৌগের উপস্থিতি দেখা যেত। অক্সিজেন অতিসামান্য হয়তো, কিন্তু ওজোনের চিহ্নমাত্র দেখা যেত না।

পরবর্তী এক শ কোটি বছরে ক্রমশ জটিল এককোষী (ইউক্যারিয়ট) এবং বহুকোষীদের প্রভাবে পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর পৃষ্ঠভাগে নানা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এই সময়কালে সালোকসংশ্লেষণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অক্সিজেনের ক্রমাগত উপস্থিতি বেড়েছে। যেসব বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন ব্যবহৃত হয়, তাতে বেশি উদ্বৃত্ত শক্তি সঞ্চয় করে রাখা যায়। ফলে ওই সব বিক্রিয়াই প্রাধান্য পাবে। জীবজগৎও ওদিকে ধাবিত হবে। অন্যদিকে উদ্ভিদকোষে সালোকসংশ্লেষণ নামক বিশেষ প্রক্রিয়ার সাহায্যে সূর্যের আলোর সহায়তায় খাদ্য সংশ্লেষ হয়। ক্লোরোফিল নামে ফটোসিন্থেটিক পিগমেন্ট এই প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ এবং আণবিক অক্সিজেন তৈরি করে। ফলে পৃথিবীর বাতাসে যখন অক্সিজেনের আধিক্য দেখা দিল, সেটাও আবার রাসায়নিক সুসাম্য থেকে যথেষ্ট দূরবর্তী, সেটা অন্তর্নিহিত এসব জৈবনিক ক্রিয়া-কর্মাদির ইঙ্গিত বহন করে।

পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাবলি কীভাবে তার বাতাবরণকে প্রভাবিত করেছে, সে কথাটা মাথায় রেখে অন্য গ্রহের বাতাবরণ বিশ্লেষণ থেকে আমরা এখন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আহরণ করতে পারি। প্রযুক্তির কল্যাণে আজ আমরা অন্য নক্ষত্রের গ্রহের বাতাসের খবর জানতে পারছি। সে সম্পর্কে কম্পিউটার মডেল নির্মাণ করতে পারছি। এমনকি আমরা ডাইরেক্ট ইমেজিং বা প্রত্যক্ষ ছবি তুলতে পারছি। চিলির জেমিনি সাউথ টেলিস্কোপের জেমিনি প্ল্যানেট ইমেজার, আটাকামা মরুভূমির ভেরি লার্জ টেলিস্কোপের স্পেকট্রো-পোলারিমেট্রিক হাই-কন্ট্রাস্ট এক্সোপ্ল্যানেট রিসার্চ (SPHERE) ইত্যাদি এবং অন্যত্র ক্যালিফোর্নিয়া, হাওয়াই এবং ইউরোপিয়ান বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে ডাইরেক্ট ইমেজিং সম্ভব হচ্ছে। ফলে দূরান্তের গ্রহের বাতাবরণের রসায়ন এবং ভৌতদশা, তাপমাত্রা, জৈব যৌগের উপস্থিতি এখন প্রাণের আবশ্যক স্বাক্ষর হিসেবে গণ্য হচ্ছে।