ডার্ক ম্যাটারের ঘাটতি ও ছায়াপথের হারানো ভর

ডার্ক ম্যাটার কী, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো খুব বেশি জানেন না। তবে ছায়াপথগুলোতে এর উপস্থিতি সম্পর্কে কারও সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানীরা বলেন, একটি ছায়াপথের বেশির ভাগ ভর লুকিয়ে আছে ডার্ক ম্যাটারে। যা ছায়াপথের নক্ষত্র, গ্যাস বা অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুকে একসঙ্গে মহাকর্ষের আকর্ষণে ধরে রাখার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তবে সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে সত্যিকার অর্থেই ডার্ক ম্যাটারের ঘাটতি থাকতে পারে, এমন ছায়াপথ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহার করে এসজিসি ১০৫২-ডিএফ২ নামক গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করে এমন তথ্য জানিয়েছেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ৯ জুন অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার-এ এ–সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।

ডিএফ২ ছায়াপথটি আমাদের আকাশগঙ্গার আকারের সঙ্গে মিল থাকলেও অন্যান্য দিক থেকে আলাদা। এর কোনো উজ্জ্বল কেন্দ্র বা সর্পিল বাহু নেই। কেন্দ্রে অতিভরের কোনো কৃষ্ণগহ্বরও নেই। আকাশগঙ্গার তুলনায় নক্ষত্রসংখ্যা ১ শতাংশের কম। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একে আলট্রা ডিফিউজ বা অতিবিচ্ছুরিত ছায়াপথ হিসেবে বলে থাকেন। যেখানে খুবই আলগাভাবে মহাজাগতিক বস্তুগুলো পরস্পর সংযুক্ত হয়ে আছে। বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত বেশ কিছু আলট্রা ডিফিউজ ছায়াপথ শনাক্ত করেছেন। তবে তাদের কেউই ঠিক এই ছায়াপথের মতো নয়। ২০১৮ সালে প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ডিএফ২ ছায়াপথটিতে ভর ও ডার্ক ম্যাটারের ঘাটতি লক্ষ করেন। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন। এর মধ্যে হাবল স্পেস টেলিস্কোপও ছিল, যার সাহায্যে ছায়াপথটিকে আরও বিস্তৃত পরিসরে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হন। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গবেষকেরা দেখতে চেয়েছিলেন, প্রথম দর্শনে এই ছায়াপথকে পৃথিবী থেকে যত দূরে মনে হয়েছে, তার চেয়ে দূরত্বটা আসলে কম কি না। যদি কম হয়, তাহলে ডার্ক ম্যাটারের যে ঘাটতি তাঁরা বুঝতে পারছেন, সেটা ভুল প্রমাণিত হবে। কিন্তু বিধি বাম! পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন, ডিএফ২ ছায়াপথটা আরও বেশি দূরে অবস্থান করছে।

২০১৮ সালের গবেষণায় তাঁরা যেখানে ৬৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে গ্যালাক্সিটা আছে বলে ভেবেছিলেন, সেখানে দেখা গেল, এটা আছে মূলত ৭২ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। তবে দূরত্বের এই ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন, এখানে সত্যিকার অর্থেই ডার্ক ম্যাটারের কমতি আছে। ডিএফ২ ছাড়াও ডার্ক ম্যাটারের ঘাটতি আছে, এমন ছায়াপথগুলোর তালিকা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ডিএফ২–এর অনেক কাছাকাছি আরেকটি আলট্রা ডিফিউজ গ্যালাক্সি, ডিএফ৪–এর কথা বলা যেতে পারে। যেটা তার প্রতিবেশী ছায়াপথের সঙ্গে ডার্ক ম্যাটারের ঘাটতি ভাগাভাগি করে নেয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন, প্রক্রিয়াটি কীভাবে ঘটছে। যেহেতু ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে তাঁরা এখনো প্রায় কিছুই জানেন না, তাই আলট্রা ডিফিউজ ছায়াপথগুলো কীভাবে গঠিত হয়েছে বা টিকে আছে, সেটাও একটা বড় রহস্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের। তবে ডিএফ২ ও ডিএফ৪ উভয়ের গঠন ও বিবর্তিত হওয়ার মধ্যে যোগসূত্র থাকার প্রবল সম্ভাবনা আছে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।

উভয় ছায়াপথই আরেকটি বিশাল ছায়াপথ এনজিসি-১০৫২ দ্বারা প্রভাবিত অঞ্চলে অবস্থান করছে। ডার্ক ম্যাটার কোন ছায়াপথে কীভাবে থাকে বা ছায়াপথের সঙ্গে ডার্ক ম্যাটারের আসলে সম্পর্কটা কেমন, সে সম্পর্কে নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে নতুন এই গবেষণা। ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারলে ছেঁড়া যাবে ছায়াপথ ও মহাবিশ্বের নানা রহস্যের জাল। আর ডার্ক ম্যাটার নিয়ে আরও ব্যাপকভাবে গবেষণা করতে বিজ্ঞানীদের আগ্রহী করে তুলবে পিটার ভ্যান ডক্কুমদের এই গবেষণা, এমনটাই প্রত্যাশা বিজ্ঞানীদের। এরই মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো মিলবে এখনকার না জানা প্রশ্নগুলোর উত্তর।

সূত্র: নাসা

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা