ব্ল্যাকহোলের খাওয়াদাওয়া

কোনো কিছু ব্ল্যাকহোলের ঘটনাদিগন্ত পার হলে সেটা আর ফিরে আসতে পারে না। ব্ল্যাকহোলের গভীরতা হয়তো চিরকালের জন্য আমাদের কাছে রহস্যই হয়ে থাকবে, কিন্তু জ্যোতির্বিদেরা ব্ল্যাকহোলের চারপাশের স্থানকে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। মান্থলি নোটিশেস অব দ্য রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে একদল গবেষক জানান, প্রথমবারের মতো তাঁরা একটি ব্ল্যাকহোলে কোনো বস্তুর সরাসরি পতনের প্রমাণ পেয়েছেন। পতনের মুহূর্তে বস্তুর বেগ ছিল আলোর বেগের এক-তৃতীয়াংশ।

পর্যবেক্ষণটি করা হয় ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির স্পেস স্যাটেলাইট এক্সএমএম-নিউটন (XMM-Newton) অবজারভেটরিতে। তাতে দেখা যায় চার কোটি সৌরভরের একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের তার চারপাশের গ্যাস ও ধূলিকণাকে টেনে নিচ্ছে। কৃষ্ণগহ্বরটির অবস্থান ১০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের PG211+143 গ্যালাক্সির কেন্দ্রে।

গবেষণা দলটির নেতৃত্বে লিচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কেন পাউন্ড। তিনি জানান, ব্ল্যাকহোলের দিকে ছুটে চলা পৃথিবীর সমান একটি বস্তুপিণ্ডকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে তাঁর দল। বস্তুটি ব্ল্যাকহোলের ঘটনাদিগন্তে হারিয়ে যাওয়ার আগে তার বেগ ছিল আলোর এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ৯০ হাজার কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডে।

এটি একটি সংকুচিত ও ভারী বস্তু, যার চারপাশে ঘূর্ণনশীল উত্তপ্ত গ্যাসের ডিস্ক দেখে ব্ল্যাকহোল শনাক্ত করা হয়। আকার তার ভরের তুলনায় অনেক কম। ফলে পদার্থ সরাসরি এর ভেতরে ঢুকে যেতে পারে না। তার বদলে গ্যাসপিণ্ড ব্ল্যাকহোলের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে ব্ল্যাকহোলে পতিত হয়। ঠিক যেভাবে পানি ঘুরতে ঘুরতে একটি ছিদ্র দিয়ে ড্রেনের ভেতর। পদার্থ যতই ঘটনাদিগন্তের কাছে যেতে থাকে, ততই মহাকর্ষীয় বিভব শক্তি বিকিরণ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

এই বিকিরণই বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। ধারণা করা হয়, ব্ল্যাকহোল যেদিকে ঘোরে, গ্যাসও সেদিকেই ঘোরে। কিন্তু সাম্প্রতিক এই পর্যবেক্ষণে গ্যাসের খুবই কম ঘূর্ণন লক্ষ করা গেছে। ব্যাপারটা বিস্ময়কর!

তবে যুক্তরাজ্যের ডিরাক সুপার কম্পিউটারে করা লিচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিমুলেশনে দেখানো হয়েছে, শুধু একটি ডিস্কের পরিবর্তে আলাদা অনেক ডিস্ক ব্ল্যাকহোলের চারপাশে তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পদার্থ এক ডিস্ক থেকে ‘ছিঁড়ে’ বেরিয়ে আসতে পারে এবং ব্ল্যাকহোলের চারপাশে অনেকগুলো রিং তৈরি করতে পারে। এই রিংগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হলে এরা একে অপরের ঘূর্ণনকে বাতিল করে দেয়।

সে ক্ষেত্রে গ্যাসের ঘূর্ণনজনিত সমস্যা আর থাকে না। ফলে কেন পাউন্ডের পর্যবেক্ষণ করা ঘটনাটির ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। এই ধরনের গ্যাসের ডিস্ক বিভিন্ন গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ বা অতিভরের ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রেই তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকা এই ঘূর্ণনশীল গ্যাসের ডিস্ক ব্ল্যাকহোলের ঘূর্ণনকে ধীর করে দিতে পারে।

ফলে ব্ল্যাকহোল আরও সহজে পদার্থ গলাধঃকরণ করতে পারে এবং আরও বড় হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এর বিকিরণও অনেক বেশি হবে, যেমনটা আদিম মহাবিশ্বে দেখা যেত।

লেখক : শিক্ষার্থী, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র : সায়েন্স এলার্ট

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর ২০১৯ সংখ্যায়