নেপচুন আবিষ্কারের পীঠস্থান

সৌরজগতের অষ্টম গ্রহ নেপচুন আবিষ্কারের কৃতিত্ব জার্মানির বার্লিন মানমন্দিরের। মানমন্দিরটি স্থাপিত হয় ১৭০০ সালে। একই সময়ে আবার স্থাপিত হয় প্রুশিয়ান বিজ্ঞান একাডেমিও। মানমন্দির স্থাপনের পেছনে প্রুশিয়ান রাজা এবং বিজ্ঞান একাডেমির বিরাট অবদান রয়েছে। একাডেমির প্রথম সভাপতি ছিলেন বিখ্যাত জার্মান গণিতবিদ গটফ্রিড লিবনিজ। মজার ব্যাপার হলো, একসময় একাডেমির নিজস্ব কোনো মানমন্দির ছিল না। ছিলেন গটফ্রিড কির্চ নামের একজন পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ধূমকেতু আবিষ্কারক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট সুনাম ছিল। তিনি আবার রাজ-জ্যোতির্বিজ্ঞানীও ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৭১০ সালে মানমন্দিরের কার্যক্রম শুরু হয়। তবে রাজার শর্ত ছিল, সপ্তাহের দুই রাত জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে মানমন্দিরটি।

যাহোক, মানমন্দিরের যন্ত্রপাতির মধ্যে ছিল একটি মেরিডিয়ান সার্কেল, একটি ক্রোনামিটার ও ৯ ইঞ্চি ব্যাসের একটি ফ্রনহোফার প্রতিসরক দুরবিন। ১৭১০ থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত মানমন্দিরে মোট ১১ জন জ্যোতির্বিজ্ঞানী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর আসেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান ফ্রাঞ্জ এঙ্ক। তিনি ১৮৩৮ সালে ৯ ইঞ্চি ব্যাসের ফ্রনহোফার প্রতিসরক দুরবিন দিয়ে শনির বলয়ের ফাঁক বা গ্যাপ আবিষ্কার করেন। বর্তমানে এটি এঙ্ক গ্যাপ বা এঙ্ক ডিভিশন নামে পরিচিত। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪০ সাল—এক বছরের মধ্যে তিনি তিনটি নতুন ধূমকেতু আবিষ্কার করেন। প্রকাশ করেন প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার তারা নিয়ে একটি তালিকা। এ ছাড়া তিনি ‘২পি/এঙ্ক’ নামের একটি পর্যাবৃত্ত ধূমকেতুর কক্ষপথ ও পর্যায়কাল গণনা করেন।

এ পর্যন্ত যত ধূমকেতু আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে ২পি/এঙ্কের পর্যায়কালই সবচেয়ে কম। মাত্র ৩ দশমিক ৩ বছর। পর্যাবৃত্ত শ্রেণির আবিষ্কৃত ধূমকেতুর মধ্যে এটি দ্বিতীয়, হ্যালির ধূমকেতু প্রথম। ১৭৮৬ সালের ১৭ জানুয়ারি ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী পিয়ের মেশাঁ প্রথম ধূমকেতুটি পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর ধূমকেতুটি পর্যবেক্ষণ করেছেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্যারোলি হার্সেল (ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কর্তা উইলিয়াম হার্সেলের বোন) এবং জাঁ লুই পন্স অন্যতম। তবে ১৮১৯ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান ফ্রাঙ্ক এঙ্ক কক্ষপথ নির্ণয় করে বলেন, ১৮২২ সালে ধূমকেতুটির আবার আবির্ভাব ঘটবে। ঠিকই ধূমকেতুটির ১৮২২ সালের ২ জুন আবির্ভাব ঘটেছিল। এরপর সেটি এঙ্কের নামেই নামকরণ করা হয়। ২পি/এঙ্ক এর পোশাকি নাম।

জোহান ফ্রাঙ্ক এঙ্ক একজন জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি ১৭৯১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জার্মানির হামবুর্গে জন্মেছিলেন। মারা যান ১৮৬৫ সালে। কার্ল ফ্রেডরিখ গাউসের (১৭৭৭-১৮৫৫) অধীনে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেন গোটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপনা এবং আমৃত্যু বার্লিন মানমন্দিরের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দুবার রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। চন্দ্রপৃষ্ঠের একটি খাদ এবং একটি গ্রহাণুর নামকরণ করা হয়েছে এঙ্কের সম্মানে।

১৮৪৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান গটফ্রিড গালে ও তাঁর সহকারী হেনরিক ডি অ্যারেস্ট এই মানমন্দিরে বসে নেপচুন আবিষ্কার করেন। নেপচুন হঠাৎ করে এক দিনেই আবিষ্কৃত হয়নি। এর পেছনে ছিল ইউরেনাস গ্রহের প্রভাব। যে প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ জন কোচ অ্যাডামস ও ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী লেভেরিয়ার অঙ্ক কষে একটি নতুন গ্রহের কথা বলেন। এ গ্রহের কারণেই ইউরেনাস যখন যেখানে থাকার কথা, সেখানে থাকছে না। এমনকি তাঁরা নতুন গ্রহটি আকাশের কোথায় দেখা যাবে, সে কথাও বলে দেন। এদিকে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের হাতে আকাশের তারামণ্ডলের ভালো কোনো মানচিত্র ছিল না। লেভেরিয়ার তাঁর গাণিতিক ফলাফল বার্লিন মানমন্দিরে পাঠিয়ে দেন। অবশেষে বার্লিন মানমন্দিরের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান গটফ্রিড গালের দুরবিনে ধরা পড়ে নেপচুন।

গটফ্রিড গালে ১৮৩৫ সালে জোহান ফ্রাঞ্জ এঙ্কের সহকারী হিসেবে বার্লিন মানমন্দিরে যোগ দেন। ১৬ বছর তিনি সেখানেই দক্ষতার সঙ্গে আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছেন। নেপচুন ছাড়াও আবিষ্কার করেন শনির বলয়সহ (সি-রিং) তিনটি ধূমকেতু। পিএইচডি করেন সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ডেনিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে ক্রিস্টেনসন রোমারের পর্যবেক্ষণের ওপর। পরে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে অধ্যাপনা করেন।

গাণিতিক ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আবিষ্কৃত হয়েছে বলেই নেপচুনকে গাণিতিক গ্রহ বলা হয়। আবার একে ইউরেনাসের যমজ গ্রহও বলা হয়। গঠন ইউরেনাসের মতোই। ইউরেনাসের মতোই রয়েছে ক্ষীণ বলয় ব্যবস্থা। বলয়গুলো বিভিন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন অ্যাডামস, লেভেরিয়ার, গালে প্রভৃতি। এর রয়েছে ১৪টি চাঁদ বা উপগ্রহ। ট্রাইটান, নেরেইদ, প্রোটিয়াম, ডেসপিন, থ্যালাসা, গ্যালাটিয়া, ল্যারিসা প্রভৃতি চাঁদের কথা আমরা জানি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চাঁদটি হলো ‘ট্রাইটান’। সম্প্রতি ‘হিপ্পোক্যাম্প’ নামের নতুন একটি চাঁদ আবিষ্কৃত হয়েছে।

বৃহস্পতির মতো নেপচুনের দক্ষিণ গোলার্ধে একটি বিরাট কালো দাগ দেখা যায়। একে বলা হয় ‘গ্রেট ডার্ক স্পট’ বা বিশাল কালো মেঘ। সূর্য থেকে নেপচুনের গড় দূরত্ব প্রায় ৪৫০ কোটি কিলোমিটার। ব্যাস ৪৯ হাজার ৫২০ কিলোমিটার। ভর ১৭টি পৃথিবীর ভরের সমান। এর বাতাবরণে বেশির ভাগই মিথেন ও অ্যামোনিয়া গ্যাসে ভরপুর। দেখতে নীল রঙের। তাই এর নামকরণ করা হয় রোমান পুরাণের সমুদ্রদেবতা নেপচুনের নামানুসারে। তবে নীল রঙের উত্স হচ্ছে এর বায়ুমণ্ডলে মিথেন কর্তৃক লাল আলোর শোষণ।

নেপচুন আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিয়ে নানা বিতর্কের পর অ্যাডামস ও লেভেরিয়ার দুজনের মধ্যেই আবিষ্কারের কৃতিত্ব সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়। তারপরও বিরোধ চলতেই থাকে। কে প্রথম নেপচুন আবিষ্কার করেন, এ নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডায় অ্যাডামস নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন।

গডফ্রিড কির্চ ও ফ্রাঙ্ক এঙ্ক ছাড়াও লালাঁদ, জোহান এলার্ট বোড প্রমুখ খ্যাতিমান জ্যোতির্বিজ্ঞানী বার্লিন মানমন্দিরে বিভিন্ন মেয়াদে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা সবাই নিজ নিজ আবিষ্কারের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।

লেখক: শৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও সংগঠক