দ্বিমাত্রিক সুপারসলিডের খোঁজে

সুপারসলিড হচ্ছে পদার্থের বিশেষ একটি অবস্থা, যেখানে পরমাণুগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে কঠিন পদার্থের কাঠামোর মতো করে সাজানো থাকে। এবং একই সঙ্গে সুপারফ্লুইডের মতো কোনো রকম ঘর্ষণ ছাড়াই প্রবাহিত হতে পারে। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সুপারসলিডের খোঁজে গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা।

দুই বছর আগে অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সেই সুপারসলিডের দেখা মেলে গবেষণাগারে। অতি শীতল চৌম্বকীয় পরমাণু ব্যবহার করে প্রথমবারের মতো সুপারসলিড তৈরি করেছিলেন ফ্রান্সিসকো ফেরলাইনার নেতৃত্বে অস্ট্রিয়ার ইন্সব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পদার্থবিজ্ঞানী। তবে সেটা ছিল শুধু একমাত্রিক। সম্প্রতি একই গবেষক দল প্রথমবারের মতো তৈরি করেছেন দ্বিমাত্রিক সুপারসলিড। এ-সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটি গত ১৮ আগস্ট নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

প্যারিসের লেজার ফিজিকস ল্যাবরেটরির পদার্থবিজ্ঞানী ব্রুনো লাবুরথে-টোলার মতে, সুপারসলিড কেমন, তা কিছুটা বোঝা যেতে পারে পানিতে ডুবে থাকা বরফের টুকরার কথা কল্পনা করলে। বরফের টুকরাটি কঠিন হলেও অনেকটা ঘর্ষণহীন অবস্থায় পানিতে চলাচল করতে পারে।

পদার্থের এই দুই অবস্থার সম্মিলিত অদ্ভুত রূপ অর্থাৎ সুপারসলিডটির দেখা মেলে শুধু বস্তুর কোয়ান্টাম পর্যায়ে। যেখানে কণাগুলো কঠিন পদার্থের কাঠামোতে আবদ্ধ, আবার একই সঙ্গে পরমাণুগুলো অনেকটাই মুক্তভাবে থাকে। ফলে সম্মিলিতভাবে এরা একটা তরঙ্গের মতো আচরণ করতে পারে এবং কঠিন তলজুড়ে ঘর্ষণ ছাড়াই অবাধে প্রবাহিত হতে পারে।

১৯৬৯ সালে প্রথম সুপারসলিডের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা। এরপর এই দীর্ঘ সময় ধরে সুপারফ্লুইডের বৈশিষ্ট্যের কঠিন অবস্থার অস্তিত্ব খুঁজতে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। এ জন্য তাঁরা সুপারফ্লুইড হিলিয়াম ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তাতে মেলেনি সফলতা।

সম্প্রতি গবেষকেরা নজর দেন অতি শীতল কোয়ান্টাম গ্যাসের দিকে। এর চৌম্বকীয় পরমাণুর মেঘ পরম শূন্য তাপমাত্রার প্রায় সমান হয়ে থাকে। পরমাণুগুলো চৌম্বকীয় হওয়ায় তারা নিজেদের মধ্যে অনন্য উপায়ে মিথস্ক্রিয়া করে, যেটা বস্তুকে সুপারসলিডিটির অবস্থায় যেতে দারুণ সাহায্য করে।

গবেষক দলটির অন্যতম সদস্য এবং ইন্সব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ম্যাথিউ নরসিয়া বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে আপনি ভাবতে পারেন, কোনো একটি পরমাণু নির্দিষ্ট একটি ড্রপলেট বা ফোঁটার মধ্যে পাওয়া যাবে। ড্রপলেট বা ফোঁটার মাঝখান দিয়ে তার যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু সুপারসলিড অবস্থার বেলায় এ কথা খাটে না। এখানে একটি কণা সব কটি ড্রপলেট বা ফোঁটায় একই সঙ্গে ভ্রমণ করতে পারে এবং একই সঙ্গে প্রতিটি ড্রপলেটে অবস্থান করতে পারে। আর এভাবেই উচ্চ ঘনত্বের (যেটাকে আমরা ড্রপলেট বা ফোঁটা বলছি) একাধিক অবস্থান একই সঙ্গে ডিলোকালাইজড পরমাণুকে ভাগ করে নেয়।’

ইন্সব্রুক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রান্সিসকা ফেরলাইনোর নেতৃত্বে অস্ট্রিয়ান এই গবেষক দল ২০১৯ সালে এক মাত্রা বরাবর ড্রপলেট বা ফোঁটাগুলোর একটি তন্তু বা স্ট্রিং তৈরি করেন। বর্তমানে চৌম্বকীয় মডেলের সাহায্যে তাঁরা একমাত্রিক সেই মডেলকে দুই মাত্রায় প্রসারিত করেছেন। যেখানে দুই বা ততোধিক ড্রপলেট বা ফোঁটার সারি একটি দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্র তৈরি করে।

এই আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের জন্য কোয়ান্টাম গ্যাসের মেঘ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্র আরও উন্মুক্ত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিমাত্রিক সুপারসলিড সিস্টেমে কীভাবে পাশাপাশি দুটি ড্রপলেটের মধ্যে ঘূর্ণন গর্ত তৈরি হয়, তা নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে। যদিও এসব ঘূর্ণন গর্তের দেখা মেলেনি এখনো। কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে এর অস্তিত্ব রয়েছে, যার প্রকৃতি খুঁজে বের করার মাধ্যমে সুপারফ্লুইডের গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি জানা সম্ভব হতে পারে।

গবেষকেরা এখনো নিশ্চিত নন, বড় পরিসরে সুপারসলিড তৈরি করা সম্ভব কি না। কারণ, পদার্থের অবস্থা হিসেবে এটা বিজ্ঞানীদের তৈরি চৌম্বকীয় ফাঁদের প্রতি প্রচণ্ড রকম সংবেদনশীল।

তবে যা-ই হোক, বর্তমানে দ্বিমাত্রিক সুপারসলিড তৈরির বিষয়টিই মূলত অনেক বড় একটি অর্জন। যেটা পদার্থের অদ্ভুত সব অবস্থা এবং কোয়ান্টাম শক্তি সম্পর্কে আরও বেশি ভালো করে বুঝতে সাহায্য করবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট

*লেখাটি ২০২১ সালে বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত