সূর্যকে নিয়ে গবেষণা কেন দরকারি

আমরা বর্তমানে যে সভ্যতায় বসবাস করছি শত বছর আগে, হাজার বছর আগে সভ্যতার রূপ এ রকম ছিল না। বর্তমানে যে সভ্যতায় বসবাস করছি শত বছর পর, হাজার বছর পর সভ্যতার রূপ এ রকম থাকবে না। সভ্যতা ক্রমেই এগিয়ে যাবে। অন্তত গাণিতিক বাস্তবতা তা-ই বলে।

সভ্যতার উন্নয়নের একটি ধারা আছে। বর্তমানে যেভাবে সভ্যতার উন্নয়ন হচ্ছে তার মূল বাহন হলো শক্তি। যে জাতি যত বেশি শক্তি ব্যবহার করতে পারে, সে জাতি তত উন্নত। শক্তিকে ব্যবহারের জন্য মানুষ উদ্ভাবন করেছে নানা ধরনের ব্যবস্থা।

পৃথিবীতে যে পরিমাণ শক্তি আছে, তা দিয়ে পৃথিবীর সব মানুষের সব ধরনের চাহিদা পূরণ হবে না। তার ওপর পৃথিবীর শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে না, ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে বরং। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের চাহিদাও। মানুষ উন্নত প্রযুক্তির উন্নত সভ্যতার উন্নত জীবনযাপনে আগ্রহী। কেউই কিছুটা পেছনে গিয়ে শক্তির দিক থেকে ‘অনুন্নত’ জীবন যাপনে আগ্রহী নয়।

কেউই কাঠ-কয়লা পুড়িয়ে হাড়ির তলা কালি করে রান্নায় আগ্রহী নয়, সুযোগ পাওয়ামাত্রই সবাই গ্যাসের চুলা কিংবা বৈদ্যুতিক চুলায় রান্না করতে চায়। আবার কেউই হেঁটে হেঁটে ২০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে মামার বাড়ি যেতে চায় না, সবাই ট্রেন কিংবা বাস চড়ে এই রাস্তা পেরোতে আগ্রহী। এছাড়া কেউই খড় দিয়ে পাতা দিয়ে বানানো ঘরে থাকতে আগ্রহী নয়, সবাই দালান কোঠা কিংবা টিনশেডের ঘরে থাকতে চায়। কেউই লাইনের পর লাইন চিঠি লিখে পোস্ট অফিসে পাঠিয়ে শঙ্কায় থাকতে চায় না যে চিঠিটি পৌঁছাল কিনা। সবাই চায় অতি সহজে মুঠো ফোনের মাধ্যমে কথা বলে ফেলতে কিংবা মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ কিংবা অন্য কোন অ্যাপের মাধ্যমে কোনো তথ্য শিগগিরই জানিয়ে দিতে।

এই যে মানুষ সাধারণ কোনো কিছুতে আগ্রহী নয়, উন্নত প্রযুক্তিতে আগ্রহী তার সবগুলোর পেছনেই দরকার শক্তি। এই শক্তি আসে পৃথিবীতে সঞ্চিত শক্তির মাধ্যমে। অল্প কিছু শক্তি আসে সূর্যের তাপ ও আলোকশক্তি থেকে। সোলার প্যানেলের মাধ্যমে এ শক্তি আহরণ করা হয়।

পৃথিবীর এত মানুষের চাহিদার প্রেক্ষাপটে পৃথিবীতে সঞ্চিত শক্তি পর্যাপ্ত নয়। সভ্যতা যে অবস্থায় আছে তাকে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে দরকার আরও আরও শক্তি। এত এত শক্তি পাওয়া যাবে কোথায়? উত্তর আমাদের সামনেই আছে, সূর্য। সূর্য থেকে প্রতি মুহূর্তে অকল্পনীয় পরিমাণ শক্তি মুক্ত হচ্ছে। তার অতি সামান্য পরিমাণ শক্তি আমরা ধরতে পারছি। প্রায় সবটা শক্তি বিকিরিত হয়ে যাচ্ছে, কোনো কাজেই আসছে না।

এমন কোনো ব্যবস্থা যদি তৈরি করা যায় যার মাধ্যমে সূর্যের অধিকাংশ শক্তিকে আহরণ করা সম্ভব হবে, তাহলে সেটা খুব চমৎকার কিছু হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো সেটা অনেক কষ্টসাধ্য, হয়তো সেটা অনেক চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু সেটা অসম্ভব নয়। হয়তো সেটা বহুদূর ভবিষ্যতের কোনো বাস্তবতা, কিন্তু সেটা ফেলনা নয়। দূর ভবিষ্যতের কোনো কাজ যদি আজকে শুরু না করি তাহলে দূরেরটা আরও দূরে সরে যাবে। আজকে পদক্ষেপ নিলেই না তবে ভবিষ্যৎটা এগিয়ে আসবে আমাদের দিকে। “আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে?”

সূর্যে অফুরন্ত শক্তি আছে, সূর্যের শক্তিকে ব্যবহার করা দরকার, এই বলে বসে থাকলেই তো হবে না। কীভাবে শক্তিকে মানুষের নাগালে আনতে হবে, কীভাবে সর্বোচ্চ পরিমাণ শক্তি আহরণ করা যাবে, কীভাবে সেগুলোকে কাজে লাগানো যাবে, কীভাবে সভ্যতার উন্নয়নে এদের ব্যবহার করা যাবে তার জন্য দরকার গবেষণা। শক্তির প্রধান উৎস যেহেতু সূর্য তাই সূর্যকে নিয়ে গবেষণার বিকল্প নেই।

সূর্যের শক্তির ধরন কেমন, সূর্যের বৈশিষ্ট্য কেমন, সে ধরন ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে কেমন ব্যবস্থা নিলে সূর্য থেকে সর্বোচ্চটা নিংড়ে আনা যাবে, তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা দরকার। এ প্রসঙ্গে একটা দূর-বাস্তব কল্পনা করি। সূর্যকে যদি চারপাশ থেকে বিশেষ কোনো সোলার প্যানেলে ঘিরে নেওয়া হয় এবং তাপ ও আলোকশক্তিকে এর মাধ্যমে আহরণ করা হয় তাহলে ব্যাপক শক্তির জোগান পাবে মানবজাতি। সৌরজগতের বিভিন্ন স্থানে এক বা একাধিক শক্তি স্টেশন থাকবে, যেখান থেকে মানুষের চাহিদামতো পৃথিবীতে কিংবা চাঁদে কিংবা মঙ্গল গ্রহে শক্তি স্থানান্তর করা সম্ভব হবে।

ভবিষ্যতে হয়ত এমন একটা সময় আসবে, যখন মঙ্গল গ্রহে কিংবা সৌরজগতের যেকোনো স্থানে কিংবা সৌরজগতের বাইরে কোনো আন্তনাক্ষত্রিক স্থানে ভ্রমণ ও বসবাস হবে দিনের আলোর মতো বাস্তব ব্যাপার। সেসব কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ শক্তি দরকার। পৃথিবীতে যত সহজে আমরা শক্তি ব্যবহার করতে পারি সেসব স্থানে তত সহজে শক্তির জোগান পাওয়া না-ও যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে ভরসা হতে পারে সূর্য। সূর্যে অফুরন্ত জোগান আছে, দরকার শুধু উপযুক্ত উপায়ে সেগুলোকে আহরণ করা।

শুধু উপকারি দিকই নয়, সূর্যের ক্ষতিকর দিকও আছে। ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকতে হলে সূর্যের এদিক-ওদিক সম্বন্ধে জানতে হবে। কোনো রোগ যখন মানুষকে আক্রমণ করে তখন বিজ্ঞানীরা লেগে যান রোগের জীবাণু কিংবা রোগের উপাদান নিয়ে। শুরুতেই ওষুধ তৈরিতে লেগে যান না। আগে জীবাণুর নাড়ি-নক্ষত্র বের করে তারপর সে অনুযায়ী ওষুধ। জীবাণু সম্বন্ধে আগে ভালোভাবে না জেনে ওষুধ দিলে সেটি হবে অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো। তাই সূর্যের ক্ষতিকর দিক থেকে বাঁচতে হলে কিংবা সূর্যের শক্তিকে আরো বেশি করে কাজে লাগাতে হলে দরকার সূর্য সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য।

সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি আছে, মানুষের দেহে এগুলো পড়লে নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। এমনকি ক্যানসারও হয়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল সেসব রশ্মি শোষণ করে নিয়ে প্রাথমিকভাবে আমাদের বাঁচায়। মানুষ যেভাবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করছে তাতে জোর সম্ভাবনা যে বায়ুমণ্ডলে সেই সুরক্ষাকারী স্তরটি নষ্ট হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে অনেকখানি নষ্ট হয়েও গেছে। ভবিষ্যতে যে পুরোটা নষ্ট হবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। তখন তো মানুষকে টিকে থাকতে হবে। এরকম পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে কিংবা টিকিয়ে রাখতে হবে তার জন্য দরকার সূর্য ও সূর্য থেকে বিকিরিত রশ্মি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা।

তা ছাড়া মানুষ নিজের উদ্যোগেও তো পৃথিবীর সুরক্ষা আবরণের বাইরে যায়। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মানুষ প্রতিনিয়তই যাচ্ছে। এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে যাওয়া ভবিষ্যতে হয়ত স্বাভাবিক বাস্তবতা হয়ে যাবে। তখন সূর্যের ক্ষতিকর দিক থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে দরকার সূর্য সম্বন্ধে ব্যাপক গবেষণা।

সে গবেষণার অংশ হিসেবে মানুষ নানা সময়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। পৃথিবীতে বসে টেলিস্কোপ তাক করে কিংবা ডিটেকটর বসিয়ে সূর্যকে বোঝার চেষ্টা করেছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে গিয়ে দূর থেকে সূর্যকে বোঝার চেষ্টা করেছে। সম্প্রতি সূর্যের কাছে গিয়ে সূর্যকে বোঝার জন্য পাঠিয়েছে পার্কার সোলার প্রোব। ভবিষ্যতেও পাঠানো হবে এ রকম নভোযান।

একটু একটু করে উন্মোচিত হবে সূর্যের রহস্য। আর সূর্যের অধিকাংশ শক্তি আহরণের জন্য মানবজাতি এগিয়ে যাবে ধীরে ধীরে।

সূত্র: বিগ থিংক, কিউরিওসিটি

*লেখাটা বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়