শনির মতো পৃথিবীর বলয়!

বলা হয় সৌরজগতের সুন্দরতম গ্রহ হচ্ছে শনি। এই সৌন্দর্যের মূল কারণ তাকে ঘিরে থাকা চাকতি আকৃতির এক বলয়। এই দিক থেকে শনি সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ থেকে আলাদা। অন্য কোনো গ্রহে শনির মতো স্পষ্ট বলয় নেই। শনি ছাড়াও বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনের বলয় আছে। অবশ্য আমাদের জন্য একটা আশার বাণী আছে। জোর সম্ভাবনা রয়েছে পৃথিবীতেও শনির মতো বলয় তৈরি হওয়ার। মানুষের স্বভাবজাত অসচেতনতা আর পদার্থবিজ্ঞানের কিছু কারসাজিতে পৃথিবীকে ঘিরেও তৈরি হতে পারে বলয়।

সৌরজগতের গ্রহগুলো একই সমতলে অবস্থিত। অনেকটা ডিস্কের মতো। অথচ একটি তত্ত্বমতে সৌরজগত সৃষ্টি হওয়ার সময় এরা একই তলে ছিল না। বিশাল বিস্তৃত ধূলিমেঘ একত্র হয়ে ধীরে ধীরে সূর্য গঠিত হয়েছে। এরপর সূর্যের শক্তিশালী প্রভাবে গ্রহগুলো ধীরে ধীরে একই সমতলে এসেছে। এর কারণ সূর্যের অক্ষীয় ঘূর্ণন। পৃথিবী যেমন প্রতিদিন একবার নিজের অক্ষের চারপাশে ঘোরে, তেমনই সূর্যও নিজের অক্ষকে কেন্দ্র করে লাটিমের মতো ঘোরে। ফলে সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তনরত গ্রহ ও অন্যান্য বস্তু প্রভাবিত হয়। কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণ নীতিকে অক্ষুণ্ন রাখতে গ্রহগুলো চলে আসে অক্ষের মাঝামাঝি অবস্থানে। এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্রহগুলোর সব কটিই যদি অক্ষের মাঝামাঝিতে আসে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তারা একটি সমতলে অবস্থান করবে। মানে অনেকটা ডিস্ক আকৃতি ধারণ করবে। আর ডিস্ক আকৃতি মানে হচ্ছে বলয়।

গ্রহাণু বেল্টের দিকে ফিরে তাকাই না কেন? সৌরজগত গঠনের সময় সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকত তাহলে মঙ্গল গ্রহ ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে আরেকটি গ্রহ তৈরি হতো। এক বা একাধিক কারণে মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে এই গ্রহ তৈরি হয়নি। তবে গ্রহ গঠন করতে না পারলেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলো ঠিকই রয়ে গেছে এই দুই গ্রহের কক্ষপথের মাঝখানে। এদের বলা হয় গ্রহাণু। শুরুর দিকে এরা সূর্যের ওপরে, নিচে ও চারদিকে ফুটবলের মতো বিন্যস্ত ছিল। কিন্তু সূর্যের প্রভাবে ধীরে ধীরে এরা একটি সমতলে এসেছে। সমতলে থাকা এসব গ্রহাণুকে বলে গ্রহাণু বেল্ট।

সূর্যের কক্ষপথে যেমন গ্রহাণু বেল্ট আছে, তেমনই শনি গ্রহের কক্ষপথেও বলয় বা রিং আছে। শনির বলয় আর সূর্যের গ্রহাণু বেল্ট তৈরি হওয়ার কারণ প্রায় একই। পৃথিবীর চাঁদের মতোই শনিরও অনেক উপগ্রহ আছে। উপগ্রহগুলো তৈরির সময় একটি উপগ্রহ কোনো কারণে ঠিকভাবে গঠিত হতে পারেনি। তাই ওই উপগ্রহের গাঠনিক উপাদানগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এগুলোই শনির বলয়ের মূল কারণ। প্রাথমিক অবস্থায় গাঠনিক উপাদানগুলো শনির চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো ছিল। পরবর্তী সময়ে শনির আকর্ষণ ও ঘূর্ণনের প্রভাবে ধীরে ধীরে এরা একটি সমতলে অবস্থান নেয়। কোটি কোটি কিলোমিটার দূর থেকে এটিকেই আমরা রিং বা বলয় হিসেবে দেখি।

মহাকাশ জয়ের পর থেকেই পৃথিবীর কক্ষপথে মানবসৃষ্ট আবর্জনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে

এদিকে পৃথিবীর মানুষও একের পর এক স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে পৃথিবীর কক্ষপথে। মানচিত্র, টেলিভিশন, মোবাইল, আবহাওয়া, গোয়েন্দাগিরি হেন কোনো কাজ নেই, যা স্যাটেলাইট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। ধীরে ধীরে সব দেশই স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে এবং তার পরিমাণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট মহাকাশে স্থাপন করেছে।

স্যাটেলাইট বা মহাকাশযান পাঠানো খুব সহজ নয়। ছোট একটি স্যাটেলাইট পাঠাতে দুই স্তরের জ্বালানি ট্যাংক লাগে। সেসব ট্যাংক বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর কক্ষপথেই ঘোরে। ইয়া বড় বড় সেসব ট্যাংকের আকৃতি। স্যাটেলাইটকে একটি আবরণে করে সুরক্ষিত অবস্থায় কক্ষপথে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পৌঁছালে সেই আবরণও খসে পড়ে। ফলে একটি মহাজাগতিক আবর্জনাময় বহিরাবরণ তৈরি হচ্ছে পৃথিবীতে।

স্যাটেলাইটগুলোও নষ্ট হয়ে যায়, সংঘর্ষে ধ্বংস হয়ে যায়, পৃথিবী থেকে এদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়, মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। তখন সেগুলোকে ‘ছেড়ে’ দেওয়া হয় এবং সেগুলোও মহাকাশ বর্জ্য (Space junk) হিসেবে বিবেচিত হয়। ছেড়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ এগুলোর অবস্থানের এদিক-সেদিক করতে পারে। কিন্তু এরপর স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি চলে যায় পৃথিবীর আকর্ষণ, ঘূর্ণন এবং পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মনীতির ওপর। দিন কাটবে, রাত পোহাবে ও কালের বিবর্তনে একসময় সেসব দলছুট বস্তু-বর্জ্য কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র মেনে চলে আসবে পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের মাঝ বরাবর। লাখ লাখ কিলোমিটার দূর থেকে সেগুলোকেই দেখা যাবে রিং বা বলয় হিসেবে। হয়তো এ রকম হতে হাজার হাজার বছর সময় লাগবে, কিন্তু তারপরও এটি হবে।

মহাকাশ বর্জ্য অক্ষের মাঝ বরাবর আসবে কেন?

এই ব্যাপারটা হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। তার জন্য একটি লম্বা কাঠির দুই প্রান্তে একটি দড়ির দুই প্রান্ত বাঁধতে হবে। দড়ির দৈর্ঘ্য হতে হবে কাঠির দৈর্ঘ্যের অন্তত দেড় গুণ। দড়িতে মুক্তভাবে চলমান মাঝখানে ছিদ্রওয়ালা ছোট্ট একটা চাকতি রাখতে হবে। অনেকটা পুঁতির মালার মতো। পুঁতি যেমন সুতা বেয়ে চলাচল করতে পারে, তেমনই ধাতব বস্তুটিও যেন দড়ি বেয়ে চলাচল করতে পারে। এবার কাঠিটিকে দুই হাতে ধরে চরকির মতো ঘোরালে চাকতি কাঠির মাঝ বরাবর চলে আসবে। সরিয়ে অন্য কোনো অবস্থানে নিয়ে গেলেও কিছুক্ষণ পরেই মাঝ বরাবর চলে আসবে। কাঠিটিই হচ্ছে প্রতীকীভাবে সূর্যের বা শনির বা পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ। এই অক্ষের মাঝামাঝি গ্রহাণু, উপগ্রহাণু ও মহাকাশে আবর্জনাগুলো ডিস্ক বা বলয় তৈরি করবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ

সূত্র: স্পেস ডট কম, লাইভ সায়েন্স ডট কম

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত