বর্তমানে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলছে যুদ্ধ। ইসরায়েল ইরানকে আক্রমণ করে বেশ ক্ষয়ক্ষতি করেছে। অপরদিকে ইরানের আক্রমণে ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি কম। মূলত ইরানের আক্রমণ ঠেকিয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল। মৃত্যুর সংখ্যা দেখলেই তা বোঝা যায়। ইরানে নিহতের সংখ্যা ২২৪, আর ইসরায়েলে ২৪। ইরানের ছোঁড়া মিসাইল আকাশে থাকা অবস্থায় ধ্বংস করে দিতে পারছে ইসরায়েল। তাই ওদের ক্ষতি হচ্ছে কম। আসলে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ আধুনিক। অত্যাধুনিক এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নাম আয়রন ডোম।
স্বল্প-পাল্লার এই আয়রন ডোম আকাশে থাকা শত্রু-বিমানসহ ড্রোন ও মিসাইলের হুমকি মোকাবেলা করে। গত ১৩-১৪ বছর ধরে এটি ইসরায়েলের আকাশ পাহারা দিচ্ছে। ৩৬০ ডিগ্রিতেই কভারেজ দিতে পারে এই আয়রন ডোম। ২০১১ সাল থেকে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি আক্রমণ আটকে দিয়েছে এই প্রযুক্তি। সে হিসেবে আয়রন ডোমের সাফল্যের হার প্রায় ৯০ শতাংশ। কিন্তু কি এই আয়রন ডোম? কীভাবে এটি কাজ করে?
আয়রন ডোম একটি মোবাইল বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা একসঙ্গে নানা ধরনের হুমকি মোকাবেলায় সক্ষম। এটি মূলত স্বল্প পাল্লার রকেট, কামান এবং মর্টার হামলা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। প্রতিপক্ষ একসঙ্গে অনেকগুলো মিসাইল ছুড়লেও তা ঠেকানোর ক্ষমতা রাখে এই প্রযুক্তি। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা এই প্রযুক্তির সাহায্যে ইসরায়েল নিজ দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
আইরন ডোম প্রধানত তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে কাজ করে। সেগুলো হলো: শনাক্তকরণ ও ট্র্যাকিং রাডার, যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বা বিএমসি এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ইউনিট বা মিসাইল ফায়ারিং ইউনিট।
শনাক্তকরণ ও ট্র্যাকিং রাডার রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করে এবং সেগুলোর গতিপথ ট্র্যাক করে। যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ অংশের কাজ রাডার থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ গণনা করে। যদি ক্ষেপণাস্ত্রটি কোনো সুরক্ষিত এলাকার দিকে যায়, তাহলে এটি ইন্টারসেপ্টর মিসাইল নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়। আর ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ইউনিট থেকে টামির নামের ইন্টারসেপ্টর মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়, যা ইসরায়েলের দিকে আগত ক্ষেপণাস্ত্র আকাশেই ধ্বংস করে দেয়। প্রতিটি টামির ক্ষেপণাস্ত্রে ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল সেন্সর ও স্টিয়ারিং ভেন রয়েছে, যা সেটিকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে সাহায্য করে।
আয়রন ডোম প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে, শক্তিশালী হচ্ছে এর ক্ষমতা। আয়রন ডোমের কয়েকটি ধরন আছে। নৌবাহিনীর জন্য ব্যবহৃত হয় সি-ডোম। অন্য ব্যবহারের জন্য রয়েছে আই-ডোম। এটি দিয়ে আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত আকাশ প্রতিরক্ষার কাজ করে। ফলে স্থল, নৌবাহিনীসহ দেশের সম্পদ এবং বেসামরিক জনগণ নিরাপদ পরিবেশ পায়।
এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার স্থান থেকে ৪-৭০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরত্বে পৌঁছে আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। ইসরায়েলের বিভিন্ন জায়গায় আয়রন ডোম ব্যাটারি বসানো আছে। প্রতিটা ব্যাটারিতে থাকে তিন থেকে চারটি লঞ্চার। প্রতিটি লঞ্চারে ২০টি ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র থাকে। সেগুলো ছুটে গিয়ে প্রতিপক্ষের ছোঁড়া বস্তুকে আঘাত করে লক্ষ্যচ্যুত এবং ধ্বংস করে ফেলে। ২০০৬ সালে লেবানন প্রায় ৪ হাজার রকেট ছোঁড়ে ইসরায়েলের দিকে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পরপরই আয়রন ডোমের ব্যবস্থা তৈরি করে ইসরায়েল।
এই আয়রন ডোম তৈরি করেছে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম এবং ইসরায়েল অ্যারোস্পেস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাও ছিল এতে। ২০১১ সালে শেষ হয় এর প্রস্তুতি। এরপর দেশটির বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করা হয় এই আয়রন ডোম। ২০১১ সালেই গাজা থেকে ছোঁড়া একটি রকেট আটকে দিয়ে সফলতার প্রমাণ দেয় এই প্রযুক্তি। সেই থেকে শুরু। এরপর হামাস, ইরান ও লেবাননসহ প্রতিপক্ষের প্রতিটি আক্রমণের ক্ষতি প্রায় ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সফল হয় ইসরায়েল।
আয়রন ডোম প্রযুক্তি কয়েক স্তরে সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে রাডার ব্যবহার করে আগত রকেট বা মিসাইল শনাক্ত করে। রকেট জনবসতি এলাকায় পড়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, তা যাচাই করে দেখে। যদি রাডার বুঝতে পারে আগত রকেট বা মিসাইল হুমকির কারণ হবে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে রকেট বা মিসাইলগুলোর দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে আয়রন ডোম। যদি দেখা যায় আগত রকেট ফাঁকা জায়গায় পড়ার সম্ভাবনা প্রবল, তাহলে আর ডোম ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে না। কারণ, আয়রন ডোমের একটি ক্ষেপণাস্ত্রের দাম প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।
আয়রন ডোমের পাশাপাশি খরচ বাঁচাতে বিকল্প পদ্ধতি আছে ইসরায়েলের। যার নাম আয়রন বিম।
আয়রন বিম হলো উচ্চশক্তির লেজার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই লেজার রশ্মি ছোট ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং মর্টার শেলের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। এমনকি অনেক ড্রোন একসঙ্গে ছুটে এলেও আয়রন বিমের সাহায্যে আটকে দেওয়া যায়। এই পদ্ধতির খরচ অনেক কম। সাধারণভাবে একটা লেজার ছোঁড়ার খরচ মাত্র কয়েক ডলার হতে পারে। আর সব মিলিয়ে এই প্রযুক্তির খরচ হতে মাত্র ২ হাজার ডলারে নামিয়ে আনা যায়। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ২০২৫ সালের অক্টোবরে এটি স্থাপন করা হবে। যদিও এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা প্রথম সবার সামনে আনে ২০১৪ সালে। ২০২২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ঠিকাদার লকহিড মার্টিন এই প্রকল্পে যুক্ত হয়।
এখানেই শেষ নয়। আয়রন ডোমের চেয়েও বিস্তৃত পরিসরের হুমকি এলে সে ব্যবস্থাও আছে ইসরায়েলের কাছে। এ জন্য দেশটি তৈরি করেছে ডেভিডস স্লিং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটি ৭০-৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বড় পরিসরে সুরক্ষা দিতে পারে। উচ্চ-পাল্লার রকেট, ক্রুজ মিসাইল এবং মাঝারি বা উচ্চ-পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলের বিরুদ্ধে এটি কাজ করে। ১৫ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ডেভিডস স্লিংয়ের ক্ষেপণাস্ত্র যেতে পারে। এর বহুমুখী ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র (প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দিতে যা ছুটে যায়) রয়েছে। একে বলা হয় স্কাইসেপ্টর। ইসরায়েলের অস্ত্রনির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাফায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের রেথিওনের যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠে ডেভিডস স্লিং সিস্টেম। খরচও সাশ্রয়ী। এটি চালু হয় ২০১৭ সালে।
আয়রন ডোমের মতোই ডেভিডস স্লিং কেবল সুনির্দিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রগুলো টার্গেট করে। মানে যেগুলো জনবসতির জন্য হুমকিস্বরূপ, সেগুলো টার্গেট করে। নোভেশন স্টিয়ারিং কন্ট্রোল, মাল্টি-প্রপালশন এবং একটা অ্যাডভান্সড সিকারের সমন্বয়ে কাজ করে ডেভিডস স্লিং। ট্যাকটিক্যাল ব্যালিস্টিক মিসাইল কিংবা বড় আকারের রকেটও এর সামনে টেকে না।
ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের মিশনে এটি পুরোপুরি কার্যকর রয়েছে। সহজেই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এটি ব্যবহার করা যায়। সেভাবেই এটি ডিজাইন করা হয়েছে। ডেভিডস স্লিংয়ের প্রতিটি স্টানার ক্ষেপণাস্ত্রের দাম প্রায় ১০ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় ১২ কোটি ২২ লাখ টাকার বেশি।
এছাড়াও আছে অ্যারো-২ এবং অ্যারো-৩। অ্যারো-২ ডিজাইন করা হয়েছে স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল ধ্বংস করার জন্য। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে ৫০ কিলোমিটার বা তার বেশি উচ্চতায় ভাসমান হুমকির বিরুদ্ধে এটি কাজ করে। এই ব্যবস্থা তৈরির কাজ শুরু হয় ১৯৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পর। অ্যারো-২ চালু হয় ২০০০ সালে। এর পরিসর ছোট। এটি ৫০০ কিলোমিটার দূরে থাকা অবস্থায় প্রতিপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করতে পারে। সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম। এর ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের চেয়ে ৯ গুণ বেশি গতিতে চলে এবং একসঙ্গে ১৪টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। অ্যারো-২ প্রথমবার ব্যবহৃত হয় ২০১৭ সালে।
আর অ্যারো-৩ ডিজাইন করা হয়েছে উচ্চ-পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল ধ্বংসের জন্য। সাধারণত উচ্চ-পাল্লার এই মিসাইলগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেরও বাইরে থাকে। প্রায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পরিসরে এটির কাজ। কভারেজ বেশি হলেও অ্যারো-২-এর মতোই এটিও ১০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারে। ২০২৩ সালে অ্যারো-৩ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় শহর এলাতের দিকে ছোঁড়া একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে। যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির সহায়তায় ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে।
গত অক্টোবরে ইসরায়েলে আক্রমণ করে ইরান। তখনই যুক্তরাষ্ট্র জানায় তারা ইসরায়েলকে একটা থাড ব্যাটারি (টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স) দেবে। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ডেভিডস স্লিংয়ের মতো কাজ করে। এটি ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। ফলে থাড প্রতিপক্ষের মিসাইল শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গে আঘাত হানতে পারে। তা হোক বায়ুমণ্ডলের ভেতর বা বাইরে। একটা থাড ব্যাটারিতে ছয়টি লঞ্চার থাকে। প্রতিটি লঞ্চারে থাকে আটটি ক্ষেপণাস্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র এটি পরিচালনা করতে ১০০ সৈন্যও মোতায়েন করেছে ইসরায়েলে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ২০১৫ সাল থেকে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, তারা এই থাড প্রযুক্তি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছেও বিক্রি করেছে।
সাধারণ বিমানকে এই প্রযুক্তি কীভাবে মিসাইল থেকে আলাদা করে শনাক্ত করে? ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সাধারণত উচ্চগতিতে এগিয়ে আসে। আর সাধারণ বিমান বা রকেট চলে ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়ে অনেক ধীর গতিতে। এই পার্থক্য ব্যবহার করেই আয়রন ডোম তিনটি ধাপে কাজ করে। প্রথমে শনাক্ত করে। এরপর ট্র্যাক বা নজরে রাখে। তারপর ক্ষতিকর মনে হলে লঞ্চার থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ইন্টারসেপ্টের জন্য বের করে দেয়। ডোমের ট্র্যাকিং সিস্টেম যদি দেখে, প্রতিপক্ষের মিসাইল জনবসতিপূর্ণ বা সংবেদনশীল এলাকায় পড়বে, সঙ্গে সঙ্গে তা রুখে দেয় প্রতিমিসাইল পাঠিয়ে। কিন্তু যদি সেই মিসাইলটা ফাঁকা মরুভূমি বা মানুষ নেই এমন এলাকায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে আয়রন ডোম সেটা আমলে নেয় না।
মোট কথা আয়রন ডোম, ডেভিডস স্লিং, অ্যারো-২ ও অ্যারো-৩ ব্যবস্থা বসানো হয়েছে ইসরায়েলের বিভিন্ন এলাকায়। বিভিন্ন উচ্চতা ও দূরত্বে আগত ক্ষেপণাস্ত্র চোখের পলকেই প্রতিহত করতে পারে এসব ব্যবস্থা।