সূর্যে ঝাঁপ দেবে পার্কার

সূর্যের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মারা যাবে পার্কার। জন্মের আগেই ওর মৃত্যুর দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেছে। ২০২৫ সালে হবে পার্কারের সূর্যসমাধি। পার্কার একটি তদন্তকারী আকাশযান (space probe)। নাসার বিজ্ঞানীরা এখন ওকে গড়তে ব্যস্ত, ওর যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট। সূর্যের বাইরের আবরণের নাম করোনা (Corona)। খালি চোখে দেখা যায় না, ওখানেই ঝাঁপ দেবে পার্কার। সেই ১৯৫৮ সাল থেকে নাসার বিজ্ঞানীরা এমন একটি দুঃসাহসী আকাশযানের পরিকল্পনা করে আসছিলেন। করোনার তাপমাত্রা প্রায় ২০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমন তাপে যেকোনো পদার্থ ভেঙে পরমাণু হয়ে ছোটাছুটি করে, এমনকি পরমাণুগুলো তাদের ইলেকট্রনদেরও সামলে রাখতে পারে না! পদার্থের এই দশার নাম প্লাজমা (Plasma)। বর্তমানে নাসার সবচেয়ে মজবুত কার্বন তাপবর্ম (Carbon heat shield) বড়জোর কয়েক হাজার ডিগ্রির তাপ সহ্য করতে পারে। ২০ লাখ ডিগ্রি তাপমাত্রায় স্পেসশিপ এবং তার বর্ম দুটোই এক মুহূর্তে প্লাজমা দশায় পরিণত হবে। ঝাঁপ দিলে নিশ্চিত মরণ। তবে খুব কাছে গিয়ে একটু তিড়িংবিড়িং বাহাদুরি করতে তো মানা নেই! বিজ্ঞানীদের পরিকল্পনা, পার্কার আকাশযানটি করোনার খুব কাছাকাছি থেকে সূর্যকে ঘিরে ২৪ বার পাক খাবে এবং অতি স্বল্প দূরত্বে কিছু লাফঝাঁপ দেবে। আকাশযানের সেন্সর বিপদের সংকেত দিলেই পার্কার বাইরে নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে আসবে। গবেষণার কাজ শেষ হলে সে নির্ভয়ে ঢুকে যাবে সূর্যের গভীরে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইউজিন পার্কার এখনো বেঁচে আছেন, বয়স ৯০ বছর। এই প্রথম নাসা একজন জীবিত ব্যক্তির নামে একটি আকাশযানের নামকরণ করল। ১৯৫৮ সালে বিজ্ঞানী পার্কার সৌরবায়ুর (Solar wind) কথা বলেন। দূর আকাশের ধূমকেতু যখন সূর্যের চারদিকে ঘুরে যায়, তখন ওর লেজটা থাকে সব সময় সূর্যের উল্টো দিকে। কেন? বাতাসে পতাকা ওড়ালে পতাকার পেছনটা থাকে বাতাস যেদিক থেকে আসছে, তার উল্টো দিকে। সূর্য থেকে চারদিকে বাতাস বইছে নাকি? কিসের বাতাস? সে যুগে সূর্য ও গ্রহগুলোর মাঝখানের স্থানকে ফাঁকা ধরা হতো। শূন্যস্থানে বাতাস? হেসে উড়িয়ে দিলেন সবাই। অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে সৌরবায়ু নিয়ে পার্কারের প্রবন্ধ ছাপার বিরুদ্ধে মত দিলেন দুই বিশেষজ্ঞ। তখনকার নামকরা ভারতীয়-আমেরিকান নক্ষত্রবিজ্ঞানী সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর সৌরবায়ুর কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে পার্কারের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। চন্দ্রশেখরের নিজের কপালেও এমনটি ঘটেছিল, যখন মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি সাদা বামন তারা (White dwarf), নিউট্রন তারা, চন্দ্রশেখর সীমার কথা বলেছিলেন। ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞরা হো হো করে হেসেছিলেন এই অর্বাচীন ভারতীয় কিশোরের স্পর্ধা দেখে। ১৯৮৩ সালে চন্দ্রশেখর সেই কিশোর বয়েসের গবেষণার জন্য পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। পার্কারের কপালেও এমনটি ঘটতে পারে! এখন সৌরবায়ু একটি পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক সত্য, এই বায়ু হলো সূর্য থেকে ছিটকে পড়া আয়নিত কণার ধারা, গোটা সৌরজগৎ ভেসে যাচ্ছে এর স্রোতে।

এই কণাদের মাঝে আছে প্রধানত ইলেকট্রন, প্রোটন ও আলফা কণিকা। এই কণাগুলো বাতাসে শব্দের গতির চেয়েও দ্রুতবেগে (Supersonic speed) সূর্য থেকে বেরিয়ে আসছে। সূর্যের প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণের টানকে উপেক্ষা করার শক্তি ওরা কোথায় পেল, তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। পার্কার আকাশযানটির একটা দায়িত্ব হবে এ সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া।

সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়েছে এক নীহারিকা থেকে। নীহারিকা হলো মহাবিশ্বের মহাকাশে উদাসীনভাবে ভেসে চলা এক বিশাল মেঘ, হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস দিয়ে ভরা। একটি নীহারিকা হতে পারে সৌরজগতের চেয়ে লাখ গুণ বড়। ভেসে চলার সঙ্গে সঙ্গে এরা ধীরে ধীরে পাক খায়। পৃথিবী প্রতি ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিটে নিজের অক্ষের চারদিকে একবার ঘোরে, বৃহস্পতি ও শনি গ্রহ ঘোরে যথাক্রমে ১০ এবং সাড়ে ১০ ঘণ্টায়। একটি নিউট্রন স্টার ও কৃষ্ণগহ্বর ঘোরে অবিশ্বাস্য গতিতে, যথাক্রমে এক সেকেন্ডে প্রায় ১০০ বার এবং হাজার বার। যখন কেউ ঘোরে, তখন তাকে পেয়ে বসে এক ঘোরার আবেগে। ওকে পদার্থবিদেরা বলেন ঘোরার ভরবেগ। এই ভরবেগ হলো বস্তুর আকার, ভর ও বেগের গুণফল। পদার্থবিদ্যার এক আইন (Conservation of angular momentum) বাইরে থেকে কেউ হস্তক্ষেপ না করলে ঘুরন্ত বস্তুর ঘোরার ভরবেগ অপরিবর্তিত থাকবে। আকারে ছোট হয়ে গেলে বস্তুকে তাই আরও জোরে ঘুরতে হয়। সূর্য, নিউট্রন স্টার, কৃষ্ণগহ্বর সবার ঘোরার শুরু সেই নীহারিকার ঘোরাঘুরি থেকে। বিশাল নীহারিকা মাধ্যাকর্ষণের টানে ছোট হয়ে যখন তারা বা কৃষ্ণগহ্বর হয়ে যায়, তখন তাকে ঘুরতে হয় প্রচণ্ড বেগে। অপরিবর্তিত ভরবেগের সূত্র অনুসারে, একবার পাক খেতে সূর্যের বড়জোর এক মিনিট লাগার কথা, কিন্তু সূর্যের লেগে যায় ২৫ দিন। সূর্য এত আলসে কেন? কারণটি ওই সৌরবায়ু, সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে সূর্য-বাতাসের গুঁতোগুঁতি। কোটি কোটি বছর ধরে চলেছে এই লড়াই, সূর্যকে কাহিল করে ছেড়েছে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ম্যাগনেটিক ব্রেকিং!

সূর্যের আয়তন পৃথিবী থেকে প্রায় ১৩ লাখ গুণ বড়। সূর্যের কেন্দ্রে জ্বলছে আণবিক চুলা, যেখানে হাইড্রোজেন পরমাণু মিলেমিশে হিলিয়াম হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কিছু পদার্থ তাপশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এই প্রচণ্ড ঘনীভূত শক্তি কেন্দ্র থেকে সূর্যের সব আবরণ ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। আসার পথে পাচ্ছে হরেক রকম বাধা। ঠেলাঠেলি আর ভিড়, সেই সঙ্গে জুটেছে সূর্যের চুম্বকীয় বলের খেলা।

এই জটলার অঙ্ক বেজায় জটিল, বিজ্ঞানীরা সেই কবে থেকে মাথা ঘামাচ্ছেন। সূর্যকে চারটি আবরণে ভাগ করা হয়: কেন্দ্র থেকে শুরু করে বাইরের দিকে যাত্রা শুরু করলে আবরণগুলোর নাম যথাক্রমে কেন্দ্রীয় অঞ্চল (Core), ফটোস্ফিয়ার, ক্রমোস্ফিয়ার ও করোনা। আমরা খালি চোখে সূর্যের যে সীমা দেখি, ওটা হলো ফটোস্ফিয়ার, বাইরের আরও দুটো আবরণ আমাদের চোখে পড়ে না। আবরণগুলোর তাপমাত্রা যথাক্রমে দেড় কোটি, ৬ হাজার, ৩০ হাজার ও ২০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে একটু ভেবে দেখুন! অগ্নিকুণ্ড থেকে বাইরে যাচ্ছেন, প্রথমে তাপমাত্রা দেড় কোটি থেকে কমে ৬ হাজার ডিগ্রিতে নেমে এল, তারপর হঠাত্ বাড়তে বাড়তে ২০ লাখ ডিগ্রি! এ যেন রাজা হবুচন্দ্রের রাজ্যের গল্প! বিজ্ঞানীদের বড় আশা, পার্কার আকাশযানটি এই রহস্যের কিছু নতুন খবর এনে দেবে।

সূর্যযানটি বানানোর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে, পরিকল্পনার খুঁটিনাটি তদন্ত শেষ হয়ে গেছে। সূর্যযানটির আয়তন একটি টয়োটা গাড়ির সমান। একটি ডেল্টা-৪ রকেটের মাথায় বসিয়ে ওকে মহাশূন্যে নিক্ষেপ করা হবে।

আদিকালে সূর্যকে মানুষ দেবতা ভাবত। সূর্যকে প্রণাম করে শুরু হতো দিনের কাজ। এখন সময় বদলেছে। কিন্তু সূর্যের তেজ তো কমেনি। কী বিশাল অগ্নিকুণ্ড! একটি গাছের পাতা বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস, পানি ও সূর্যের আলো থেকে বানায় খাদ্য ও অক্সিজেন। আমরা সবাই সেই খাবারে ভাগ বসাই। সেই বাতাসে শ্বাস নিয়ে আমাদের হূিপণ্ড ধুকপুক করে, আমাদের ফুসফুস ওঠানামা করে। আমাদের প্রতিবেলার খাবার, প্রতিমুহূর্তের নিশ্বাস, প্রতিদিনের শক্তির জোগান, সব আসে এই অগ্নিকুণ্ড থেকে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত