জ্যোতির্বিজ্ঞানে হয়তো নতুন কিছুর সম্ভাবনা তৈরি করেছে মহাকর্ষ তরঙ্গ

লাইগোর জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দের জন্য সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করা, বিশেষজ্ঞদের বোঝানো, এ প্রকল্পের বিরোধী জ্যোতির্বিদদের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ অর্থাৎ মহাকর্ষ তরঙ্গ শিকারে নিবেদিতপ্রাণ সবচেয়ে পরিশ্রমী বিজ্ঞানী কিপ এস. থর্ন। নোবেল প্রাইজ ডট ওআরজি ওয়েবসাইটকে দেওয়া সংক্ষিপ্ত এক সাক্ষাত্কার চুম্বক অংশ এখানে ছাপা হলো।

প্রশ্ন :

অ্যাডাম স্মিথ: আইনস্টাইন নিজেও মনে হয় ভাবেননি, মহাকর্ষ তরঙ্গ একদিন ধরা পড়বে। কিন্তু আমার ধারণা আপনি সর্বদাই এ ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন?

কিপ থর্ন: আমি সব সময়ই আশাবাদী ছিলাম। আমরা যখন শুরু করি, আইনস্টাইনের চেয়ে আমাদের সুবিধা বেশি ছিল। আমাদের হাতে লেজার, অত্যাধুনিক কম্পিউটার ছিল, প্রযুক্তিতে পরিবর্তন এসেছে এবং মহাকর্ষ তরঙ্গের উত্স সম্পর্কেও আমাদের ধারণার উন্নতি হয়েছে। নিউট্রন স্টার এবং ব্ল্যাকহোল—এই দুটো বস্তুই মহাকর্ষ তরঙ্গের সবচেয়ে শক্তিশালী উত্স। আইনস্টাইনের কাছে এই দুই বস্তুর কোনো প্রমাণই ছিল না। তাই তিনি সংশয়ী ছিলেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব হয়তো কখনোই ধরা পড়বে না।

প্রশ্ন :

অ্যাডাম স্মিথ: মহাকর্ষ তরঙ্গ তো নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে মহাকাশ গবেষণায়। আমরা মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম, এখন আমরা কী দেখতে পাব?

কিপ থর্ন: আমার মনে হয়, সামনের দিনগুলোতে আমরা চমত্কার কিছু দেখতে পাব। গ্যালিলিরও দুরবিন যেমন মহাকাশ গবেষণায় নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছিল, আবার বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ নতুন করে মহাকাশ দেখতে শিখিয়েছিল, তেমনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে হয়তো নতুন কিছুর সম্ভাবনা তৈরি করেছে মহাকর্ষ তরঙ্গ।

মহাকর্ষ তরঙ্গ আসলে ভিন্ন রকম তরঙ্গ। বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ যখন মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, তার সাহায্যে আমরা মহাবিশ্বের বিভিন্ন অংশের তথ্য পাই। আমরা শুধু বাইনারি ব্ল্যাকহোলই প্রথম দেখব না, নিউট্রন স্টারগুলোর মধ্যে কীভাবে সংঘর্ষ হয়, তা কীভাবে একে অপরকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে, ব্ল্যাকহোল কীভাবে নিউট্রন স্টারকে ধ্বংস করে, নিউট্রন স্টারের ঘূর্ণন, পালসার এসবই আমরা দেখতে পাব মহাকর্ষ তরঙ্গের সাহায্যে। ২০৩০ সাল নাগাদ মহাশূন্যে পাঠানো হবে লিসা নামের মহাকর্ষ তরঙ্গ ডিটেক্টরকে। তখন আমরা আসলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির একদম শুরুর দিকের ঘটনাগুলো বুঝতে পারব। এবং নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছু, অনেক বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

কিপ এস. থর্ন

প্রশ্ন :

অ্যাডাম স্মিথ: চমকের কথা যখন উঠলই তখন জানতে চাই, এইমাত্রই যে চমক (নোবেল পুরস্কার) আপনি পেলেন, এ সংবাদ আপনি প্রথম কীভাবে জানলেন?

কিপ থর্ন: আমার মনে হয় না যে, মহাকর্ষ তরঙ্গ যে নোবেল প্রাইজ পেতে পারে তা খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল। আমি ভাবছিলাম ব্যারিশ, ওয়াইস বা আমার কাছে নয়, প্রাইজটা LIGO-VIRGO কোলাবরেশনে যাবে। আবিষ্কারটি আসলে কোলাবরেশনের ফল।

অথবা পুরস্কারটি যেতে পারত শুধু LIGO ল্যাবে, এই ল্যাবের গবেষকেরা খুব নিখুঁতভাবে মহাকর্ষ তরঙ্গ রেকর্ড করার ডিটেক্টরটির নকশা করেছেন এবং তা প্রস্তুত করেছেন। আমরা আসলে এমন একটি সময়ে বাস করছি, এখন বিরাট আবিষ্কারগুলো অনেক সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলাফল মাত্র। এসব ক্ষেত্রে একসঙ্গে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নোবেল কমিটির কাছে প্রত্যাশা থাকবে, ভবিষ্যতে নোবেল দেওয়ার সময় এই বিষয়টি ভেবে দেবে। শুরুর দিকে যাঁরা একটা প্রকল্প শুরু করেন, শুধু তাঁদের না দিয়ে কাজটির সঙ্গে যেসব মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জড়িয়ে রয়েছে, তাঁদের কীভাবে পুরস্কারটি দেওয়া যায়, তার একটি উপায় বের করে ফেলবে।

প্রশ্ন :

অ্যাডাম স্মিথ: হ্যাঁ, এটা আসলে বেশ আলোচনার ব্যাপার, আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্ক কিন্তু চলতেই থাকবে।

কিপ থর্ন: আমি মনে করি আমি আসলে LIGO-VIRGO কোলাবরেশনের একজন কর্ণধার মাত্র। মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত-প্রচেষ্টার অংশ হতে পেরে আমি গর্বিত।

প্রশ্ন :

অ্যাডাম স্মিথ: এটা বেশ বলেছেন। তাহলে ডিসেম্বরে স্টকহোমে আপনাকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নেব কি?

কিপ থর্ন: হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে।

অনুবাদ: তাসনীম আরা

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত