তত্ত্বে বিতর্কে মহাবিশ্বের স্ফীতি

২১ মার্চ ২০১৩। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ESA) প্যারিসের সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছে। এজেন্সি কর্তৃক উিক্ষপ্ত প্ল্যাঙ্ক স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে বসে মহাকাশের পটভূমি বিকিরণের (CMB) ছবি তুলেছে। সেই ছবির বিস্তারিত এবং সেটা থেকে আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে কী বলতে পারি, তা নিয়েই ওই সংবাদ সম্মেলন। যে ছবিটার কথা বলা হচ্ছে সেটা হলো মাইক্রোওয়েভে দেখা মহাকাশের ছবি। ১৪ বিলিয়ন বছর ধরে দশমিক ৩ থেকে ১১ দশমিক ১ মিলিমিটার লম্বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের যেসব আলো মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার ছবি এটা। সেটা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

স্বর্গোদ্যানে যেমন ঘাসের নিচে সাপ লুকিয়ে থেকে রসভঙ্গ করে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির সবচেয়ে সার্থক তত্ত্ব মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং-তত্ত্ব তেমনি সর্বৈব সুন্দর নয়। এরও রয়েছে নানা সমস্যা। যেমন পটভূমি বিকিরণের সুষমতা একটা সমস্যা। আমরা মহাকাশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ পেয়ে থাকি। এর নাম অণু তরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ বা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB)। এই পটভূমি বিকিরণ আকাশের যেকোনো দিক থেকে বছরের যেকোনো সময়েই মাপা হোক না কেন, তা একই রকম থাকে। অথচ আকাশের দুই বিপরীত প্রান্তের দূরত্ব এত বেশি যে এমনকি আলোর বেগেও এই দুই প্রান্তের মাঝে যোগাযোগ সম্ভব নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কী করে ওই দুই প্রান্ত থেকে একই তাপমাত্রার বিকিরণ সম্ভব? এ ছাড়া আরও কিছু সমস্যা আছে, যেগুলো ঠিক প্রচলিত তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এসব সমস্যা দূর করতে ১৯৮০-এর দশকে মার্কিন বিজ্ঞানী অ্যালান গুথ প্রস্তাব করলেন যে আদি মুহূর্তে বিশ্বের প্রসারণ সূচকীয় হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নকশার নাম ইনফ্লেশনারি থিওরি বা স্ফীতির তত্ত্ব। এ স্ফীতির ফলে মহাবিশ্বের আকৃতি অতি ক্ষুদ্র সময়ে ১০৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্ভবত এ ঘটনা ঘটে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ১০-৩৬ সেকেন্ড থেকে ১০-৩৩ অথবা ১০-৩২ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে। এই সুতীব্র স্ফীতির ফলে আদি মুহূর্তে সৃষ্ট অসমতা সবই দূর হয়ে যায়। স্ফীতির শেষে বিশ্ব আবার স্বাভাবিক প্রসারণের হার ফিরে পায়। ফলে আধুনিক মহাবিশ্বের দিগন্তের সমস্যা, সমতা ও মসৃণতার সমস্যা দূর হয়ে যায়। এভাবে আমাদের জানা ভৌত সূত্রগুলোর সাহায্যে আমরা মহাবিশ্ব সৃষ্টির ১০-৩১ সেকেন্ড পর্যন্তু ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করতে পারি।

বিশ্ব সৃষ্টির মুহূর্ত থেকেই এর শক্তি ঘনত্বে অতি সূক্ষ্ম হলেও কিছু তারতম্য ছিল। অর্থাত্ কিছু অঞ্চলের ঘনত্ব হয়তো পাশের অঞ্চল থেকে বেশি ছিল। পরে যখন মহাবিশ্ব শীতল হয়ে আসে, (সৃষ্টির পাঁচ-সাত লাখ বছর পর) এসব ঘনত্ব তারতম্য বিভিন্ন গ্যালাক্সিতে পরিণত হয়। ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। মহাবিশ্বের প্রাথমিক দশায় সৃষ্ট প্লাজমার শক্তি ঘনত্ব সব জায়গায় সুষম ছিল। তবু এই সুষমতায় ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম তারতম্য। পদার্থবিজ্ঞানের কিছু আইনের অধীনে এটা ঘটতে পারে। পরমাণু ও মৌল সংশ্লেষের পর বিশ্ব যখন তিন-চার হাজার ডিগ্রির কম তাপমাত্রায় চলে গেছে, তখন পূর্বে থেকে উত্তপ্ত ওই ঘনত্ব তারতম্য অনুযায়ী পদার্থের অত্যন্ত মহাকর্ষীয় চুপসানো শুরু হয়। যে অঞ্চলের ঘনত্ব অতি সামান্য হলেও পাশের অঞ্চল থেকে বেশি, সেই অঞ্চলের ওপর মহাকর্ষ বেশি কাজ করে। মহাকর্ষের অধীনে গ্যাসীয় পদার্থ ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে শুরু করে। গ্যাস সংকুচিত হতে থাকলে তার ভর বাড়তে থাকে। ফলে তার মহাকর্ষীয় আকর্ষণও বাড়তে থাকে। এভাবে ধূলিকণার আশ্রয়ে বিপুল গ্যাসপিণ্ড ঘনীভূত হয়ে তৈরি করে প্রথম গ্যালাক্সি। এভাবেই মহাবিশ্বের ব্যাপক কাঠামোর উদ্ভব।

আবার ফেরা যাক ২১ মার্চের ওই সম্মেলনে। সেটা ছিল উত্তর গোলার্ধের বসন্ত বিষুবের ঠিক পরদিন। প্ল্যাঙ্কের আগেও সিওবিই (COBE) কিংবা ডব্লিউএমএপি (WMAP) স্যাটেলাইট ওই আলোর ছবি তুলেছিল। কিন্তু প্ল্যাঙ্ক তুলেছে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি। সেই ছবি মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের কী বলে? বিষয় এতই গুরুতর যে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সর্বাধিনায়ক ডিরেক্টর জেনারেল জাঁ-জ্যাক দোর্দ্যাঁ পর্যন্ত মুখবন্ধ করলেন। মূল বৈজ্ঞানিক সারকথা তুলে ধরলেন কেমব্রিজের প্রফেসর জর্জ এফস্টাথিউ। আধা ঘণ্টা ধরে পটভূমি বিকিরণের ফিজিকস নিয়ে আলোচনা করে শেষতক বললেন, প্ল্যাঙ্কের ছবি থেকে জানা যাচ্ছে মহাবিশ্বে দৃশ্যমান বস্তু আছে ৫ শতাংশ (আগে জানা ছিল ৪ শতাংশ), ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির অনুপাতও একটু অদলবদল হলো, আর মহাবিশ্বের বয়স ৮ কোটি বছর বেড়ে হলো ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর (আগে জানা ছিল ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন)। তিনি বললেন, কিন্তু কিছু সমস্যা আছে, আর সে জন্যই আমরা এই লব্ধ বৈজ্ঞানিক রেজাল্ট থেকে বলতে পারি, আমাদের মহাবিশ্ব প্রায় নিখুঁত।

‘প্রায় নিখুঁত’, কিন্তু নিখুঁত নয়, কেন?

বিশ্ব সৃষ্টির স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুযায়ী, তাপমাত্রার বিচ্যুতি যেমন হওয়ার কথা তার থেকে কম, আকাশের এক দিকের গড় তাপমাত্রার বিচ্যুতি অন্য দিকের চেয়ে বেশি। এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা প্রমিত বা স্ট্যান্ডার্ড মডেলে নেই। সেই ছোট সমস্যাগুলো আজও কসমোলজিস্টদের কুরে কুরে খাচ্ছে।

তারই জের ধরে অতি সম্প্রতি বিখ্যাত সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় আনা ইজ্জাস, পল স্টাইনহার্ড ও আব্রাহাম লোয়েব একটি বিস্ফোরক প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটির নাম ‘পপ গো’জ দ্য ইউনিভার্স’। বিষয় ইনফ্লেশন বা স্ফীতির তত্ত্বের নানা অসংগতি। তাদের প্রবন্ধ শুরু হয়েছে ২১ মার্চ ২০১৩-এর ওই সংবাদ সম্মেলনকে ঘিরে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির প্ল্যাঙ্ক স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত পটভূমি বিকিরণের ডেটাবিষয়ক সংবাদ পর্যালোচনা। টুকটাক কিছু অসংগতি থাকলেও প্ল্যাঙ্ক টিম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দিয়েছিল পটভূমি বিকিরণে, যা কিনা মহাবিশ্বের আদিতম আলো, নিখুঁত পর্যবেক্ষণে যে অসামঞ্জস্য দেখা যায়, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ স্ফীতির সরলতম মডেলকেই (একক-ক্ষেত্র ধীর-অবনমন, সিঙ্গল-ফিল্ডস্লো রোল) সমর্থন করে। কিন্তু এই লেখকত্রয়ী তাতে বিশ্বাসী নন। বলে রাখা ভালো, পল স্টাইনহার্ড নিজে স্ফীতির তত্ত্বের প্রথম দিককার অন্যতম মূল তাত্ত্বিক হলেও তাঁর পরবর্তী গবেষণা স্ফীতির তত্ত্বের নানা অসংগতি নিয়ে। অন্য দুজনের মধ্যে ইজ্জাস জার্মানি থেকে ডক্টরেট করে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যলয়ে তাত্ত্বিক কসমোলজি বিষয়ে গবেষণা করছেন। আব্রাহাম লোয়েব হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাস্ট্রনমি ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান এবং অপর দুই গবেষকের পৃষ্ঠপোষক এবং সহমতপোষণকারী জ্যোতির্বিদ।

পল স্টাইনহার্ড ১৯৮৪ সালে সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকার মে সংখ্যায় অ্যালান গুথেরসাথে ‘দ্য ইনফ্লেশনারি ইউনিভার্স’ নামের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আধা টেকনিক্যাল প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, যেটা ছিল সেই সময়কার স্ফীতির তত্ত্ব বোঝার অন্যতম আকর প্রবন্ধ। ‘বাইসেপ-২’ বৈজ্ঞানিক দল যখন ২০১৪ সালে রব তুলেছিলেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ মহাজাগতিক মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কার করেছে। তখন এই স্টাইনহার্ডই দেখিয়েছিলেন, না, আসলে তাঁরা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ধূলিকণা দিয়ে পটভূমি বিকিরণের যে পোলারাইজেশন ঘটে, সেটাই পরিমাপ করেছিলেন। এ জন্যই পেপারটিকে আমি ‘স্টাইনহার্ডদের’ প্রবন্ধ বলছি, যদিও তিনি পেপারটির প্রথম লেখক নন। স্টাইনহার্ডদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, স্ফীতির মডেল অনুযায়ী পটভূমি বিকিরণে তাপমাত্রায় যে রকমের বিচ্যুতি পাওয়ার কথা, প্ল্যাঙ্ক টিমের পর্যবেক্ষণে সে রকম বিচ্যুতি মিলছে না। তা ছাড়া স্ফীতির ফলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তৈরি হওয়ার কথা, যেটা পটভূমি বিকিরণের কোনো পরিমাপেই নেই। ফলে পটভূমি বিকিরণের ডেটা স্ফীতিকে সাপোর্ট দিচ্ছে না। তা ছাড়া স্ফীতির সাম্প্রতিক মডেলগুলো বিবেচনায় আনলে অনন্ত স্ফীতি এবং তজ্জনিত মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্বের ধারণা এসে পড়ে। স্টাইনহার্ডরা আরও বলেছেন, স্ফীতির মডেল এই সম্ভাবনার কথা বলে যে বর্তমান বিশ্বের শুরু হয়েছে পুরোনো বিশ্বের সংকোচনের মধ্য দিয়ে নতুন এক ‘ফেজ ট্রানজিশনের’ দ্বারা। শুরুতে একটা বিগ ব্যাং থাকছেই, শুধু বিগ বাউন্সের মাধ্যমে নতুন দশায় মহাবিশ্ব পুনরায় আত্মপ্রকাশ করছে। জাতিস্মরের মতো ব্যাপার! এমতাবস্থায় স্ফীতির মডেল আদৌ পরীক্ষণ দিয়ে যাচাই করা যাবে কি না, প্রশ্ন তুলেছেন স্টাইনহার্ডরা।

তাঁরা বলেছেন, ‘স্ফীতির মডেলের নানা সমস্যা এবং বাউন্সিং কসমোলজির সম্ভাবনা আছে। তাই এটা প্রত্যাশিত ছিল যে এসব থিওরির মধ্যে কোনগুলো পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা যাবে, সে নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে সুষ্ঠু বাহাস হবে। কিন্তু খটকা থেকেই যাচ্ছে: ইনফ্লেশনারি কসমোলজি বলতে আজ আমরা যা বুঝি, সেটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দিয়ে যাচাই করা যাবে না। আমরা দেখেছি, প্রারম্ভিক শর্ত বদলালে কিংবা স্ফীতির শক্তি-ঘনত্বের রেখচিত্রের প্রকৃতি বদলে দিলে স্ফীতির মডেলের প্রত্যাশিত আউটকাম বদলে যায়, অথবা অনন্ত স্ফীতি এবং সেইজনিত মাল্টিভার্সের অস্তিত্ব দেখা দেয়। একক অথবা সামগ্রিকভাবে এসব গুণপনা স্ফীতির তত্ত্বকে এত নমনীয় করে তোলে যেকোনো পরীক্ষণেই একে কখনো অপ্রমাণ করা যাবে না।’

স্ফীতির ঘটনা যদি অপ্রমেয় আনটেস্টেবল হয়, তবে সমস্যাও আছে। বিগ ব্যাং কসমোলজির মতো সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপ্রমাণিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের একটি মূলভিত্তি স্ফীতির দশার কোনো ‘প্রমাণ’ সম্ভব হচ্ছে না। এটা প্রচলিত বৈজ্ঞানিক চিন্তাকাঠামোর জন্য এক বিব্রতকর ধাক্কা। কিন্তু স্টাইনহার্ডদের এ কঠোর মন্তব্য সাংঘাতিক ঢেউ তুলেছে কসমোলজি মহলে। সে এক মহা বাহাস! প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বিজ্ঞান কী? স্টাইনহার্ডদের মন্তব্য অনুযায়ী, বিজ্ঞানের পুনর্সংজ্ঞায়ন দরকার হয়ে পড়েছে। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, বিজ্ঞানের যে অন্যতম মহাস্তম্ভ এম্পিরিকাল টেস্টেবিলিটি, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যাচাইযোগ্যতার দরকার আছে কি? এক্সপেরিমেন্ট যদি ‘ফলসিফাই’ না করতে পারে, পরীক্ষণ যদি ভুল প্রমাণ না করতে পারে, তাহলে নন-এম্পিরিকাল সায়েন্স আনা দরকার, যেখানে পরীক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করে নেওয়ার দরকার পড়বে না। এই যুক্তি মেনে তাঁরা সুর চড়াতে চাইছেন, ইনফ্লেশন কোনো বিজ্ঞানই নয়! কারণ এই মডেলের এত ভ্যারিয়েশন যে যা খুশি তাই মেলাতে পারি, যেমন ইচ্ছা মহাবিশ্ব তৈরি করা যায়! ফলে একে যাচাই করবেন কীভাবে?

স্টাইনহার্ডদের প্রত্যুত্তরে ৩৩ জন বিজ্ঞানী একটি পাল্টা পত্র লিখেছেন ১০ মে, ২০১৭। এই পত্রের লেখককুলে আছেন পৃথিবীর সেলিব্রিটি পদার্থবিদ, যাঁদের মধ্যে চারজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী। তাঁরা স্টাইনহার্ড ও তাঁর সহলেখকদের তিরস্কার করে লিখেছেন, ‘ইনফ্লেশন’ লিখে সার্চ দিলে সারা বিশ্বের ৯ হাজার বিজ্ঞানীর লেখা ১৫ হাজার বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া যায়। অথচ স্টাইনহার্ডরা কীভাবে এই মডেলকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ বলে খারিজ করে দিচ্ছেন, সেটা পত্রলেখকদের বোধগোম্য নয়। তাঁরা লিখেছেন, স্ফীতি কোনো একক তত্ত্ব নয়, বরং অনেক সমান্তরাল ও প্রতিযোগী মডেলের সমাহার। কোন মডেলটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে, সেটা নির্ভর করবে কার ভাষ্য বেশি পরিমাণ যাচাইযোগ্য তার ওপর। বিশ্বস্ফীতির ‘স্ট্যান্ডার্ড’ মডেলগুলোর কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রমাণ থাকতে হবে। কিসের পর্যবেক্ষণে? পটভূমি বিকিরণের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অসমতায়। আমরা জানি, পটভূমি বিকিরণ সুষম নয়, স্থানবিশেষে তার মধ্যে বিকিরণের তাপমাত্রার পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যকে ব্যাখ্যা করার মতো ক্ষমতা স্ট্যান্ডার্ড ইনফ্লেশন থিওরির থাকতে হবে। একই সঙ্গে মহাবিশ্ব যে জ্যামিতিকভাবে সমতল (কিংবা অন্যভাবে বললে, মহাবিশ্বের ভর-ঘনত্ব-সংকট ঘনত্বের সমান) সে কথার ব্যাখ্যা থাকতে হবে ওই মডেলে। সে জন্য বিশ্বস্ফীতির ‘স্ট্যান্ডার্ড’ মডেলগুলোর কিছু বিশেষ জোরালো স্ট্যাটিস্টিক্যাল বা সংখ্যায়নিক ভাষ্য থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত প্ল্যাঙ্ক স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত পটভূমি বিকিরণের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে পরিশ্রুত ডেটার সঙ্গে এসব মডেলকে মিলিয়ে দেখতে হবে। পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তত্ত্বের ভাষ্যকে মেলানোর এই প্রক্রিয়া বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একটি মূল ও আদি প্রক্রিয়া। পর্যবেক্ষিত ডেটার সঙ্গে মিল রেখেই স্ফীতির একাধিক মডেলকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।

১৯৯২ সালের কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সপ্লোরার (COBE) স্যাটেলাইটের ডেটা থেকে শুরু করে প্ল্যাঙ্ক পর্যন্ত যত স্যাটেলাইট ডেটা এবং পৃথিবী থেকে করা পর্যবেক্ষণগুলো স্ফীতির পক্ষেই রায় দিয়েছে। এসব ডেটা থেকে মহাবিশ্বের গড় ভর-ঘনত্বের সঠিক (আধা শতাংশ অনিশ্চয়তা আছে) মান পাওয়া গেছে, যেটা স্ফীতির তত্ত্বের সঙ্গে মেলে। এ ছাড়া অন্যান্য মিল পাওয়া গেছে। ২০১৬ সালে প্ল্যাঙ্ক স্যাটেলাইট টিমের ২৬০ বিজ্ঞানীর লিখিত প্রবন্ধে উল্লিখিত হয়েছে, ‘প্ল্যাঙ্কের গণনা সরল স্ফীতির মডেলের সপক্ষে অত্যন্ত জোরালো প্রমাণ দেয়।’ কাজেই স্ফীতি ‘পর্যবেক্ষণের অযোগ্য’ বলে যে রায় স্টাইনহার্ডরা দিয়েছেন, তার যুক্তি কোথায়? স্টাইনহার্ডরা আরও বলেছেন, স্ফীতির এত সব মডেল যে এদের যেকোনোটিকেই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মেলানো যায়। এ কথা ঠিক যে স্ফীতির একাধিক মডেল তৈরি করা সম্ভব এবং প্রারম্ভিক শর্তাদি বা ইনিশিয়াল কন্ডিশন বদলে দিলে একেক মডেল একেক রকম ভাষ্য (প্রেডিকশন) দিতে পারে। কিন্তু সেটা যেকোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যেমন কণা পদার্থবিজ্ঞানের জগতের স্বনামধন্য স্ট্যান্ডার্ড মডেলও এই ‘রাগ’ থেকে মুক্ত নয়। সেখানেও বহুসংখ্যক কণার অস্তিত্ব ল্যাবরেটরিতে বাস্তবে মিলেছে এবং এই মডেলের ১৯টি প্যারামিটারের মান পর্যবেক্ষণ থেকে নির্ধারণ করা গেছে। তাহলে তো স্ট্যান্ডার্ড মডেলকেও বৈজ্ঞানিক কাঠামোর বাইরে বলে ধরতে হবে, এমন প্রস্তাব রেখেছেন ৩৩ জন বিজ্ঞানী। কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড মডেল একটি সর্বজনমান্য চিন্তাকাঠামো, যার সুনির্দিষ্ট পরীক্ষামূলক বা এম্পিরিক্যাল সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। হ্যাঁ, কিছু খামতি আছে। কিন্তু সেটা কোনো বৈজ্ঞানিক মডেলের নেই?

স্টাইনহার্ডরা আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলেছেন, যদি স্ফীতির মডেল কোনো কাজেরই না হতো, তাহলে তারা পটভূমি বিকিরণের এতগুলো পর্যবেক্ষণের সঙ্গে হয়তো মিলতই না। কিন্তু মিলেছে তো! তার ব্যাখ্যা কী? এই প্রসঙ্গে ৩৩ বিজ্ঞানীর ইশতেহারে খুব কড়া ভাষায় বলা হয়েছে, ‘স্টাইনহার্ডদের বাকস্ফীতি সত্ত্বেও পরীক্ষণবিজ্ঞানের একটা প্রমিত পদ্ধতি হচ্ছে নতুন তথ্যের আলোকে তত্ত্বকে নতুন করে সাজানো, যেমন নব আবিষ্কৃত কোয়ার্ক আর লেপটনদের জায়গা দিতে স্ট্যান্ডার্ড মডেলকেও মডিফাই করা হয়েছে। ইনফ্লেশনারি কসমোলজিতে, সৌভাগ্যবশত, এখন পর্যন্ত স্ফীতির স্ট্যান্ডার্ড মডেলগুলোর বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজনই পড়েনি।’

স্টাইনহার্ডদের আরেকটি মূল বক্তব্য ছিল যে স্ফীতির তত্ত্ব মেনে নিলে বহুবিশ্ব বা মাল্টিভার্সের চালচিত্র চলে আসে। ৩৩ বিজ্ঞানী অবশ্য তাতে কোনো সমস্যা দেখছেন না, বরং এটাকে আশীর্বাদ হিসেবেই দেখছেন। কেননা তাহলে বহুবিশ্বের রংধনুতে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের খামতিগুলোকে ব্যাখ্যা করা সহজ হবে। এ রকম ক্ষেত্রে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার এবং কণা ত্বরকযন্ত্র থেকে প্রাপ্ত নতুন তথ্য আমাদের ভৌতজ্ঞানের সীমানাকে আরও বিধৌত করবে। ৩৩ বিজ্ঞানীর যৌথ ইশতেহারের শেষ দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য হলো, ‘মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জানার অনেক বাকি আছে, কিন্তু তার অর্থ অবশ্যই এই নয় যে বিশ্বস্ফীতির প্রমিত ভাষ্যের অভূতপূর্ব পর্যবেক্ষণসম্মত সাফল্যকে অগ্রাহ্য করা যায়। প্রায় ৩৫ বছর ধরে ইনফ্লেশনারি থিওরিগুলো মহাবিশ্বের আদি মুহূর্তের বিবরণ এবং সেখানে বৃহদাকৃতির কাঠামোর উদ্ভব ব্যাখ্যায় প্রধান কসমোলজিকাল প্যারাডাইম হিসেবে ক্রমশ আত্মপ্রকাশ করেছে। কেউ বলছে না যে স্ফীতি নিশ্চিত ঘটেছে; গণিতের উপপাদ্যের মতো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের নিশ্ছিদ্র গাণিতিক প্রমাণ হয় না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে দেখা যায়, যেকোনো সফল বৈজ্ঞানিক মডেলের সমর্থনে আরও ভালো পর্যবেক্ষণসম্মত ডেটা আসছে, অথবা অধিকতর গ্রহণযোগ্য তাত্ত্বিক অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। স্ফীতির ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে। এখানেও অগ্রগতি হচ্ছে, কারণ বহুসংখ্যক আগ্রহী ও উত্সাহী বিজ্ঞানী কসমোলজির এই সক্রিয় শাখায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে আগ্রহী। এম্পিরিকাল সায়েন্স চলছে, চলবেও।’

কারা এই ৩৩ বিজ্ঞানী? বরং প্রশ্ন করুন কে নেই! অ্যালান গুথ স্বয়ং, স্টিফেন হকিং, আন্দ্রেই লিন্ডে, নোবেলজয়ী স্টিভেন ওয়েইনবার্গ, ফ্র্যাঙ্ক উইলচেক, জন মাথের এবং জর্জ স্মুট, লিসা র্যান্ডোল, লরেন্স ক্রাউস, শন ক্যারল, ব্রিটেনের রাজকীয় জ্যোতির্বিদ ও রয়াল সোসাইটির সাবেক সভাপতি মার্টিন রিস, লিওনার্ড সাসকিন্দ, আলেক্সান্ডার ভিলেনকিন, মাইকেল টার্নার এবং সর্বোপরি অ্যাডওয়ার্ড উইটেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছেও খটকা লেগেছিল এই ভেবে যে সায়েন্টিফিক আমেরিকান স্টাইনহার্ডদের ওই পেপার ছাপল কেন, বিশেষ করে যেখানে পেপারটিতে না ছিল কোনো পূর্ণ বিশুদ্ধ তত্ত্ব বা তথ্য, কিংবা গ্রাফচিত্র। একটা বৈজ্ঞানিক পেপার বলতে আমরা যেমন বুঝি, এটি তেমন নয় একেবারেই, অনেকটা মতাদর্শ বা ভাবদর্শনপূর্ণ একটি পেপার। তবে লেখকত্রয় জানিয়েছেন, তাঁরা আমন্ত্রিত হয়েই এই লেখা লিখেছেন, অবশ্য পেশাদার জার্নালেও তাঁদের এই বিষয়ক প্রকাশনা আছে।

এই হেভিওয়েট বক্তব্যের বিরুদ্ধে স্টাইনহার্ডরাও বসে থাকেননি, এই ইশতেহারকে তাঁরা ‘বেখাপ্পা জবাব’ হিসেবে দেখছেন। পাল্টা বাহাসে তাঁরা বলেছেন, যেহেতু ইনফ্লেশনের একাধিক মডেল আছে এবং যেহেতু এরা প্রায় সবাই প্রারম্ভিক শর্তাবলির ওপর নির্ভরশীল, কাজেই সে সব শর্ত ঠিকমতো না বুঝলে ওই মডেলগুলোর ভাষ্য সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা বিনয়ের সঙ্গে পুনর্ব্যক্ত করেছেন, ‘ঐতিহাসিকভাবেই স্ফীতির মডেল কিছু ভুল বোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন এটা জানা ছিল না যে ইনফ্লেশনের আউটকাম প্রারম্ভিক শর্তাবলির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। এবং এটাও জানা ছিল না, স্ফীতির মডেলসমূহের সাধারণ পরিণতি অনন্ত স্ফীতি এবং সেইজনিত মাল্টিভার্সে পর্যবসিত হয়, অর্থাত্ অসীমসংখ্যক ভাষ্যের অনন্ত সমাবেশ।... যেকোনো স্ফীতির মডেলই অসীমসংখ্যক সমাধান দিতে পারে, যার কোনোটিই অন্যটির তুলনায় প্রাধান্যযোগ্য নয়। এ জন্য স্ফীতি যেকোনো পর্যবেক্ষণ-সংক্রান্ত ফলাফলের ঊর্ধ্বে।’

এই মহাজাগতিক চাপান-উতোর বেড়েই চলেছে। এসব বাহাসের ফলে আমাদের চালের বাজারে কী সুবিধা হবে? কিছুই না। তবে চিন্তার জগত্ নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ হবে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এ রকম দু-একটা বিরাট বিতর্ক বা বাহাসের খবর জানা যায়। ১৯২০ সালে হার্লো শেপলি ও হেবার কার্টিসের মধ্যকার এক বিখ্যাত বিতর্কের বিষয় ছিল, আকাশে দেখা কুণ্ডলিত নীহারিকাগুলো কি আমাদের ছায়াপথেরই অংশ, নাকি আরও দূরবর্তী জ্যোতিষ্ক। এর সঙ্গে জড়িত ছিল আমাদের মহাবিশ্বের আকৃতির প্রশ্ন। শেপলি মনে করতেন, আমাদের ছায়াপথই সমগ্র বিশ্ব। কুণ্ডলিত নীহারিকা আমাদের ছায়াপথেরই অংশ। পরে টেলিস্কোপের উন্নতি ও পর্যবেক্ষণের অগ্রগতির ফলে আমরা এখন জানি, মহাবিশ্ব কি বিপুল আকৃতির। এরপরও আরও নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে কসমোলজি আজ এক পরিণত বিজ্ঞান হয়ে উঠেছে। বৈজ্ঞানিক বাহাস সব সময়েই চিত্ত উন্মোচিত করে।

লেখক: অধ্যাপক, তড়িত্ কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সূত্র: দ্য ইনফ্লেশনারি ইউনিভার্স/ অ্যালান গুথ, ১৯৯৭;

দ্য আননোন ইউনিভার্স/ স্টুয়ার্ট ক্লার্ক, ২০১৬;

দ্য ফ্যাব্রিক অব দ্য কসমস/ ব্রায়ান গ্রিন, ২০০৪

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত