কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘সিক্স ডিগ্রি অব জিওফ্রে হিন্টন’। অর্থাৎ বর্তমান সভ্যতার গতিপথ বদলে দেওয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংশ্লিষ্ট যেকোনো আবিষ্কার নিয়ে অনুসন্ধান করলে ছয়বারের কম সময়ে ঘুরেফিরে জিওফ্রে হিন্টনের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। কথাটা মোটেও ফেলনা নয়। গণিতের যেমন ফ্রেডরিখ গাউস কিংবা সমাজবিজ্ঞানের ম্যাক্স ওয়েবার, তেমনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় ব্রিটিশ-কানাডিয়ান গবেষক জিওফ্রে হিন্টন নিঃসন্দেহে অন্যতম পথিকৃৎ।
২০১৮ সালে কম্পিউটারবিজ্ঞানে নোবেল হিসেবে পরিচিত টুরিং অ্যাওয়ার্ড পান এই এআই গবেষক। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু হয়েছিল একজন এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজিস্ট হিসেবে। ছোটবেলা থেকেই মানবমস্তিষ্ক নিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল তাঁর। তিনি ভাবতেন, কীভাবে বুদ্ধিমত্তাকে গণিত আর যন্ত্রের মারপ্যাঁচে আটকে ফেলা যায়। তাঁর এই আগ্রহের কারণ বংশগত। জিওফ্রের প্র-প্র-প্রপিতামহ জর্জ বুল ছিলেন কম্পিউটারের বুলিয়ান লজিকের স্রষ্টা। ব্রিটেন থেকে পিএইচডি করে জিওফ্রে যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলনে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে যুগান্তকারী এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করে আলোচনায় আসেন তিনি।
সে সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাস্তবায়নের নতুন এক পদ্ধতি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। সেই পদ্ধতি পরে পরিচিতি পায় নিউরাল নেটওয়ার্ক নামে। নিউরাল নেটওয়ার্ক হলো মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন জালের আদলে তৈরি একটি বিমূর্ত গাণিতিক মডেল। এই নেটওয়ার্ক বুদ্ধিমত্তার কিছু প্রকৃতি যেমন ইনফারেন্স (প্রমাণ ও কার্যকারণের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা), ইমেজ রিকগনিশন, ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং ইত্যাদি ধারণ করতে পারে। শিশুরা যেমন দেখে দেখে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখে, তেমনি এই নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেলও অনেক ডেটার অভিজ্ঞতা থেকে প্রত্যাশিত কিছু গুণাবলি শিখে নিতে পারে। কিন্তু নিউরাল নেটওয়ার্ক বাস্তবে কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে কি না, সেটা তখনো ছিল বিতর্কের বিষয়। তখনই জিওফ্রে সমাধান করে ফেললেন নিউরাল নেটওয়ার্ক বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা। সদ্য উদ্ভাবিত ব্যাকপ্রোপাগেশন অ্যালগরিদমকে নিউরাল নেটওয়ার্কে প্রয়োগ করে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করলেন তিনি। এই অ্যালগরিদম এতটাই মৌলিক, এখন কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলকে ব্যাকপ্রোপাগেশন ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু একটি সমস্যা তবু রয়েই গেল, এই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে কার্যকর কোনো ফল পেতে হলে দরকার ভারী কম্পিউটেশনাল পাওয়ার। দরকার প্রচুর কাঠামোবদ্ধ তথ্যও। আর তাই আশির দশকের সেই 128KB RAM ম্যাকিনটোশের যুগে জিওফ্রের আবিষ্কার সবার অগোচরেই রয়ে যায়। পরে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে কম্পিউটারের ক্ষমতা আর ইন্টারনেটের তথ্যবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে নিউরাল নেটওয়ার্কও দৃশ্যপটে হাজির হয় স্বমহিমায়।
বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং গুগল ব্রেন প্রজেক্টের অন্যতম পথিকৃৎ জিওফ্রে হিন্টন। তাত্ত্বিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় তিনি এখন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। ব্যাকপ্রোপাগেশন অ্যালগরিদমের পাশাপাশি তিনি বোলজম্যান মেশিন নামের আরেকটি তাত্ত্বিক ধারণার জন্ম দেন। এরপর একে একে ডিস্ট্রিবিউটেড রিপ্রেজেন্টেশন, টাইম ডিলে নিউরাল নেটওয়ার্ক, হেলমজ মেশিন, মিক্সার অব এক্সপার্টস, ভেরিয়েশনাল লার্নিং, আনসুপারভাইজড লার্নিং অব ইমেজ ট্রান্সফরমেশন নামের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ধারণার প্রবর্তন করেন। এগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় প্রাণ সঞ্চার করে। ধীরে ধীরে কম্পিউটেশনাল ক্ষমতার অবিশ্বাস্য অগ্রগতি আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় এ গবেষণার হার দ্রুত বাড়তে থাকে।
জিওফ্রে হিন্টনের তাত্ত্বিক অবদান সাধারণ মানুষের কাছে অতটা পরিচিত নয়। তবে এর প্রভাব সর্বত্র। নেটফ্লিক্সের মুভি রিকমেন্ডেশন, ফেসবুকের ফেস ডিটেকশন, অ্যালেক্সার ভয়েস রিকগনিশন থেকে গুগলের স্বয়ংক্রিয় গাড়ির সবকিছুই জিওফ্রে হিন্টনের গবেষণার প্রায়োগিক প্রমাণ। জিওফ্রে হিন্টন, ইয়ান লে-কুন আর ইয়োশহুয়া বেনজিও—এই তিনজনকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গডফাদার বলা হয়।
২০০৪ সালে একাডেমিয়ার শ্রেষ্ঠ গবেষকদের নিয়ে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করেন ‘নিউরাল কম্পিউটেশন অ্যান্ড অ্যাডাপটিভ পারসেপশন’ নামের একটি রিসার্চ প্রোগ্রাম। এসবই পরে গুগল, ফেসবুক, আমাজনের মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কার্যপ্রণালি বদলে দেয়। পাশাপাশি গুগল ব্রেনের একটি শাখা সূচনার মাধ্যমে জিওফ্রের হাত ধরে টরন্টোকেন্দ্রিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষকদের একটি পরিমণ্ডল তৈরি হয়। এখানেই সহকর্মীদের নিয়ে স্পিচ রিকগনিশন আর অবজেক্ট ডিটেকশনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেন তিনি। তাঁর প্রচেষ্টাই এখন টরন্টোকে করেছে গবেষকদের অন্যতম গন্তব্য।
দীর্ঘদিন ধরে মেরুদণ্ডের সমস্যার কারণে জিওফ্রে বসতে পারেন না। কিন্তু নিজের অক্ষমতাকে অতিক্রম করে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যে অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, তা কিংবদন্তিতুল্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়